E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ওরা সেদিন হত্যা করেছিল এক মানবিক শিক্ষাবিদকে

২০২৩ জুলাই ০৯ ১৭:২৩:১৩
ওরা সেদিন হত্যা করেছিল এক মানবিক শিক্ষাবিদকে

গোপাল নাথ বাবুল


২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর কালো রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ক’জন শিক্ষক ও বু্িদ্ধজীবীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাসা থেকে তুলে নিয়ে গণহত্যা চালায়, তাদের মধ্যে ইংরেজি বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ছিলেন একজন। মূলত পাকবাহিনী ও এদেশে তাদের দোসররা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বাঙালি জাতিকে একটি মেধাহীন জাতি হিসেবে পরিণত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধরে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়। ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে ২৫ মার্চ কালো রাতে ঢাবি’র বাসভবনে পাকবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

সেই কালরাতে পাকবাহিনীর নৃশংস হামলার মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল। হলের প্রাধ্যক্ষ জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে প্রথমত হিন্দু, দ্বিতীয়ত বামপন্থী রাজনীতিবিদ হওয়ায় পাকিস্তান সরকার সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো। অনেকে তাঁকে সপ্তাহ খানেক অন্য জায়গায় চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অটল এ শিক্ষক, যাঁর উপর একটি আবাসিক হলের সকল ছাত্র ও কর্মচারীর সব দায়িত্ব অর্পিত, তিনি সেই দায়িত্ব এড়িয়ে নিজের প্রাণ বাঁঁচানোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে পলায়নের চেষ্টা করেননি।

তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘সবাই আমাকে সাতদিন দূরে থাকতে বলছে। আমি হলের প্রভোস্ট। আমি কী করে ছাত্রদের ফেলে যাব ? ওদের জন্যই তো এ কোয়ার্টার আমাকে দিয়েছে, ফোন দিয়েছে। আমি জানি, কিছু হলে আমাকেই আগে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।’

প্রতিদিনের মতো সে রাতেও খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পরিবারের সদস্যরা রেডিও খোলে বসেন। ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ শুনে তিনি মেয়ের ঘরে গিয়ে ঢাবি’র এমএ প্রিলিমিনারি ও অনার্স পরীক্ষার্থীদের খাতা দেখতে বসেন। কিন্তু বাইরে বড় বড় গাছ, পানির ট্যাঙ্ক ও ইটপাটকেল দিয়ে জনতার প্রতিরোধ দেখে ফ্লাটের প্রবেশপথ তালাবদ্ধ করে আবার মেয়ের ঘরে গিয়ে খাতা দেখতে বসেন। রাত বারোটার দিকে পাকবাহিনী অসংখ্য কানফাটা বোমা ও গুলি বর্ষণ করছিল। লাইট বোমার আলোর ঝলকানিতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত তাঁদের ৩৪ নম্বর ভবনের নিচতলার ফ্লাটটি বারবার কেঁপে উঠছিল। এমন সময় রান্নাঘরের দরজা ভেঙ্গে এক পাকিস্তানি সেনা অফিসার ঢুকে সোজা শোয়ার ঘরে গিয়ে ড. জ্যোতির্ময়কে জিগ্যেস করে, ‘আপ প্রফেসর সাহাব হ্যায় ?’

ড. জ্যোতির্ময় দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দেন, ‘ইয়েস।’ অফিসার বলে, ‘আপকো লে যায়েগা।’ তিনি দৃঢ়ভাবে জিগ্যেস করেন, ‘হোয়াই ?’ এই ‘কেন’র উত্তর না দিয়ে অফিসার ড. জ্যোতির্ময়কে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যায়। ভবনের তিনতলা থেকে নামিয়ে আনে আরেক অধ্যাপক পরিসংখ্যান বিভাগের এএনএম মুনীরউজ্জামানকে। ড. জ্যোতির্ময়কে নাম ও ধর্ম জিগ্যেস করার পর গুলি করে সেনারা চলে যায়।
এরপর অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের স্ত্রী সৈয়দা মাহমুদা জামান নিচে নেমে দেখেন, জ্যোতির্ময়ের দেহে তখনও প্রাণ আছে। তাঁর ঘাড়ের ডানদিকে গুলি লেগেছে। শরীর অবশ হয়ে গেছে।

মাহমুদা জামান বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে ডেকে এনে ধরাধরি করে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ ফ্লাটের বারান্দায় এলিয়ে দেন। কাছে মেডিক্যাল থাকা সত্ত্বেও কারপিউ থাকার কারণে নেয়া গেল না। ২৭ মার্চ মেডিক্যালে ভর্তি করালেও হাসপাতালে কোনো ডাক্তার না থাকায় বিনা চিকিৎসায় ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ৩০ মার্চ রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর পাকসেনারা হাসপাতাল ঘিরে ফেলেন। ফলে ড. জ্যোতির্ময়ের দেহের সৎকারও করতে পারেননি তাঁর স্বজনেরা। উল্লেখ্য, ঐদিন অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানকেও তাঁর ছোট ভাই এড. নবার মিয়া, ছেলে আকরামুজ্জামান ও ভাগ্নে মঞ্জুর হোসেনকে সহ হত্যা করা হয়।

জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা স্কুল শিক্ষক পিতা-মাতা কুমুদচন্দ্র ও সুমতি গুহ ঠাকুরতার কোল আলো করে ১৯২০ সালের ১০ জুলাই বর্তমান ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তাঁর মা কর্মসূত্রে ময়মনসিংহ শহরে অবস্থান করছিলেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল বর্তমান বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায়। ময়মনসিংহে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। তিনি ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯৩৬), আনন্দমোহন কলেজ থেকে আই.এ. (১৯৩৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. অনার্স (১৯৪২) ও এম.এ. (১৯৪৩) ডিগ্রি লাভ করেন এবং একই বছর তিনি গুরুদয়াল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে ২ বছর দায়িত্ব পালনের পর ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এবং ১৯৪৬ সালে ঢাকা জগন্নাথ কলেজে ইংরেজি বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দেন। এরপর তিনি ১৯৪৯ সালের ১২ নভেম্বর প্রভাষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ফেলোশিপ নিয়ে বৃটেন গমন করেন এবং লন্ডন কিংস কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। বৃটেন থেকে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে উন্নীত হন। এরপর ১৯৭০ সালের ২০ এপ্রিল জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পান।

তিনি ‘সুইনবার্ণ, স্টার্জ মুর অ্যান্ড এলিয়ট’ নামের যে অভিসন্দর্ভ পি.এইচ.ডি.-র জন্য লেখেন, তা ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয়। তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য, রাজনীতি ও সমাজচিন্তামূলক অনেক প্রবন্ধ লেখেন। সুতরাং ১০ জুলাই ইংরেজি সাহিত্যের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার ১০৩তম জন্মদিনে জানাই শুভেচ্ছা এবং বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test