E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধ ওষুধ শিল্প ও জনস্বাস্থ্য খাতে ডা. জাফরুল্লাহর অবদান অবিস্মরণীয় 

২০২৩ এপ্রিল ১২ ১৬:৫৩:২৯
মুক্তিযুদ্ধ ওষুধ শিল্প ও জনস্বাস্থ্য খাতে ডা. জাফরুল্লাহর অবদান অবিস্মরণীয় 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


৮১ বছরের জীবনের বৃত্ত পূর্ণ করে প্রয়াত হলেন ক্ষণজন্মা মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় ঔষধ নীতির রূপকার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কর্মময় জীবনের অবসান ঘটল। মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল ২০২৩,  রাত ১১টায়,  রাজধানীর ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। কিছু দিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগেও ভুগছিলেন। গত ৫ এপ্রিল তাঁকে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রধান কিডনি বিশেষজ্ঞ ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রধান চিকিৎসক অধ্যাপক মামুন মোস্তাফী রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন ভাস্কুলার সার্জন। তিনি মূলত জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, ওই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহির্বিশ্বে তাঁর পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী নাগরিক অধিকার আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। অসুস্থ শরীরেও তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামে ফিরে শুরু করেন স্বাস্থ্যযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের যে ফিল্ড হাসপাতালটি গড়েছিলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে তা নতুন করে গড়ে তোলেন কুমিল্লায়। পরে তা স্থানান্তর করেন ঢাকার অদূরে সাভারে। এই ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটি অবশ্য দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

দেশের চিকিৎসাখাত যখন পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গিয়েছে, তখনও সত্যিকার অর্থেই সেবা দিয়ে যাচ্ছে ডা. জাফরুল্লাহর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। স্বাস্থ্যবীমা চালু আছে জন্মলগ্ন থেকেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঢাকার হাসপাতালে সন্তান প্রসবের মোট খরচ মাত্র ২ হাজার টাকা। দেশে সাধারণভাবে একবার কিডনি ডায়ালাইসিসের খরচ গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। ঠিক এই খরচ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা।

প্রথম জীবনে বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। দেশে-বিদেশে রয়েছে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। সুবিধাবাদী সুশীল নয় বরং একজন বিবেকবান বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার খ্যাতি দেশজোড়া।

জীবদ্দশায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদক’ অর্জন করেন। তার ঝুলিতে রয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সম্মানজনক নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার কোয়েপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা হাছিনা বেগম চৌধুরী ছিলেন গৃহিনী। মা–বাবার দশ সন্তানের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ঢাকে কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভর্তি হন। সেই সময় তিনি বাম রাজনীতিতে যুক্ত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে সময় হাসপাতালের অনিয়ম–দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৬৪ সালে এমবিবিএম পাস করে যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে তিনি সাধারণ সার্জারি ও ভাস্কুলার সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলায় বিশেষ ভূমিকা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত চিকিৎসকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করা, হাসপাতালের জন্য ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। যাদের আগে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না এমন নারীরা কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েই হাসপাতালে সেবার কাজ করেছিলেন। বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের সেই অভিজ্ঞতা জারুল্লাহ চৌধুরী কাজে লাগিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা যে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব–তা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রমাণ করে। সেই অভিজ্ঞতার কথা বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটে প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। তারপর থেকে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ধারণাটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ট্রাস্টি হিসেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন সহজভাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য সেবার জন্য সব ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকের দরকার নেই। স্বল্প শিক্ষিত মানুষকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েও সেবা পাওয়া সম্ভব। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্য বিমা চালু হয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার কোনো উদ্যোগকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে গড়ে তোলা সফল স্বাস্থ্য উদ্যোগ সরকারই যেন সারা দেশে প্রয়োগ করে বা ছড়িয়ে দেয়।

স্বাধীনতার পর দেশের ওষুধের বাজারে বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। তখন বাজারে চার হাজার ধরনের ওষুধ ছিল, তার প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। ওষুধ ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনামলের ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। জাতীয় ওষুধ নীতি দেশি কোম্পানিগুলোকে ওষুধ উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করে দেয়, পাশাপাশি দেশে তৈরি হওয়া ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা বন্ধ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ। দেশের মানুষকে স্বল্প মূল্যে ওষুধ দেওয়ার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ওষুধ কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করে।

বৈশ্বিকভাবে বিকল্প স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভূমিকা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছর ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি আয়োজন করে। এর বিকল্প হিসেবে কয়েক বছর পর পর আয়োজন করা হয় পাবলিক হেলথ অ্যাসেম্বলি বা জনগণের স্বাস্থ্য সম্মেলন। এটা আয়োজন করে পিপলস হেলথ মুভমেন্ট নামের একটি বৈশ্বিক সংগঠন। এই সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনের নানা পর্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা সম্মান পেয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় সরকার। ফিলিপাইনের র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে তাঁকে দেওয়া হয় রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড। কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন ২০০৯ সালে দেয় ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান উপাধি। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি থেকে ২০১০ সালে দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ অ্যাওয়ার্ড। যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ ২০২২ সালে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ‘এনআরবি লিবারেশন ওয়ার হিরো ১৯৭১’ পুরস্কার দেয়।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী ৫০টির বেশি দেশে বিভিন্ন সম্মেলন বা সেমিনারে মূল বক্তা হিসেবে অংশ নেন। একাধিক দেশকে জাতীয় ওষুধ নীতি তৈরিতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে একটির নাম ‘রিসার্চ: অ্যা মেথড অব কলোনাইজেশন’। এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। এরপর এটি বাংলা ছাড়াও ফরাসি, জার্মান, ইতালি, ডাচ, স্পেনিস ও একাধিক ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনের শেষ বছরগুলোতে রোগ–ব্যধির সঙ্গে লড়তে হয়েছে। জটিল কিডনি রোগে ভুগছিলেন। মানুষ যেন সহজে প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি পেতে পারেন সেজন্য তিনি আইনের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। পাশাপাশি তাঁর হাতে গড়ে ওঠা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট তৈরি করেছিলেন। ওই ইউনিটে নিজেই ডায়ালাইসিস করাতেন। ইউনিটটি তিনি করেছিলেন কম মূল্যে সাধারণকে মানুষকে সেবার সুযোগ করে দিতে। একটি ক্যানসার হাসপাতাল করার ইচ্ছাও তাঁর ছিল।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের পথিকৃৎ কর্মী ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা। রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন অসংখ্য আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার। জাতির যেসব সূর্যসন্তান আজকের এই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিয়োগকারী জাফরুল্লাহর পরে বড় অবদান ছিল জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলে কম খরচে দরিদ্রদের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করায়ও তার অবদান স্মরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পাওয়া জাফরুল্লাহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা ভূমিকা রেখে চলছিলেন। তবে এই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল তার।

খুবই সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী; কোনো দলে যুক্ত না হলেও রাজনীতি সচেতন এই ব্যক্তি বলতেন- “আমি মানুষের রাজনীতি করি।”স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের অধ্যায়ে তিনি নিজেই অনন্য এক ইতিহাস। নিভৃতচারী একজন দেশপ্রেমিকের নাম ডা. জাফরুল্লাহ। জনমভর যার মননে ছিল একটাই ভাবনা- দেশের কল্যাণ, দেশের মানুষের কল্যাণ। অর্জনের পাল্লা পাহাড়সম না হলেও এ দেশের মানুষের কাছ থেকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জয় করেছেন অকৃত্রিম ভালোবাসা।

লেখক :কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test