E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সকল রোগের জন্য শক্তিশালী প্রতিরোধক রসাল ফল আম

২০২৩ মে ২৩ ১৯:৩০:৫৬
সকল রোগের জন্য শক্তিশালী প্রতিরোধক রসাল ফল আম

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


চলছে মধু মাস জ্যৈষ্ঠ।মধু মাসের ফল আমের ঘ্রাণ এখন সর্বত্র। ফলের রাজা আম খেতে পছন্দ করেন না এমন বাঙালি পাওয়া খুব মুশকিল। রসাল ফল আম পুষ্টিগুণেও ষোলো আনা। মধু মাসে বিভিন্ন ফলের মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু এবং লোভনীয় ফল আম। আম পছন্দ করে না এমন ব্যক্তি পাওয়া খুব মুশকিল। ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, পটাশিয়াম, বিটা ক্যরোটিন, ম্যাগনেসিয়ামের মতো উপকারী উপাদানে ঠাসা এই ফল৷ তাই নানা শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ৷যদি প্রশ্ন করা হয়, বাঙালির ফলের মাস কোনটি? চোখ বুঁজে উত্তর দেওয়া যাবে যে রসের মাস, মধু মাস জ্যৈষ্ঠ মাস। বেশ গরম থাকায় এই সময়টাতে ঘরের বাইরে থাকা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এভাবেও বলা যায় যে, বাঙালির আনন্দ ফলে, গরমে নয়। তাই ফলের মাস জ্যৈষ্ঠ, রসের মাস জ্যৈষ্ঠ, মধু মাস জ্যৈষ্ঠ। আসুন জেনে নেওয়া যাক, আমের উপকারিতা, যে কারণে মধু মাস জ্যৈষ্ঠের মধুফল আম খাবেন।

বাংলাদেশ ঋতু-বৈচিত্র্যের দেশ । আবহমান কাল থেকে এদেশে ঋতু-বৈচিত্র্য বর্তমান ছিল, ছয়টি ঋতুর বৈশিষ্ট্য আলাদা আলাদাভাবে এই দেশে উপলব্ধ হয়; গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত -এই ছয় ঋতুর কারণে দেশটিকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়। মধু মাস মানে জ্যৈষ্ঠ-যখন আমের আগমন ঘটে।

আম এক প্রকারের সুস্বাদু ফল। কাঁচা অবস্থায় রং সবুজ এবং পাকা অবস্থায় হলুদ রং হয়ে থাকে। বাংলাদেশ যে প্রজাতির আম চাষ হয় তার বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা। এটি এনাকারদিয়াসি পরিবারের সদস্য। তবে পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ প্রজাতির আম আছে। আমের বিভিন্ন জাত আছে যেমন ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরসা, আম্রপালি ইত্যাদি।

আম গাছ এখন বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ যদিও আম জাতীয় ফল না। ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর আম গাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

আমে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ বা ক্যারোটিন, ভিটামিন ‘সি, খনিজ পদার্থ ও ক্যালোরি রয়েছে । ভিটামিন ‘এ’ এর দিক থেকে আমের স্থান পৃথিবীর প্রায় সব ফলেরই উপরে । ইউএসডিএ পুষ্টি ডেটাবেস।অনুসারে প্রতি ১০০ গ্রাম (৩.৫ আউন্স) আমে ৬০ কিলোকালরি শক্তি পাওয়া যায়। শর্করা (১৫ গ্রাম), স্নেহ পদার্থ (০.৩৮ গ্রাম), প্রোটিন ০.৮২ গ্রাম) এবং বিভিন্ন প্রকারের ভিটামিনের সাথে থাকে চিহ্ন ধাতু।

আমের উপকারিতা

এখন প্রশ্ন হল,আম কেন খাবেন? কারণ, এটি একটি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ফল যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন অস্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে কাজ করে, আমের উপকারিতা ব্যাপক। যেমন-

কর্মশক্তি বৃদ্ধি

আমে রয়েছে প্রচুর কার্বোহাইড্রেট, যা কর্মশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পরিমিত পরিমাণ আম শরীরে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা যদি ৫-৬টি আম পাতা ধুয়ে একটি পাত্রে সেদ্ধ করে নিয়ে সারারাত রেখে সকালে এর ক্বাথ ছেকে নিয়ে পান করে করেন তাহলে এটা ইন্সুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেন। এছাড়া, এই ফলে রয়েছে উচ্চ মাত্রার গ্লুটামাইন এসিড নামক প্রোটিন যা মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মর্নিং সিকনেস দূরীকরণ

কাঁচা আম গর্ভাবস্থার উপসর্গের তীব্রতা কমাতে এবং ঘন ঘন মর্নিং সিকনেস হওয়ার প্রবণতা কমাতে সাহায্য করে । নিয়মিত কাঁচা আম খেলে মর্নিং সিকনেস পুরোপুরি দূর হয়।

স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধে

আম থেকে ভিটামিন সি পাওয়া যায় যা স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। দাঁত, মাড়ি, ত্বক ও হাড়ের সুস্থতা রক্ষা করতেও সাহায্য করে ভিটামিন ‘সি’। এছাড়া, আমে ভিটামিন ‘সি’ ‘এ’ এবং বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২৫টি ক্যারোটিনয়েড রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

চোখের যত্নে

আমে রয়েছে প্রচুর ক্যারোটিন যা চোখ সুস্থ রাখে, সর্দি-কাশিও দূর করে। শুধুমাত্র এক কাপ পাকা আম খেয়ে সারাদিনের ভিটামিন এর চাহিদার ২৫% পূরণ করা সম্ভব। এটা দৃষ্টিশক্তিকে উন্নত করতে সাহায্য করে, চোখের শুষ্কতা ও রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে।

হজমে সহায়ক

আম একটি প্রিবায়োটিক ফল, যা আমাদের পাকস্থলীর বিভিন্ন গাট ব্যাক্টেরিয়ার জন্য উপকারী। ৩/৪ কাপ আমে থাকে ডায়েটারি ফাইবারের প্রায় ৭%। যা হজম ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

ঘুমে সহায়ক

আমে আছে ট্রিপটোফ্যান, মেলাটোনিন, ও ম্যাগনেসিয়াম যা আমাদের ঘুমকে ত্বরান্বিত করে। অনিদ্রা দূর করে।

ওজন কমায় আম : আমে আছে বিভিন্ন রকম পুষ্টি উপাদান। তাই একটি আম খেলেই সারা দিনের ভিটামিনের চাহিদা মিটে যায়। আবার এতে থাকা ফাইবার হজমে সহায়তা করে। তাই ওজন কমাতে আম খেতে পারেন।

হিট স্ট্রোক ঠেকাবে : এই গরমে হিট স্ট্রোক সাধারণ ঘটনা। আম আমাদের ভেতরটা শীতল রাখে ও শরীরকে অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচায়।

হাড় গঠনে

আমে রয়েছে ক্যালসিয়াম, যা হাড় গঠনে সাহায্য করে। সুতরাং প্রতিটি মানুষের আম খাওয়া প্রয়োজন। তাহলে হাড় ও দাঁত সুস্থ থাকবে।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ এবং হজমে সাহায্য করে

আম প্রচুর খাদ্য আঁশ, ভিটামিন ও খনিজে ভরপুর। আম উচ্চ আঁশযুক্ত হওয়ায় তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। এটা হজমের জন্য ভালো এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। তাই যাদের হজমের সমস্যা আছে, তারা আম খেলে অনেক উপকার পাবেন।

কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, হৃদযন্ত্রের সুরক্ষায়

আমে থাকা উচ্চমাত্রার ভিটামিন ‘সি’, পেকটিন ও আঁশ কোলেস্টেরলের ক্ষতিকর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। আম পটাশিয়ামের খুব ভালো উৎস যা উচ্চ রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ঘামের কারণে শরীর থেকে সোডিয়াম বের হয়ে যায়। আর, কাঁচাআম শরীরের সেই সোডিয়ামের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। কাঁচাআমের পেকটিন গ্যাস্ট্রোইন টেস্টাইনাল রোগের চিকিৎসায়ও অত্যন্ত উপকারী। আমে উচ্চ আঁশ ও এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় তা হৃদরোগের সম্ভাবনাকে কমায় এবং এর বিদ্যমান পটাশিয়াম রক্তস্বল্পতা দূর করে ও হৃদযন্ত্র সচল রাখতে সাহায্য করে।

ক্যান্সার প্রতিরোধ

আম ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করে। গবেষকরা বলেছেন যে, আমে এন্টিঅক্সিডেন্ট ও উচ্চ পরিমাণ খাদ্য আঁশ থাকার কারণে এটা কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, রক্তস্বল্পতা, লিউকেমিয়া ও প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও ক্যারোটিন, আইসো-কেরোটিন, এস্ট্রাগ্যালিন, ফিসেটিন, গ্যালিক এসিড ইত্যাদি এনজাইম ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

তারুণ্য ধরে রাখতে

আমে থাকা ভিটামিন ‘সি’ কোলাজেনের উৎপাদনে সাহায্য করে যার ফলে ত্বক সতেজ ও টানটান হয়। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘ই’ যা ত্বক ও চুলের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এছাড়া, ভিটামিন ‘ই’ থাকাতে এটা সেক্স হরমোনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

আমের এত গুণ! তবে সাবধান! আজকাল বাজারের টসটসে আমের প্রায় সবই কার্বাইড নামক বিষ প্রয়োগ করে পাকানো হচ্ছে। কারণ, আম অত্যন্ত পচনশীল একটি ফল। ফরমালিনসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মিশিয়ে ব্যবসায়ীরা এ ফল ৬ থেকে ৭ মাস পর্যন্ত রেখে দিতে পারে। তাই বলে আম খাব না তা কী করে হয়! আর এ জন্য আস্থা রাখতে পারেন খাস ফুডের উপর।
আম খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা

* আম ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে, পরিষ্কার পাত্রে নিয়ে খেতে হবে।

* আম খাওয়ার সময় এর সঙ্গে অতিরক্ত লবণ ও মরিচ মেশানো যাবে না। এতে পুষ্টিগুণ নষ্ট হবে।

* আম খাওয়ার পরপরই পানি খাওয়া যাবে না।

* অতিরিক্ত আম খেলে হজমে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, আম যেমন শরীরের উপকার করে তেমনি অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে তা শরীরের ক্ষতিকর প্রভাব ও ফেলে।পাকা আমে চিনির পরিমাণ বেশি থাকে। ফলেই যাদের ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে, তাঁরা একেবারেই দূরে থাকুন আমের থেকে। কেননা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে আম।আর যারা অ্যাজমাতে ভুগছেন তাঁরা প্রয়োজনে কম খান আম। কিডনির সমস্যা যাদের রয়েছে তাঁদের পক্ষেও বেশি আম খাওয়া উচিত নয়।পাকা আম অতিরিক্ত খেলে ওজন বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে রক্তে শর্করার পরিমাণ। তাই সব কিছুই সীমিত পরিমাণে খাওয়া ভালো।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test