E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘মঙ্গল’ ‘পেঁচা’ এবং জাতির বিভক্ত!

২০২৩ এপ্রিল ১৬ ১৭:১৬:৫৮
‘মঙ্গল’ ‘পেঁচা’ এবং জাতির বিভক্ত!

রহিম আব্দুর রহিম


ফাত জালাল-উদ-দিন মুহাম্মদ আকবর যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে  আকবর দ্য গ্রেট নামে পরিচিত। তিনি ১৫৫৬ থেকে ১৬০৬ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। এই উপমহাদেশে কখন থেকে নববর্ষ শুরু হয় তার স্বচ্ছ প্রমাণাদি নেই। তবে সম্রাট আকবরের শাসনামলে ব্যবসায়ীরা 'হালখাতা' অর্থাৎ বকেয়া পরিশোধের মধ্য দিয়ে নববর্ষ  উদযাপন শুরু করেন। এবারও ১৪৩০ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন সকাল নয়টায় মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা  ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বের হয়ে চারুকলার পেছনের রাস্তা পরিক্রম করে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়। সীমিত আয়োজন হলে পুরো এলাকা  লোকারণ্য হয়ে ওঠে। ঢাক ঢোলের শব্দে নারী পুরুষ নাচতে থাকে এবং নববর্ষের দিনটি প্রাণময় করে তোলে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবার ডেমি ছিল শ্বেত কবুতর, দোয়ল পাখি, লক্ষী Study, হরিণ, হাতি, বাঘসহ নানা প্রতিকৃতি। স্লোগান ছিল "বৈশাখ দিচ্ছে ডাক মৌলবাদ নিপাত যাক।"   

দীর্ঘ ৫৬ বছর পর বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে দালিলিক পদক্ষেপে নেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি মো. মাহমুদুল হাসান।তিনি মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশ পাঠান সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু ও কারুকলা অনুষদের ডীন বরাবর। নোটিশে উল্লেখ করেন, "নোটিশ পাওয়ার পর, 'অসাংবিধানিক' বেআইনি ও কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করতে হবে।' অন্যথায় হাইকোর্ট রিট দায়ের করারও হুমকি দেন। তিনি প্রদর্শিত প্রাণির দৃশ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার তকমা খুঁজে পান, যে কারণে তা দন্ডবিধি ২৯৫/ক ধারায় অপরাধ শামিল বলে উল্লেখ করেন। তার এই নোটিশ জাতি গ্রহণ করে নি।ফলে মাহে রমজানেও মঙ্গল শোভাযাত্রার চরিত্রের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। পৃথিবীর সকল দেশেই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির স্বকীয়তা বজায় রাখতে সার্বজনীন উৎসব পালন করে এরমধ্যে ইতালির কার্নিভাল অফ ভেনিস, থাইল্যান্ডের সংক্রান, রাশিয়া হোয়াইট নাইটস, ফেসার্বিয়ার প্রস্থান, দক্ষিণ কোরিয়ার মাড, স্পেনের লা টোমাটিনা, গুয়াতেমালার সেমানা সান্তা, জাপানের ওবন, দক্ষিণ আফ্রিকার হারমানাস তিমি, কানাডার কুয়েবেক শীতকালীন কার্নিভাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্ডি গ্রাস, মরুর দেশের গৌরাঙ্গ আর পেরু দেশের স্নো স্টার উৎসব। এসমস্ত উৎসবগুলো কোনটা ধর্মীয়, আবার কোনটা মানব সমতায় হয়ে থাকে। কিন্তু অসম্প্রদায়িক চেতনা বহনকারী উৎসব পৃথিবীতে অন্যতম বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা।' যে কারণে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'জাতিসংঘ ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।

শোভাযাত্রায় 'পেঁচা'র প্রতিকৃতি, শোভাযাত্রার নামের আগে 'মঙ্গল' এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির সাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষরা বিতর্কের সৃষ্টি করছে। মূলত এর আভিধানিক অর্থ,ব্যাখ্যা কেউ খতিয়ে দেখে নি।বাংলা নববর্ষের প্রথম শোভাযাত্রা শুরু হয় যশোরের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে। পরে তা আস্তে আস্তে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার চারু ও কারুকলা বিভাগের শিল্পীরা শোভাযাত্রার নান্দনিক এবং অর্থবহ করে তুলতে মঙ্গল শোভাযাত্রায় 'পেঁচা'র প্রতিকৃতির সংযোজন আনেন।কারণ, বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশ কৃষিপ্রধান, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা যার মূল শিকড়, এই ভূভাগের পানি 'মিঠা বা 'সুস্বাদু,' ফলে এই অঞ্চলে ফসল বিনিষ্টকারী ইঁদুরের জন্ম। এই ইঁদুর নিশাচর।আহার করে রাতের আঁধারে ওই সময় ফসল নষ্টের উল্লাস চলে বাঁধাহীন। পেঁচাও তেমনি রাতে আহার করে। পেঁচার প্রধান খাদ্য ইঁদুর, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় পেঁচার ভূমিকা মঙ্গল সম। যে কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রায় পেঁচার প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা হয়। অর্থাৎ 'অন্ধকারে দুষ্টের দমনে পেঁচাই এনে দেবে সার্বিক কল্যাণ।' যার সার্বিক বিশ্লেষণ দাঁড়ায়,'সভ্যতার ভারসাম্য রক্ষায় অস্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হোক গোটা মানব সমাজে, তবেই মঙ্গল বা কল্যাণ বয়ে আসবে মানবের তরে।' 'মঙ্গল' শব্দটির আভিধানিক অর্থ কল্যাণ, যার আরবি শব্দ 'খায়ের (Khiar)' উর্দু শব্দ 'আচ্ছা'। এই মঙ্গল শব্দটির মধ্যে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী খুঁছে পেয়েছে হিন্দুয়ানী গন্ধ, আর পেঁচার মধ্যেই লক্ষ্মী দেবীর বাহন খুঁজে পাওয়ায়, জাতিকে ধর্মীয় আবেগে বিভক্ত করতে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। নববর্ষে উদযাপন নিয়ে কোন হক্কানী আলেম সমাজ আজ পর্যন্ত বিরূপ মনোভাব পোষণ করেনি, আনুষ্ঠানিক কোন বিরোধিতাও তারা দেখায় নি। বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে ঘিরে বারবার এক কাতারে মিলিত হয়েছেন, হচ্ছেন ।

১৩৭৪ সন তথা ১৯৬৭ সালে রমনা বটমূলে (অশত্থ) ছায়ানটের প্রথম বর্ষবরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় পাকিস্তানী শাসক আইয়ুব খান 'বৈশাখ' হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব আখ্যা দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার বীজ বপন করে। নিষিদ্ধ করা হয় রবীন্দ্র সঙ্গীত। অপ্রচার চালায় 'বাংলা' হিন্দুর ভাষা। 'উর্দু' মুসলমানের ভাষা।' ৬৭ এর আগেও ১৯৪৯ সালে বাংলা 'হিন্দু'র ভাষা এই তকমা ছড়িয়ে বাংলা বর্ণের সংস্কারের প্রস্তাব দেয় তৎকলীন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী। ১৯৫৬ সালে রোমান হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করে। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকার জন্য ১৯৬৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকসহ বেশ কিছু প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬২ সালেও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৩৭৫ সন তথা ১৯৬৮ সালেও বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের ঐক্যের ভূমিতে ফটল সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এগুলো হয়ে আসছে। উদ্ভুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য আমাদের গবেষণাহীন শিক্ষাব্যবস্থাই মূলত দায়ী। আমাদের উচিত, বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে বৃটিশদের অপ- কৌশল জাতি বিভক্তির প্রেসকিপশনে না গিলা। বাঙালির মঙ্গল শোভাযাত্রা আছে, থাকবেও অনাদিকাল।

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিক।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test