E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

খুলনায় বঙ্কিম : প্রশাসক বঙ্কিম

২০২৩ জুন ১৫ ১৬:২২:৩৮
খুলনায় বঙ্কিম : প্রশাসক বঙ্কিম

বিশ্বজিৎ বসু


বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়! বাংলার মানুষ তাকে বলে সাহিত্য সম্রাট। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী লিখে তিনি অমর হয়ে আছেন বাঙালি র হৃদয়ে। বাংলা সাহিত্যে যতদিন পৃথিবীতে টিকে থাকবে বঙ্কিমচন্দ্র ততদিন অমর হয়ে থাকবেন এই পৃথিবীর মাটিতে এবং সেটা শুধু এই দুর্গেশনন্দিনীর লেখার কারণে।

সাহিত্য সেবকের পাশাপাশি বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন একজন তেজি, সাহসী দক্ষ প্রশাসক। কিন্তু তাঁর সাহিত্যচ্ছটায় ঢাকা পরে গেছে তাঁর প্রশাসনিক সেই দক্ষতা আর প্রতিভা। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনিকার তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শচিশচন্দ্র লিখিত বঙ্কিম জীবনি হতে জানা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ভারতের প্রথম বিএ পাশ।তিনি হুগলি কলেজে থেকে সিনিয়র স্কলারশিপ পেয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।

১৮৫৮ সালে বৃটিশ সরকার বিএ পরীক্ষা প্রবর্তন করে তারিখ ঘোষণা করে।এর আগে জুনিয়র স্কলারশিপ এবং সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল। যখন সরকার পরীক্ষা ঘোষণা করে তখন থেকে পরীক্ষার মাত্র তিন মাস বাকি। বঙ্কিমচন্দ্রসহ মাত্র ১৩ জন ছাত্র সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। পরীক্ষায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম এবং যদুনাথ বসু দ্বিতীয় হয় এবং দুজনই দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে। পরীক্ষায় সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পরীক্ষক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁরা ছয়টি বিষয়ের মধ্যে পাঁচটিতে পাশ করে, একটি বিষয়ে পাশ মার্কের চেয়ে কম পায়। তৎকালীন সময়ের নিয়ম অনুযায়ী পাশ মার্কের চেয়ে প্রাপ্ত মার্ক সাতের কম ব্যবধান থাকায় তাঁদেরকে গ্রেস দিয়ে ষষ্ঠ বিষয়ে পাশ করানো হয়।

পাশ করার পর ছোট লাট হ্যালিডে বঙ্কিমচন্দ্র কে ডেকে নিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিতে যোগদানের প্রস্তাব দেয়। বাবা তাকে এপদে যোগদান করতে নির্দেশ দেয়। বাবার নির্দেশে তিনি যোগদান করেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে।

প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্রের পোস্টিং হয় যশোরে। যশোরে থাকাকালীন সময়ে তাঁর স্ত্রী মৃত্যু বরণ করেন। এখানে কিছুদিন কাজ করার পর বদলী হয়ে মেদিনীপুর যান। মেদিনীপুর থাকাকালীন সময়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ১৮৬০ সালের নভেম্বরে তিনি মেদিনীপুর থেকে পুনরায় বদলী হয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীসহ খুলনায় যান। খুলনা তখন যশোহর জেলার একটি মহাকুমা।

খুলনা তখন ছিল একটি অশান্ত জনপদ। একদিকে ছিল নীলকর জমিদারদের অত্যাচার অন্যদিকে চোর ডাকাত আর জলদস্যুদের উৎপাত। নীলকরেরা তখন ব্যবসাদার এবং জমিদার। এরা এত শক্তিশালী ছিল যে তাদেরকে বলা হতো" অলিখিত পর্লামেন্ট"। এরা দেশের কোন আইন তোয়াক্কা করতো না। কর আদায়, নীল চাষের প্রয়োজনে প্রজার সম্পদ লুট, ঘরে আগুন লাগানো, তাদের বাড়ির নারীদের ওপর অত্যাচার, হত্যা করা ছিল দৈনন্দিন ব্যাপার। নির্দেশ না মানলে পুরুষদের ধরে এনে নিজেদের তৈরি কারাগারে কয়েদ করে রাখতো, দাবী আদায়ে প্রজাদের চাবুক দিয়ে পেটাতো, খাবার হিসাবে একসের ধান দিত কয়েদিদের। কয়েদিরা সারাদিন সেই ধানের খোসা ছাড়িয়ে রাখত আর রাতে সেই চাল চিবিয়ে খেত। সারাদিনে এটাই ছিল তার একমাত্র খাবার।

এমন সময়ে এ অত্যাচার তুলে ধরে দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন ঐতিহাসিক নাটক "নীল দর্পণ"। এ নাটকটি বাঙালির স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সূচনা করে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও কৃষকদের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন স্থাপিত হয়।

সিপাহী বিদ্রোহের রেশ তখনও কাটে নাই। নদীয়া জেলার চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস এবং দিগম্বর বিশ্বাস স্বেচ্ছায় নীলকরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নীল বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে দেয়। বরিশালের বিখ্যাত লাঠিয়ালরা এসে বিদ্রোহে যোগ দেয়। বাংলার সব নীল আবাদী এলাকায় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালিরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নীলকর সাহেব, তাদের গোমস্থা, আমিনদের যাকে যেখানে সেখানে পেটাতে শুরু করে।

১৮৬১ সালের ৯ জুলাই নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদের অপরাধে লংয়ের কারাগার এবং জরিমানা করে আদালত। এতে নীল কর সাহেবদের শক্তি আরো বেড়ে যায়। তারা সরকারের কাছে অনুযোগ করে, "নদীয়া এবং যশোহর জেলার প্রজারা খাজনা দিচ্ছে না"। খাজনা যাতে আদায় হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে তারা দাবি জানায়। সরকার মরিস এবং মন্ট্রেসারকে দিয়ে একটি কমিশন গঠন করে। কমিশন রিপোর্ট প্রদান করে "নীলকরেরা নির্দোষ, তারা প্রজাদের উপর কোন অত্যাচার করে না। সব দোষ প্রজাদের, প্রজারা খাজনা দেয় না"।

খুলনার মরেলগঞ্জের প্রধান মরেল। নিজে এই জনপদের পত্তন করে নাম রেখেছেন মরেলগঞ্জে। সময়ের বিবর্তনে সে এলাকার নাম এখন মোড়লগজ্ঞ। মরেলের নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। তারা লাঠির সাথে সড়কি বন্দুকও রাখত।

১৮৬১ সালের ২৬ নভেম্বর ভোরে মরেলের লাঠিয়াল বাহিনী প্রজা শায়েস্তা করতে আক্রমণ করে সেখানকার বড়খালী গ্রামে। বড়খালী গ্রামের মানুষ তখন ঘোষণা দিয়েছে "গলা কাটিয়া ফেলিলেও খাজনা দেবনা"।

বড়খালী গ্রামের রহিমুল্লাহ পাঠানের নেতৃত্বে গ্রামবাসী প্রতিরোধে নেমে পড়ে। রহিমুল্লা পাঠান ছিলো এই গ্রামের মাতব্বর। প্রতিরোধের এক পর্যায়ে মরেলের লাঠিয়াল প্রধান হিলির গুলিতে রহিম পাঠান নিহত হয়।

বঙ্কিমচন্দ্র আগেই খবর পেয়েছিলেন মরেলের লোক দাঙ্গা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সরুলিয়াগ্রামে হামলা করবে। মরেল সেরকম প্রচার করে প্রশাসন কে বিভ্রান্ত করে। সেখানে আগেই পুলিশ পাঠিয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র। তখনকার দিনে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণে কাজ করতো। কিন্তু ওরা হামলা করে বড়খালী গ্রামে।

রহিমুল্লাহর মৃত্যুর পর গ্রামের মানুষ পালিয়ে যায়। হিলি গ্রাম লুটপাট, নারীদের ওপর অত্যাচার শেষে গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং রহিমুল্লাহর মৃতদেহ গায়েব করে ফেলে।
বঙ্কিমচন্দ্র নিজে পুলিশসহ বড়খালী গ্রামে গিয়ে তদন্ত করে আসামিদের নামে ওয়ারেন্ট জারি করেন এবং মামলা যশোহরে পাঠিয়ে দেন। নিজে তদন্তকারী বিধায় সে মামলার বিচার করার এখতিয়ার তাঁর ছিল না।

সে সময়ে নীলকরদের অত্যাচার এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে ১৮৬২ সালে তৎকালীন ইংরেজি পত্রিকা Friend of India লিখেছিল ,"The planter- detained law, courts and police, like Englishman all over the world become a law into himself." এই মামলা চলাকালীন সময়ে এক সেটেলার ইংরেজ বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে দেখা করতে আসে। তার এক পকেটে ছিল রিভলবার এবং এক পকেটে এক লক্ষ টাকা। সে বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে জানতে চায়, তুমি কোনটা চাও টাকা না মৃত্যু।

বঙ্কিমচন্দ্র বললেন আমি আমার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে এসে তোমাকে জানাই। ভিতরে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ভৃত্যদের ডাকাডাকি করা শুরু করে। ভয়ে সে ইংরেজ পালিয়ে যায়। এরপর প্রচার হয়ে যায় বঙ্কিমচন্দ্রকে হত্যা করতে পারলে ১ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্তু কে পুরস্কার দিবে, কারা ঘোষণা দিল কোন ক্লু পাওয়া যায় না। এসময় মরেলের লোকজন বঙ্কিমচন্দ্রের পেশকারকে অপহরণ করে। তাকে উদ্ধার করতে বঙ্কিমচন্দ্রকে কঠোর হয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে এবং পেশকারকে উদ্ধার করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের কঠোর অবস্থানে টিকতে না পেরে মরেলইংল্যান্ডে পালিয়েযায়।

তার লাঠিয়াল প্রধান হিলি নাম পাল্টে আত্মগোপন করে। কিন্তু পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। জাহাজে করে পালিয়ে যাবার প্রস্তুতির সময় মুম্বাই থেকে ছদ্মবেশ অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে। নীল করেরা এত শক্তিশালী ছিল যে অত্যাচার দমন করা সহজ কাজ ছিল না। তারা কতখানি শক্তিশালী ছিল যে তারা লাট সাহেবকেও পাত্তা দিতনা। তাদের ধৃষ্টতা এতো বেশী বেড়ে গিয়েছিল যে, সে সময়ে ম্যাক আর্থার নামে এক নীলকর ছোট লাটের নামে মানহানী মামলাও করেছিল এবং সে মামলায় হাইকোর্ট ছোট লাটকে ১ টাকা অর্থদণ্ডও করেছিল।

বঙ্কিমচন্দ্রের শক্ত অবস্থান এবং নিখুঁত তদন্ত রিপোর্টের ফলে মরেলের লাঠিয়াল দৌলত চৌকিদারের ফাঁসি হয়। চৌত্রিশ জন আসামির দ্বীপান্তর হয়। ছদ্মবেশী হিলিকে সাক্ষিরা চিহ্নিত করতে না পারায় এবং রহিমুল্লাহর লাশ না পাওয়ায় হাইকোর্ট থেকে সে মুক্তি পায়। বঙ্কিমচন্দ্রের তেজ এবং কঠোর পদক্ষেপে শক্তিশালী নীলকরদের অত্যাচার এবং জলদস্যুর উৎপাত বন্ধ হয়ে খুলনা একটি শান্ত জনপদে পরিণত হয়। এ মামলার পর খুশি হয়ে কর্তৃপক্ষ বঙ্কিমচন্দ্রের ১০০ টাকা বেতন বৃদ্ধিসহ পঞ্চম গ্রেড থেকে চতুর্থ গ্রেডে প্রোমশন দিয়েছিল। চার বছর দুই মাস চাকরির বয়সে এটা ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় প্রমোশন।

১৮৬৪ সালের মার্চ মাসে বঙ্কিমচন্দ্র বদলী হয়ে বারুইপুরে যান। খুলনায় আসে এক বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট। তাকে সহায়তা করার জন্য নিয়োগ দেয়া হয় আরেকজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। যে কাজ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র একা করতেন তা করার জন্য দুজন নিয়োগ দেয়া হয়। এত কাজের মধ্যেও খুলনায় বসে বঙ্কিমচন্দ্র লিখে ফেলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস " দুর্গেশনন্দিনী"। তখন প্রেসে যাবার পর একটি বই প্রকাশিত হতে প্রায় এক বছর সময় লেগে যেত। ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসে "দুর্গেশনন্দিনী" বই আকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিলেন গুরুদাস চট্টপাধ্যায় এন্ড সন্স্।মূল্য ছিল ২ টাকা। তথ্য সুত্রঃ বঙ্কিম জীবনি, শচিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশ কাল: ১৩১৮ বাংলা।

লেখক : প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

০৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test