E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুইডেনে ফের কোরআন অবমাননা

ইসলামের দৃষ্টিতে কোরআন অবমাননা শাস্তিযোগ্য অপরাধ 

২০২৩ জুলাই ০৭ ১৭:৪৩:২৩
ইসলামের দৃষ্টিতে কোরআন অবমাননা শাস্তিযোগ্য অপরাধ 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


সম্প্রতি সুইডেনে আবারও কোরআন পোড়ানোর মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। আল্লাহর কিতাবের এ অবমাননার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে মুসলিম বিশ্ব।ইউরোপের শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে খ্যাতি আছে সুইডেনের। কিন্তু প্রায়ই দেশটিতে ইসলাম ধর্মের অবমাননার ছাপ পাওয়া যায়। গত বুধবার (২৮ জুন ২০২৩) পবিত্র ঈদুল আজহার দিনে আবারো দেশটির রাজধানী স্টকহোমের একটি মসজিদের বাইরে এমন ঘটনা ঘটান এক ব্যক্তি। এরপর আবারও বিশ্বের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়ে সুইডেন। স্টকহোম পুলিশ অনুমোদিত একটি বিক্ষোভ মিছিলের সময় এক ব্যক্তি এটি করেছিল। পরে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো সংগঠন ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা-ওআইসি এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপের দাবি জানালে সুইডিশ সরকার মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন পোড়ানোর মতো ইসলাম বিদ্বেষী ঘটনার নিন্দা জানায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। তারা এই ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে সুইডিশ সরকারকে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানায়। তবে সবচেয়ে কড়া প্রতিবাদ জানায় মরক্কো। দেশটি সুইডেনে নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়। প্রায় একই ধরনের কাজ করে ইরান। সুইডেনে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের যোগদান আটকে দেয় দেশটি। স্টকহোমে কোরআন পোড়ানোর ঘটনার পরপরই এর প্রতিবাদে ইরাকিরা বাগদাদে সুইডিশ দূতাবাসে ভাঙচুর চালায়।

এই ঘটনার প্রতিবাদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বলেন, ‘মুসলমানদের পবিত্র মূল্যবোধকে অপমান করা যে, বাক স্বাধীনতা নয় তা আমরা পশ্চিমা উদ্ধত জনগণকে ভালো করে শিখিয়ে দেবো।’সুইডেনে পবিত্র কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, সুইডেনে কোরআন শরিফ পোড়ানোর ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকায় সে দেশের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স-সিএডিকে ডেকে নিন্দা ও জড়িত ব্যক্তির শাস্তির দাবি করা হয়েছে। ৪ জুন মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধিতে দেওয়া বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা জানান।

আর বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এরকম ঘটনা এটিই প্রথম নয়। দেশটি মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন অবমাননার জন্য বিশ্বজুড়ে বারবার খবরের শিরোনামে এসেছে। সুইডিশ রাজধানী স্টকহোমের প্রধান মসজিদের সামনে ঈদুল আজহার দিনে প্রকাশ্যে কোরআন যিনি আগুন দিলেন, তিনি এক ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্যক্তি। তার নাম সালওয়ান মোমিকা। তিনি পাঁচ বছর আগে অভিবাসী হিসেবে সুইডেনে আসেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন এখন তার সুইডিশ পাসপোর্ট রয়েছে।সুইডেনের গণমাধ্যম এর বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, তিনি নিজেকে একজন নাস্তিক বলে দাবি করেন। তার ভাষ্য, পশ্চিমা সমাজের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং নারী অধিকারের মতো বিষয়গুলোর সাথে কোরআন সাংঘর্ষিক এবং তাই এটা নিষিদ্ধ করা উচিত।

কিন্তু সুইডেনে প্রকাশ্যে কোরআনের অবমাননার কাজটি তিনিই প্রথম করেননি। এরও আগেও বেশ কয়েকবার সুইডেনে কোরআন পোড়ানো হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে মালমো শহরে স্ট্রাম কুর্স নামের একটি কট্টর ডানপন্থী সংগঠন কোরআন শরিফ পোড়ায় এবং এর জেরে সে দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ চলে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডেনমার্ক ও সুইডেনের কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল স্ট্রাম কুর্স অভিবাসন-বিরোধী ও ইসলাম-বিদ্বেষী বলে পরিচিত। সংগঠনটির নেতৃত্বে রয়েছেন রাসমুস পালুদান নামের একজন উগ্রপন্থী। চলতি বছর জানুয়ারিতে এবং ২০২০ সালেও সুইডেনে একই রকম ঘটনা ঘটেছে।সুইডিশদের সাথে ইসলামের প্রথম পরিচয় হয় ১৬শ-১৭শ শতকে, যখন দেশটি সামরিক শক্তি অর্জন করছিল। সুইডিশ সাম্রাজ্যের প্রসারের সাথে সাথে তার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিও চরম আকার ধারণ করে। সুইডিশরা যদিও মূলত ক্যাথলিক ছিলেন, কিন্তু ১৬শ শতকে দেশটি একটি লুথেরান প্রটেস্টান্ট দেশে পরিণত হয়। ১৬৬৫ সালে সুইডিশরা তার পিতৃপুরুষের ধর্মমতকে বেআইনি ঘোষণা করেন।

বিবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সে সময় ক্যাথলিক ও মুসলমানদের 'প্রকৃত খ্রিস্টান ধর্মের' শত্রু হিসেবে দেখা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথে সুইডেনে উদারনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। দেশটি পরিচালিত হয় ধর্মনিরপেক্ষ আইনের আওতায়।৪০ বছর বয়সী রাজনীতিক ও আইনজীবী পালুডান মুসলিম ও অভিবাসনবিরোধী এজেন্ডা নিয়ে ২০১৭ সালে তার কট্টরপন্থী দল স্ট্রাম কুর্স প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকেই দলটি সুইডেনে ইসলাম নিষিদ্ধ ও পশ্চিমা নয়, এমন লোকজনকে বিতাড়িত করার পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আসছে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এক ভিডিও বার্তায় রাসমুস বলেন, ‘ইসলাম ও মুসলিমরা হচ্ছে আমাদের শত্রু। এই পৃথিবীতে যদি একজন মুসলিমও না থাকেন, তাহলে খুব ভালো হবে। তাহলে আমরা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাব।’

সুইডেনের ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় স্ট্রাম কুর্স। কিন্তু একটি আসনেও জয় পায়নি।

ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘এখনই কোরআন পোড়ানোর উপযুক্ত সময়।’ সেই সঙ্গে ঘোষণা দেন, এবার তারা পবিত্র গ্রন্থের ওপর ‘শূকরের রক্ত’ ঢালবে।

রাসমুসের এ ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে রাজধানী স্টকহোমসহ সুইডেনের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু হয় এবং এখনও তা অব্যাহত। পবিত্র কোরআন পোড়ানো ও মৃসলিমদের অবমাননা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে আসছে বিক্ষোভকারীরা।

পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থই নিজ নিজ অনুসারীদের কাছে অতি মর্যাদা ও সম্মানের বস্তু। তাই ধর্মগ্রন্থ অবমাননা সব ধর্মে নিন্দনীয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পঠিত ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন। ইসলাম ধর্মে কোরআন অবমাননা ও অমর্যাদা মারাত্মক অপরাধ ও চরম সীমা লঙ্ঘন।

পবিত্র কোরআন মুসলিম জাতির মর্যাদার চাবিকাঠি। কোরআনের সঙ্গে যুগে যুগে যে-ই সংশ্লিষ্ট হয়েছেন, আল্লাহ তারই মর্যাদা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) পবিত্র কুরআনের বার্তা বহন করেছেন। এর ফলে আল্লাহ তাকে ফেরেশতাদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান করেছেন। হযরত মোহাম্মদের (স.)-এর ওপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যার ফলে তিনি তার পূর্ব ও পরের সব মানুষ, এমনকি নবীদেরও নেতায় পরিণত হয়েছেন।

পবিত্র কোরআন আল্লাহ তায়ালার চিরসত্য বাণী। সুতরাং যারাই কোরআন অবমাননায় অংশ নিয়েছেন বা নেবেন তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে চরম দুর্ভোগ ও ভয়াবহ শাস্তি। যেমনটা কোরআনে বলা হয়েছে, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী মহাপাপীর, যে আল্লাহর আয়াতের তেলাওয়াত শোনে অথচ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে (নিজ মতবাদে) অটল থাকে। যেন সে তা শোনেইনি। সুতরাং তাকে ভয়াবহ শাস্তির সুসংবাদ দাও। ’ (সুরা : জাসিয়া, আয়াত : ৭-৮)

মহান আল্লাহ মানবজাতি সৃষ্টি করে সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদা দিয়েছেন। আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব যদি তার আসল মালিককে ভুলে যায় এবং তার আদেশ-নিষেধ অমান্য করে, তাহলে তার মালিক তার প্রতি শুধু অসন্তুষ্টই হন না, বরং তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য হন। তবে আল্লাহ যেহেতু অতিশয় মেহেরবান ও দয়াময়, তাই তিনি তাত্ক্ষণিক শাস্তি প্রয়োগ করেন না। তিনি অবকাশ দেন, বারবার সুযোগ দেন।

তাছাড়া হযরত মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করেছেন, তার উম্মতকে যেন আগেকার উম্মতের মতো শাস্তি তথা মানবাকৃতিকে বানর, শূকর ইত্যাদির আকৃতিতে রূপান্তর, পাথরের বৃষ্টি, ভূমি উল্টিয়ে দেওয়ার মতো কঠিন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনষ্ট করা না হয়।

খোদাদ্রোহিতার শাস্তি

মানুষ পাপ করতে করতে যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই আল্লাহর শাস্তি নাজিল হয়। পাপিষ্ঠ ফেরাউনকে আল্লাহ তাআলা তখনই ধরেছেন, যখন সে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: ‘হে মুসা! তুমি ফেরাউনের কাছে যাও, সে অত্যন্ত উদ্ধত হয়ে গেছে।’ (সুরা ত্বাহা : ২৪)

নমরুদকে আল্লাহ তাআলা তখনই শাস্তি দিয়েছেন, যখন সে নিজেকে প্রভু বলে দাবি করেছে। অনুরূপভাবে আদ, সামুদ প্রভৃতি জাতিকে তাদের সীমাহীন পাপাচারের কারণে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

বনি ইসরাইলরা আল্লাহর কিতাব তাওরাতকে অস্বীকার করেছে। উত্তম খাদ্য তথা মান্না ও সালওয়ার পরিবর্তে ভূমির উৎপন্ন খাদ্য চেয়েছে। আমালেকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আল্লাহর অগণিত নিয়ামত ভোগ করেও অকৃতজ্ঞ থেকেছে।

ফলে তারা চির লাঞ্ছনা ও আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়েছে। আগের নবীদের এসব কাহিনী পবিত্র কোরআনে আলোচনা করে আল্লাহ তাআলা এটিই বোঝাতে চেয়েছেন যে যদি উম্মতে মুহাম্মদী (সা.) ও তাদের মতো পাপাচারে লিপ্ত হয়, তবে তাদের পরিণতিও অনুরূপ হবে এবং একই ভাগ্য বরণ করতে হবে।

খোদাদ্রোহী নমরুদের পরিণতি

জালিম, পাপিষ্ঠ ও অহংকারীদের পরিণতি হল ধ্বংস। এরকমই একজন অহংকারী খোদাদ্রোহী বাদশা ছিল নমরুদ। তার অহংকার এতটাই সীমা লঙ্ঘন করেছিল যে আল্লাহ তার সৃষ্টির ক্ষুদ্রতম একটি জীব দিয়ে তাকে ধ্বংসে করেছিল। যা ইতিহাসের সব খোদাদ্রোহী অহংকারীর জন্য শিক্ষাস্বরূপ।

নমরুদ ছিল ব্যবিলন বা সিনারের (মেসোপোটেমিয়া) রাজা। সে ছিল পৃথিবীর চারজন বড় শাসকের অন্যতম। নমরুদ প্রায় ৪০০ বছর রাজত্ব করে। খ্যাতি ও সম্মানের শিখরে পৌঁছার পর তার মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। নিজেকে সে খোদা বলে দাবি করে এবং প্রজাদেরকে তার প্রার্থনা করার আদেশ দেয়। প্রজারাও তাকে উপাস্যরূপে পূজা ও অর্চনা শুরু করে।

এ সময় মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে আল্লাহ নবী হযরত ইবরাহিমকে (আ.) পাঠান। নমরুদকে তিনি আল্লাহর পথে (ইসলাম) আহ্বান করেন। কিন্তু সে নবীর কথা তো শোনেইনি বরং আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইবরাহিম (আ.) তখন তাকে আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করেন। এরপরও সাবধান না হলে আল্লাহ তাকে ক্ষুদ্র মশা দিয়ে ধ্বংস করে দেন।

ফেরাউনের পরিণতি

‘ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সূরা: কাসাস ২৮ : ৩৯-৪০)

মিসরের রাজা ফেরাউনের অন্যায়, জুলুম ও খোদা দাবির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন নবী হযরত মূসা (আ.)। তাকে এক আল্লাহ ও সত্যের দাওয়াত দেন। কিন্তু ফেরাউন আরও অহঙ্কারী হয়ে উঠল। নিজের ক্ষমতা ও আধিপত্যের মোহে সে নবী মুসাকে মারতে গিয়ে নিজেই আল্লাহর ক্রোধে ধ্বংস হয়।

কোরআনের দুইটি আয়াতে হযরত মুসা (আ.)-এর প্রার্থনা অনুসারে ফেরাউন ও মিসরবাসীর ওপর যেসব ভয়াবহ শাস্তি অবতীর্ণ হয়েছিল, তাসহ ফেরাউনের হঠকারিতার সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদান করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ফেরাউনের অবাধ্যতার জন্য প্রথমে অজন্মা, শস্যহানি ও দুর্ভিক্ষে মিসর দেশ জর্জরিত হতে থাকে।

কিন্তু ফেরাউন স্বীয় প্রজাসাধারণের করুণ ক্রন্দনে নিরুপায় ও বিষণ্ণ হয়ে হজরত মুসার (আ.) নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। তার প্রার্থনা অনুসারে অজন্মা ও দুর্ভিক্ষ দূরীভূত হয়ে যায়। এরপর ফেরাউন ফের বিদ্রোহ ও অত্যাচার আরম্ভ করে। দিন যায়, ফেরাউনের ঔদ্ধত্য বাড়তে থাকে।

এক পর্যায়ে মূসা নবী ও তার দলবলকে হত্যা করতে ধাওয়া করে। পথিমধ্যে মিসরের নীল নদ দিয়ে মুসা নবী ও বনী ইসরাইল অলৌকিভাবে পার হয়ে যায়। ডুবে মারা যায় ফেরাউন।

হস্তিবাহিনীর করুণ পরিণতি

আজকের ইয়েমেন ৫৭০ সালে অক্সাম সাম্রাজ্য বা ইথিওপীয় সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। ইয়েমেন ছিল গভর্নরশাসিত। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের পছন্দের লোকদেরকে ভাইসরয় নিয়োগ দিত। ইয়েমেনের তেমন একজন ভাইসরয়ের নাম আবরাহা আল-আশরাম।

সে ছিল অসহিষ্ণু, উগ্র ও প্রচণ্ড জেদি। মক্কার বাইতুল্লাহর প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও টান তার ভালো লাগত না। সে চাইত, মানুষ দলে দলে তার সিংহাসনের চারদিকে জড়ো হয়ে তাকেই প্রণাম করুক। তাই সে ইয়েমেনের প্রাণকেন্দ্র সানাতে বাইতুল্লাহ থেকে আরও বড়, সাজানো-গোছানো ও নান্দনিক একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করল।

নির্মাণ শৈলিতে তৎকালীন যুগে আলোড়ন সৃষ্টি করার মতোই স্থাপনা ছিল চার্চটি। আরববাসীকে বলা হল, তারা যেন কাবা ঘরে ইবাদতের পরিবর্তে ওই চার্চে এসে ধর্মকর্ম করে। কিন্তু এতে কোনো লাভ হল না। মক্কাবাসীরা বাইতুল্লাহকে তাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়ই রেখে দিল। এতে আবরাহা ক্ষিপ্ত হয়ে বাইতুল্লাহকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

আবরাহা প্রথমে অগ্রগামী দল পাঠিয়ে মক্কার যুবক ও উটগুলোকে কবজা করে ফেলে। যাতে প্রতিরোধের কোনো পথ মক্কাবাসীদের না-থাকে। সঙ্গে যুদ্ধ সংক্রান্ত একটি প্রস্তুতিপত্র পাঠায়। তাতে এমন ভয়াবহ যুদ্ধের হুমকি দেওয়া হয়, যা সামাল দেওয়া মক্কাবাসীর পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। এমনকি পুরো আরবের অস্ত্রও যদি এক করা হয়; তবুও আবরাহার অস্ত্রশস্ত্রের অর্ধেক হবে না।

আবরাহা সৈন্যবাহিনীর বিশাল বহর নিয়ে বায়তুল্লাহ তথা কাবাঘর অভিমুখে রওয়ানা হয়। চারদিকে রণঝংকার। আবরাহার যুদ্ধবহরের প্রধান আকর্ষণ ছিল বিশালদেহী হাতি। সে নিজেও এমন হাতির পিঠে চড়ে, যা মক্কার লোকেরা ইতোপূর্বে দেখেনি। আধুনিক যুগের ট্যাঙ্কের মতো ছিল হাতিগুলো। কিন্তু মক্কাবাসী আবরাহার বাহিনীকে বাধা দেওয়ারই চেষ্টা করেনি। কাবার মুতাওয়াল্লি আব্দুল মুত্তালিব শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন, ‘ঘরের মালিকই শত্রুর হাত থেকে তার ঘর রক্ষা করবেন।’

আবারাহা দলবল নিয়ে মক্কার প্রাণকেন্দ্রে উপস্থিত হল। তা দেখে অধিবাসীরা পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল। শুধু নেতৃস্থানীয় কিছু লোক উপস্থিত থাকলেন। পবিত্র কাবাকে ধূলায় পরিণত করতে আবরাহা প্রস্তুত। হঠাৎ পশ্চিমাকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। ক্ষণিকের মধ্যেই মেঘের মতো কিছু এসে আবরাহার হস্তিবাহিনীকে ঘিরে ফেলল। এটা আসলে মেঘ ছিল না। ছিল অগণিত ছোট ছোট পাখির বিশাল ঝাঁক। একসাথে দলবেঁধে ডানা মেলে উড়ে আসায় মেঘের মতো মনে হয়।

পাখিগুলো দেখতে চড়ুইয়ের মতো। নাম আবাবিল। ঠোঁটে ও পায়ে করে পাথর বয়ে এনেছিল তারা। পাথরের আকার ছিল অনেকটা ছোলার মতো। আবরাহার দল যখন কাবা ধ্বংসের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যে পা বাড়াল, তখনই আকাশ থেকে আবাবিল পাথর ফেলতে থাকল। একসাথে পুরো বাহিনীর ওপর পাথরের বৃষ্টি শুরু হল। পাথর যার ওপরই পড়ল, সে-ই লুটিয়ে পড়ল। এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে আবরাহার পুরো বাহিনী খতম হয়ে গেল।

যে বছর এ ঘটনা ঘটেছিল সেই বছরটাকে ইতিহাসে আমুল ফিল বা হস্তির বছর বলা হয়ে থাকে। ওই বছরই হযরত মোহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। পবিত্র কোরআনের সুরা ফিলে হস্তিবাহিনীর এই ঘটনাকে চিত্রায়ন করা হয়েছে এভাবে: আপনি কী দেখেননি, আপনার পালনকর্তা হাতিওয়ালাদের সাথে কীরূপ আচরণ করেছেন? তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি? তিনি তাদের উপর প্রেরণ করেছেন ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখি, যারা তাদের উপর পাথরের কাঁকর নিক্ষেপ করেছিল। অতঃপর তিনি তাদেরকে করে দেন ভক্ষিত তৃণসদৃশ।’

সড়কে মহানবীর ব্যঙ্গচিত্র আঁকা কার্টুনিস্টের মৃত্যু

মুসলিমদের প্রবল আপত্তি ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও আল্লাহর নবী হযরত মোহাম্মদের (স) ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন সুইডিশ কার্টুনিস্ট লার্স ভিক। ২০০৭ সালে তার আঁকা ছবি প্রকাশিত হলে মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হন। নবীর ছবি আঁকা ইসলামের দৃষ্টিতে খোদাদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য।

লার্স ভিকসের আঁকা সেই ব্যঙ্গচিত্র মুসলিম বিশ্বে এতটাই ক্ষোভ তৈরি করে যে সুইডেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডরিক রাইনফেল্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে ২২টি মুসলিম দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে বৈঠক করেন। ব্যঙ্গচিত্রের কারণে হত্যার হুমকির পেয়েছিলেন ভিকস।

এ কারণে তাকে পুলিশী নিরাপত্তা দেওয়া হত। এরপরও বাঁচতে পারেননি তিনি। ২০২১ সালের অক্টোবরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। খবরে বলা হয়, ভিকস পুলিশের একটি গাড়িতে চড়ে সুইডেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় মার্কইয়ার্ড শহরে ভ্রমণ করছিলেন এবং সেই সময় একটি ট্রাকের সাথে গাড়িটির সংঘর্ষ ঘটে।সুতরাং যারাই কোরআন অবমাননায় অংশ নিয়েছে বা নেবে তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে চরম দুর্ভোগ ও ভয়াবহ শাস্তি। ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী মহাপাপীর, যে আল্লাহর আয়াতের আবৃত্তি শোনে অথচ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে (নিজ মতবাদে) অটল থাকে। যেন সে তা শোনেইনি। সুতরাং ওকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও।’ (সুরা : জাসিয়া, আয়াত : ৭-৮)

একবার সাহাবি আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) তাঁর ছাত্রদের বলেন, ‘জেনে রাখো, কোরআন (অনুসারীর পক্ষে ও অবমাননাকারীদের বিপক্ষে) এমন সুপারিশকারী, যার সুপারিশ কবুল করা হবে। অতএব যে কোরআনের অনুসরণ করবে, সে জান্নাতে যাবে। আর যে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (ফাজায়েলে কোরআন, ইবনে কাসির : ১৫১ )

আর যারা পবিত্র কোরআনকে সম্মান করবে, আঁকড়ে ধরবে, মহান আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করবেন। বিখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, কোরআন আল্লাহর বাণী। তাই যথাসম্ভব তা শিক্ষা করো এবং তার দ্বারা উপকৃত হও। নিঃসন্দেহে কোরআন হলো আল্লাহর রজ্জু (অর্থাৎ তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার সুদৃঢ় মাধ্যম), উজ্জ্বল আলো, (অন্তরের) রোগ-ব্যাধি নিরাময়কারী। যে তাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে, তা তার জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে এবং তা আপন অনুসারীদের দেখাবে মুক্তির পথ। এতে কোনো বক্রতা নেই, যা সোজা করার প্রয়োজন আছে। কোরআনের রহস্য কখনো শেষ হবে না। আর তা কখনো পুরনোও হবে না। তাই এমন মহান গ্রন্থ অধিকহারে তিলাওয়াত করো। কারণ এর তিলাওয়াতের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা প্রতিটি অক্ষরে ১০টি করে নেকি দান করবেন। (সুনানে দারেমি, হাদিস : ৩৩৫৮)

ওমর (রা.) বলেন, আমি নবীজি (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা কোরআনের মাধ্যমে অনেককে সম্মানিত করবেন। আর অনেককে করবেন অপদস্থ!’ (ফাজায়েলে কোরআন, আবি উবায়দ : ১/২৭৪-২৭৫)মহান আল্লাহ আমাদের কোরআনের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করার তাওফিক দান করুন।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test