E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অটিজম কোনো রোগ নয়, এটি ভিন্ন ক্ষমতার অধিকারী শিশু

২০২৩ এপ্রিল ০৪ ১৪:৫৭:৫৩
অটিজম কোনো রোগ নয়, এটি ভিন্ন ক্ষমতার অধিকারী শিশু

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে/ তার মুখে খবর পেলুম/ সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক/ নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার/ জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে/ খর্বদেহ নি:সহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত/ উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়/ সে ভাষা বোঝে না কেউ, কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার- আগামি প্রজন্ম আজকের শিশুদের নিয়ে এমনই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন কবি সুকান্ত ভট্রাচার্য তার বিখ্যাত ছাড়পত্র কবিতায়। আজকের শিশুর জন্য পৃথিবীর সব জঞ্জাল সরাতেও তাকে বলতে দেখা গিয়েছে।

শিশুরা ফুলের মত স্নিগ্ধ, পবিত্র ও নি:ষ্পাপ। শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ কর্ণধার। ভবিষ্যৎ শান্তি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নির্ভর করে শিশুদের উপর। সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়বে এ শিশুরাই। পৃথিবীর হাসি-গান- আনন্দের নিরন্তর উৎস হলো তারা। আজকের শিশুরাই আগামীর স্বপ্নময় ভবিষ্যতের দিশারী। কিন্তু সেই শিশু যদি হয় অটিজম তাহলে কি সে আগামি দিনের কর্ণধার হতে পারবে না? অটিজম শিশুরা কি সমাজের বোঝা?

এখনো আমরা অটিজম শব্দের সাথে তেমন একটা পরিচিত নয়। যাওবা পরিচিত তাও আবার আমাদের মধ্যে ভ্রান্ত কিছু ধারণা রয়েছে। এই যেমন ধরুণ- অটিজম এক ধরনের মানষিক অসুস্থতা। এটি একটি রোগ। অটিজম ব্যক্তিরা নির্বোধ। অটিজম ব্যক্তিরা কর্মজীবনে সফল হতে পারে না। অটিজম একটি বংশগত রোগ ইত্যাদি।

অটিজম বা অটিস্টিক শব্দটির সঙ্গে আমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে কে কতটুকু জানে বা জানাটা কতটুকু স্বচ্ছ, সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। গ্রামে কিছুদিন পূর্বে কিংবা বলা যেতে পারে এখনো মনে করা হয়, অটিস্টিক শিশুরা ও ব্যক্তিরা জিন বা ভূতের আসরের শিকার। কিংবা এও মনে করা হয়, তারা পাগল। শুধু গ্রাম কেন শহরের অনেকের মাঝেও এমন ধারণা আছে।

এ ধরনের ভ্রান্ত মানষিকতা থাকার কারণে সমাজে চরম ভাবে অবহেলিত অটিজম শিশুরা। ভুল চিন্তা-চেতনার কারণে শৈশবের মুখরিত আনন্দঘন পরিবেশ থেকে তারা বঞ্চিত। সেই সাথে অটিজম আক্রান্ত পরিবারের সদস্যরাও নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার। বিশেষ করে অটিজম শিশুদের বাবা-মা শত কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে তাদের সন্তানকে আড়াল করে রাখেন সমাজ থেকে।

অথচ বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। অটিজম মূলত স্নায়ুবিকাশজনিত একটি সমস্যা। যা মস্তিস্কের সাধারণ কর্মক্ষমতাকে ব্যাহত করে। এই সমস্যাকে ইংরোজিতে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বলে। অটিজমকে সাধারণভাবে শিশুর মনোবিকাশগত জটিলতা হিসেবে চিহৃিত করা যেতে পারে।

সেক্ষেত্রে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে আমাদের সমাজে যে গুজব বা প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে অটিজম কোন মানষিক রোগ নয়। এটি একটি স্নায়বিক গঠনগত সমস্যা। আমাদের গবেষকরা প্রমাণ করেছেন অটিজম কোন রোগ নয় এবং এটি কোন বংশগত রোগও নয়। সম্পূর্ণ সুস্থ বাবা-মায়েরও অটিজম শিশু হতে পারে।

অটিজম ব্যক্তিরা কর্মজীবনে সফল হতে পারে না- এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এর কোন ভিত্তি নেই। অটিজমদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে কাজ করতে সীমাবদ্ধতা থাকলেও এমন অনেক পথ খোলা রয়েছে, যেখানে তারা সফলভাবে কাজ করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় জায়গা করে নেওয়া আমেরিকান অধ্যাপিকা টেম্পল গ্র্যান্ডিন, ২০০২ সালে অর্থনীতাতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. ভার্নন স্মিথ, অস্কারজয়ী অভিনয় শিল্পী স্যার অ্যান্থনি হপকিন্স প্রমূখ। এরা সবাই অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের ভুক্তভোগী। এরা কিন্তু শুধু জীবনে শুধু সফলই হননি। এরা বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছে। তাই কেউ অটিজম হওয়া মানেই যে তিনি অক্ষম তা কিন্তু মোটেও নয়।

তাই আমাদের সমাজে যারা অটিজম শিশু রয়েছে তাদের প্রতি আমাদের মানষিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। অটিজম শিশুদেরকে ভালোবাসতে হবে। তাদের জীবনের গতি পরিবর্তনের জন্য আমাদের সবার সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। স্বপ্নীল পরিবেশে তাদের বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। কোন ভাবেই অটিজম শিশুদেরকে অবহেলা করা যাবে না। ওরাও সমাজের আর দশটা শিশুর মতো সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার রাখে। ওদের সেই অধিকার আমরা খর্ব করতে পারিনা। পরিচর্যা পারে যদি উদ্যান সাজাতে তাহলে অটিজম বোঝা নয় সমাজের কাছে।অটিজম বৈশিষ্ট সম্পন্ন শিশুদের যত্ন নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সঠিক পরিচর্যা করলে অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশু-কিশোররা রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠবে। অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশু-কিশোরদের সম্ভাবনাগুলোকে চিহ্নিত করে সঠিক পরিচর্যা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলা হলে তারাও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠবে।

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন, আমাদের সরকার ইতোমধ্যে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী (এনডিডি) সুরক্ষা ট্রাস্ট অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তির গৃহভিত্তিক পরিচর্যা ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য কোভিড পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ৫৩টি জেলার ১৯০টি উপজেলার ৩৯০ জন মাতা-পিতা/অভিভাবকদের অনলাইন প্রশিক্ষণ দিয়েছে। একইসাথে ৬০টি জেলার ১০৫টি উপজেলার ১১৫টি বিদ্যালয়ের ৪৫০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং এটি চলমান প্রক্রিয়া। ‘বলতে চাই’ ও ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ নামক দুটি অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে।

এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্টের আওতায় এ বছরই ১৪টি উপজেলায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে ‘অটিজম ও এনডিডি সেবা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে অটিজমসহ অন্যান্য এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিদেরকে জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপে সোশ্যাল ও মেডিকেল পদ্ধতির সমন্বয়ে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিম দ্বারা আন্তর্জাতিক মানের আর্লি ইন্টারভেনশনসহ ১৭ ধরনের বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হবে। এ কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে সারা দেশে সম্প্রসারণ করা হবে।

অটিজম কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। অটিজম মূলত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতাজনিত একটি মানসিক রোগ। এটি মানুষের হরমোনজনিত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। এটির প্রতীকী রং নীল। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা; তেমনি তাদের প্রতিভাও ভিন্ন। কেউ হয়তো ভালো ছবি আঁকতে পারছে, কেউ বা নিজের কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারে। এসবই অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সাফল্য বলে খুশি থাকতে হবে।'এছাড়াও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর জন্য কেবল মাকে নয়, বাবাকেও সময় ও সহযোগিতা করতে হবে।

তাই অটিজম শিশুদের জন্য আমরা একটি সুন্দর সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলতে চাই। আগামি নবজাতকের কাছে সুকান্ত ভট্রাচার্যের সেই প্রতিশ্রুতিই রেখে যেতে চাই-

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস ।।

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test