E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্মরণ  

বঙ্গবন্ধুর ‘পাগলা সিরাজ’ই ছিলেন উত্তরবঙ্গের বাঘ!

২০২৩ জুন ০২ ১৬:২৬:৪৩
বঙ্গবন্ধুর ‘পাগলা সিরাজ’ই ছিলেন উত্তরবঙ্গের বাঘ!

রহিম আব্দুর রহিম


পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রাণপুরুষ মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ১৯৯৭ সালের ২জুন মৃত্যু বরণ করেন। প্রয়াত সিরাজুল ইসলাম জীবনদশায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পঞ্চগড় জেলা শাখার সভাপতি, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রথম আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। এই সেই রাজনীতিবিদ যিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দক্ষ সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধকালীন ৬ (ক) সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহচর, দেশ স্বাধীন হবার পর জাতীয় সংসদের চার বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁরই কনিষ্ঠ ভাই অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন, বর্তমান সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী।

মরহুম অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর (বর্তমান পঞ্চগড়) জেলার বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী ইউনিয়নের মহাজন পাড়ায় এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। স্কুল শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত সিরাজুল তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিটি সংগ্রাম আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নেন। '৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬'র ছয় দফা এবং সর্বোপরি ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ছাত্র রাজনীতির যৌবনকালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা ছাত্রলীগের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পান।একই সময়ই তিনি রাজশাহী বিভাগীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যিনি পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু)র সহ-সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হবার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পঞ্চগড় থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে ৬নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা হিসেবে সমরযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।যুদ্ধকালীন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায়, ওই সময় তেঁতুলিয়া অঞ্চলটি পাক-হানাদার মুক্ত থাকে। তাঁর এই অনন্য ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চগড়ের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।অঞ্চলটিকে নিয়ে ইতিহাসে বাক্য বিন্যাস হয়েছে, "মুক্তাঞ্চলের তীর্থভূমি, "পরবর্তীতে যে অঞ্চলটি বিশ্বের কাছে এই বিশেষণেই পরিচিতি হয়ে উঠে। বীরসেনানী সিরাজুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬ সালে পঞ্চগড়ের সংসদীয় আসন এক (১) এবং সংসদীয় আসন দুই (২) থেকে পর পর ৪ বার জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচীর ডাকে সাড়া দিয়ে তৎকালীন বাকশালের ঠাকুরগাঁও জেলার সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। যিনি আমৃত্যু পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। জনশ্রুতি মরহুম সিরাজুল ইসলাম জীবনদশায় সর্বমহলে 'উত্তরবঙ্গের বাঘ' বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ২৩তম মৃত্যু বার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পঞ্চগড় জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও লেখক মো. আরিফুল ইসলাম পল্লব আবেগঘণ স্মৃতিচারণ করে বলেন, "আওয়ামী লীগের মরহুম আব্বাস আলী, ছাত্রলীগ নেতা আজহারুল ইসলাম বুলেট, আবু সারোয়ার বকুল এঁর নেতৃত্বে আবুল কালাম আজাদ বাবুল, জাহাঙ্গীর আলম বাবুল, মনিরুল হক মনির, রবিউল ইসলাম চানু, র.ই লিয়ন, আহসান হাবিব, বেলাল হোসেন, মকাদ্দেছ, রিজু, আজাদ, আজিম পাটোয়ারী নুতন, রবিউল ইসলামসহ আরও অসংখ্য ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রয়াত নেতা সিরাজুল ইসলামের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, দুরদর্শী নিদর্শনা পেয়েছেন।জাতীয়, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর যে বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎবাণী, পরবর্তীতে আমাদের চোখের সম্মুখে তা দৃশ্যমান হতে দেখেছি।" তিনি নেতার রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার বিষয়ে আরও বলেন, "ময়দানদিঘী'র 'বেলতলা' কাঠের চেয়ার-টেবিল, ছোট্ট একখানা কাঁচা ঘরে চটের ঝুলানো পর্দা, যার পরিচর্যায় নিয়োজিত ফয়জুল চাচা, সবই যেনো জ্বলজ্বল করে চোখে ভাসছে।" সদাহাস্যোজ্বল কর্মীবান্ধব এই নেতা ছিলেন পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের, প্রফুল্ল মনের রসিকজন বটে।

এ বিষয় স্পষ্ট করতে পল্লব বলেন, "কোন একদিন বোদা আওয়ামী লীগ নেতা, সিরাজুল দাদুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু দীনেশ কাকাকে বললেন, 'আচ্ছা দীনেশ তুই তো হিন্দু।' কাকা অমনি উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, 'না আমি বাঙালি!' দাদু (সিরাজুল ইসলাম) তখন হো হো করে হেসে উঠলেন, দেবীগঞ্জের সপিকুল ইসলাম, গিয়াস চৌধুরী, রবিউল ইসলাম চানু, বোদার মনিরুল কাদের , সুলতান প্রধান, ইউসুফ আলী, তেঁতুলিয়ার আব্দুর জব্বার, ইয়াসিন মণ্ডল, আটোয়ারির বাশার, কাসেম আলী, বেংহারী ইউনিয়নের আবুসহ অসংখ্য নেতাকর্মীদের আনাগোনা ছিল ময়দানদিঘী'র বেলতলায়।"

তিনি চলনে বলনে, আচার -আচরণে একজন রাজনৈতিক গুরু হিসেবে নেতাকর্মীদের মাঝে আবির্ভূত হয়েছেন এমন উদাহরণ দিতে গিয়ে পল্লব উল্লেখ করেন,"মুড়ি-চানাচুর মাখানো, গুড়ের জিলাপি আর চায়ের চুমুকে কত যে কথা, সারগর্ভ আলোচনা। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শুদ্ধ স্নানে উদ্দীপ্ত হবার যে কর্মী প্রশিক্ষণ তিনি দিয়ে গেছেন, তা অবিস্মরণীয়! তাঁর দেয়া দীক্ষা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সারাজীবনের অমূল্য সম্পদ।"

এই নেতাকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্নেহভরে বলতেন, 'আমার পাগলা সিরাজ!'অদম্য সাহস ও মনোবল নিয়ে উত্তরবঙ্গ হতে সারা বাংলাদেশ ব্যাপী দুঃসাহসিক বক্তব্য ও স্পষ্টবাদী বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি 'উত্তরবাংলার বাঘ' বিশেষণে মানুষের মনে প্রাণে জায়গা করে নিয়েছিলেন। উচ্চ মার্গীয় একজন নেতা হওয়া সত্বেও তিনি ছিলেন সাদামাটা, যাঁর মাঝে কোন অহংকার ছিল না। পরোপকারী এই ব্যক্তি ছিলেন দলমতের উর্ধ্বে থাকা বিপদাগ্রস্ত মানুষদের পরম বন্ধু।

তাঁর সম্মান ও স্মৃতি ধরে রাখতে এলাকায় 'পঞ্চগড় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলস্টেশন,' 'বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেডিয়াম, 'সাবেক ছিটমহলের 'পুঠিমারী'গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ওই গ্রামের বসতিরা গ্রামের নামকরণ করেন 'বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম নগর, 'এছাড়াও নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়টির নাম করণ হয়েছে এলাকার একসময়কার জনপ্রিয় নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের নামানুসারে। প্রয়াত এই নেতা ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। মারা যান ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ২জুন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর, এবছর (২০২৩) তাঁর ২৩তম মৃত্যু বার্ষিকী অতিক্রান্ত হলো।

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশুসাহিত্যিক।

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test