E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে ফিতরার ভূমিকা অনস্বীকার্য

২০২৩ এপ্রিল ০২ ১৮:২৬:৪৩
সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে ফিতরার ভূমিকা অনস্বীকার্য

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


মাহে রমজান অফুরন্ত রহমত, বরকত, কল্যাণ ও মঙ্গল পূর্ণ মাস। মাহে রমজানে যেসব আমল দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্যলাভে ধন্য হয়, তার মধ্যে সদকাতুল ফিতর আদায় করা অন্যতম। ফিতরা বা ফেতরা আরবী শব্দ, যাকে ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত করা হয়েছে। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হ্যযেছে যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন।

পবিত্র মাহে রামাদানে সদকাতুল ফিতর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এই সদকার কেন্দ্র পবিত্র ঈদুল ফিতর। সহজ কথায় পবিত্র ঈদুল ফিতরের সাথে সম্পৃক্ত বলেই এটাকে ‘সদকাতুল ফিতর’ বলা হয়। সুরা আ‘লার ১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘সেই-ই সফলতা লাভ করেছে, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে।’ হজরত কাতাদাহ (রহ.) এই আয়াতের ‘তাঝাক্কা’ তথা ‘পরিশুদ্ধ হওয়া’ শব্দ দ্বারা ‘সদকায়ে ফিতর’কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে বলে মত ব্যক্ত করেছেন। কেননা হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসুলুলাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম সদকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করেছেন। যাতে করে রোজাদারদের রোজার যাবতীয় ভুলত্রুটি পরিশুদ্ধ করা যায় এবং গরিব লোকেরা আহারাদি পায়’ (মিশকাত ১৬০ পৃষ্ঠা)। ফিতরা বা সদকাতুল ফিতর হলো সেই নির্ধারিত সদকা, যা ঈদের নামাজের আগে প্রদান করতে হয়। একে জাকাতুল ফিতরও বলা হয়।

আমাদের এ অঞ্চলে তা ‘ফিতরা’ নামে পরিচিত। সদকায়ে ফিতর এমন এক সদকা যা রমজানুল মোবারকের রোজা শেষ হবার পর ওয়াজিব হয়ে যায়। সদকাতুল ফিতর সর্ম্পকে হাদীসে এসেছে, আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা দুইজন ব্যক্তির মাঝে এক সা’ গম কিংবা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব আদায় করে দাও। এই বিধানটি প্রত্যেকটি গোলাম, স্বাধীন, ছোট ও বড় ব্যক্তির ওপর ফরয।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং : ২৩৬৬৩) হজরত রাসূলে কারিম (সাঃ) তা আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন এবং এর নিয়ম-নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। এ কারণেই হজরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পবিত্র যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ ইসলামের অন্যান্য মৌলিক আমল ও ইবাদতের ন্যায় সদকাতুল ফিতরও নিয়মিত আদায় করে আসছে। ঈদের দিন সকালবেলায় যিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের (সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বাহান্ন ভরি রুপা বা সমমূল্যের ব্যবসাপণ্যের) মালিক থাকবেন, তাঁর নিজের ও পরিবারের ছোট–বড় সবার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা তাঁর প্রতি ওয়াজিব।

ফিতরা নির্ধারণের ইতিহাস

ইসলাম মানবতাবাদী ধর্ম। সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার শিক্ষা প্রদান করে। ধনী-গরিব সকলে যেন ঈদ উৎসবে সমানভাবে আনন্দ উপভোগ করতে পারে সেজন্য এই সাদাকাতুল ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ফিতরা মূলত রোজার জাকাত। জাকাত যেমন মালকে পবিত্র করে, ঠিক তেমনি ফিতরাও রোজাকে পবিত্র করে।
এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) সদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোজাকে অনর্থক কথা ও অশ্লীল ব্যবহার হতে পবিত্র করার এবং গরিবের মুখে অন্ন দেওয়ার জন্য। (সূত্র : মেশকাত: আবু দাউদ)

ওয়াকি ইবনুল জাররাহরা বলেন, সিজদায়ে সাহু যেমন নামাজের ক্ষতিপূরণ, তেমনি সাদাকাতুল ফিতর রোজার ক্ষতিপূরণ।

ইসলামী শরীয়াহ মতে— আটা, যব, কিসমিস, খেজুর ও পনির ইত্যাদি পণ্যগুলোর যে কোনও একটি মাধ্যমে ফিতরা প্রদান করা যায়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, গম বা আটার মাধ্যমে ফিতরা আদায় করলে অর্ধ সা’ বা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম কিংবা এর বাজার মূল্য ১১৫ টাকা প্রদান করতে হবে।

আর যবের মাধ্যমে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩ শ’ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ৩৯৬ টাকা, কিসমিসের মাধ্যমে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১ হাজার ৬৫০ টাকা, খেজুরের মাধ্যমে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১ হাজার ৯৮০ টাকা ও পনিরের মাধ্যমে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম কিংবা এর বাজার মূল্য ২ হাজার ৬৪০ টাকা ফিতরা প্রদান করতে হবে।

দেশের সকল বিভাগ থেকে সংগৃহীত আটা, যব, খেজুর, কিসমিস ও পনিরের বাজার মূল্যের ভিত্তিতে এই ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে। মুসলমানরা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী উপর্যুক্ত পণ্যগুলোর যে কোন একটি পণ্য বা এর বাজার মূল্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবেন।

উল্লেখ্য, উপর্যুক্ত পণ্যগুলোর স্থানীয় খুচরা বাজার মূল্যের তারতম্য রয়েছে। স্থানীয় মূল্যে পরিশোধ করলেও ফিতরা আদায় হবে।এই বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে ফিতরার হার জনপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬৪০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর (২০২২) সর্বনিম্ন ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ছিল ২ হাজার ৩১০ টাকা।

নিম্নে সদকাতুল ফিতরের ১০ টি মাসয়ালা উল্লেখ করা হলো

১। সদকায়ে ফিতরের নিসাব যাকাতের নিসাবের সমপরিমাণ। অর্থাৎ কারো কাছে সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় বিদ্যমান থাকলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে।যাকাতের মতো বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। (ফাতহুল ক্বাদির ২/২৮১)

২। সদকায়ে ফিতর আদায় করার পদ্ধতি হলোঃ গম বা আটা দ্বারা আদায় করলে অর্ধেক সা’ অর্থাৎ পৌনে দুই সের দিতে হবে। আর খেজুর, যব কিংবা কিসমিস দ্বারা দিতে চাইলে পূর্ণ এক সা’ অর্থাৎ সাড়ে তিন সেরের চেয়ে কিছু বেশি দ্বারা আদায় করতে হবে অথবা এর মূল্য দিতে হবে। (রুদ্দুল মুহতার ৩/৩২২)

৩। সদকায়ে ফিতর আদায় করার পর ঈদের দিন যদি মূল্যমান বেড়ে যায় তাহলে ঐ অতিরিক্ত মূল্যও আদায় করতে হবে। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ১৪/৩৯২ )

৪। ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর বা ফেতরা আদায় করা উত্তম। তবে সেই সময়ের আগেও অর্থাৎ রমজানেও আদায় করা যেতে পারে। ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে ফিতরা আদায় করা মুস্তাহাব। তবে পরে আদায় করলেও তা আদায় ‎হবে। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া: ১৪/৩৮৩ )

৫। সদকায়ে ফিতর আদায় করার সময় স্থানের ভিন্নতার কারণে মূল্য পার্থক্য ধর্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।বরঞ্চ যেই জায়গায় সদকায়ে ফিতর আদায় করবে সেখানকার মূল্য ধর্তব্য হবে। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া: ১৪/৩৭৪)

৬। সদকায়ে ফিতর নিজের পক্ষ থেকে আদায় করা এবং পিতা হলে তার নিজ নাবালক সন্তানের পক্ষ থেকে আদায় করে দেওয়া ওয়াজিব।সাবালক সন্তান, স্ত্রী, চাকর-চাকরাণী, মাতা-পিতার পক্ষ থেকে দেওয়া ওয়াজিব নয়। হ্যাঁ, সাবালক সন্তান পাগল হলে তার পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজিব। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ১৪/৩৯৭)

৭। নিছফে সা’ এর পরিমাণঃ সদকায়ে ফিতর যদি গম দ্বারা আদায় করা হয় তাহলে জন প্রতি ‘নিছফে সা’ গম দিতে হয়। আর নিছফে সা’ এর পরিমাণ- এক সের ৬০ তোলা, যা ইংরেজি মাপ অনুযায়ী ১ কেজি ৬৬৩ গ্রাম। অর্থাৎ প্রায় পৌনে দুই কেজি। (ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ ৬/৩০৪)

৮। বিবাহিতা ছোট মেয়ে নিজে সম্পদশালী হলে সদকায়ে ফিতর তার সম্পদ থেকে আদায় করবে। আর যদি সম্পদশালী না হয় তাহলে ছেলে পক্ষ উঠিয়ে না নিলে নিজ পিতার ওপর ওয়াজিব হবে। আর উঠিয়ে নিলে কারও ওপর ওয়াজিব হবে না। (ফাতাওয়া আলমগিরি, ১/১৮২)

৯। রমজানের শেষ দিনেও যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। (ফাতাওয়া আলমগিরি, ১/১৯২)

১০। কেউ ফেতরা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করলে তার পক্ষ থেকে তার উত্তরাধিকারী ফেতরা দিলেও আদায় হয়ে যাবে। (রুদ্দুল মুহতার , ২/১০৬)

ইসলামের প্রতিটি বিধানের পেছনে মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। তেমনিভাবে সদকাতুল ফিতর আদায়ের মধ্যেও ইহজাগতিক ও পারলৌকিক উভয় কল্যাণ নিহিত। এটি অনেকটা আধুনিক যুগের রিফাইনিং মেশিনের মত। যেটির মাধ্যমে পণ্যকে পরিশুদ্ধ করা হয়। মহান আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের রোজা রাখার এবং সকল সম্পদশালী ব্যক্তিকে যার যার অবস্থান অনুযায়ী ফিতরা বা সদকাতুল ফিতর আদায় করার তাওফিক দান করুন। ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে রোজার ভুল-ত্রুটিগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: কলাম লেখক ও ইসলামী গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test