E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা নয়, দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করাই হোক মূল লক্ষ্য 

২০২৩ জুলাই ১০ ১৬:৪০:০৬
জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা নয়, দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করাই হোক মূল লক্ষ্য 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


মঙ্গলবার বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৩। প্রতি বছর ১১ই জুলাই তারিখে পালিত একটি সাংবাৎসরিক আয়োজন, যার লক্ষ্য বিশ্ব জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উপরে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। জেন্ডার সমতাই শক্তি: নারী ও কন্যাশিশুর মুক্ত উচ্চারণে হোক পৃথিবীর অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন‍‍` এই প্রতিপাদ্য নিয়ে এবার  বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস  পালিত হবে।

১৯৮৭ সালের ১১ই জুলাই তারিখে বিশ্ব জনসংখ্যা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে গেলে সারা বিশ্বের জনমানুষের মধ্যে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়, তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালনা পরিষদ এই দিবসটি প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের লক্ষ্য হলো পরিবার পরিকল্পনা, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, মাতৃস্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মতো জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

বিশ্বের ৮০০ কোটি জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বাস করে এশিয়ার দুই দেশ ভারত ও চীনে। ভারতে ১৩৯ কোটির বেশি মানুষ বসবাস করছে। চীনের জনসংখ্যা ১৪১ কোটি। ভারতে প্রতিদিন ৮৬ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। অন্যদিকে চীনে দিনে জন্ম নিচ্ছে ৪৯ হাজার ৪০০ শিশু। এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে ভারত হবে বিশ্বের শীর্ষ জনসংখ্যার দেশ। ২০৬০ সালে দেশটির জনসংখ্যা হবে ১৬৫ কোটি।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ২ শতাংশ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে উল্লেখ করে বলা হয় বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১জন। ২০৫০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বে হবে দশম জনবহুল দেশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৪০ লাখ ৭৭ হাজার ২০৩ জন এবং নারী ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৩ হাজার ১২০ জন। বাকিরা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী। মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ গ্রামে এবং ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ শহরে বাস করেন। পিইসিতে প্রাপ্ত ২.৭৫ শতাংশ এনসিইর (নেট কাভারেজ এরর) পরিপ্রেক্ষিতে ৪৬ লাখ ৭০ হাজার ২৯৫ জন যোগ হয়ে দেশের সমন্বয়কৃত মোট জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জনে। সমন্বয়কৃত মোট জনসংখ্যার ৬৮.৩৪ শতাংশ গ্রামে এবং ৩১.৬৬ শতাংশ শহরে বাস করেন।

বিভাগভিত্তিক জনসংখ্যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বড় বিভাগ ঢাকার গণনাকৃত জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন, সমন্বয়কৃত জনসংখ্যা হলো ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৫ জন, যা দেশের মোট সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার ২৬.৬৮ শতাংশ। সবচেয়ে কম জনসংখ্যা বরিশাল বিভাগে, মোট সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার ৫.৪৯ শতাংশ।তার আগে ২০০১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৩ জন। ১৯৯১ সালে ছিল ১০ কোটি ৬৩ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২ জন। ১৯৮১ সালে ছিল ৮ কোটি ৭১ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৫ জন। প্রথম আদমশুমারিতে ১৯৭৪ সালে দেশের জনসংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ৭ কোটি ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭১ জন।শুমারির তথ্য অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার কমছে।এবারের শুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ, যা ২০১১ সালে ছিল ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ২০০১ সালে ছিল ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

এবারের শুমারিতে ৮৫ হাজার ৯৫৭ জনের আংশিক তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে দিলদার হোসেন বলেন, “আমাদের গণনাকারীরা ১৭ হাজার ৫০৭টি গৃহে গিয়ে এসব মানুষ সম্পর্কে আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে জেনেছেন। তাদের আংশিক তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু লিঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাই লিঙ্গভিত্তিক জনসংখ্যার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।

এখন দেশের পল্লী এলাকার জনসংখ্যা ১১ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৭ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আগের শুমারিতে ২০১১ সালে গ্রামাঞ্চলের জনংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ১১ কোটি ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৭ জন,আর শহরে এখন বাস করেন ৫ কোটি ২০ লাখ ৯ হাজার ৭২ জন বা মোট জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ। আগের শুমারিতে শহরের জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৩ জন।

দেশে মোট খানার সংখ্যা এখন (এক হাড়ির রান্না খেয়ে যারা একসঙ্গে থাকেন) ৪ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার ৫১টি। প্রতিটি খানায় গড়ে ৪ জন বাস করেন।

২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ২০ লাখ ৬৭ হাজার ৭০০টি, তখন প্রতি খানার জনসংখ্যা ছিল গড়ে ৪ দশমিক ৪ জন।

দেশে মোট বাস গৃহের সংখ্যা ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার ৯৫১টি। এর মধ্যে পল্লী এলাকায় রয়েছে ২ কোটি ৭৮ লাখ ১১ হাজার ৬৬৭টি; আর শহর এলাকার বাসগৃহের সংখ্যা ৮১ লাখ ৭৯ হাজার ২৮৪টি।

> জনসংখ্যার ঘনত্ব

বর্তমানে দেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১,১১৯ জন মানুষ বাস করে। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৭৬ জন।

> বৈবাহিক অবস্থা

বর্তমানে দেশের ১০ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার ৬৫ দশমিক ২৬ শতাংশ বিবাহিত, ২৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ অবিবাহিত, ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ বিধবা/বিপত্নিক, ০.৪২ শতাংশ তালাকপ্রাপ্ত এবং দাম্পত্য বিচ্ছিন্ন ০.৩৭ শতাংশ।

> ধর্মভিত্তিক হার

গত ১১ বছরে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনসংখ্যা আরও বেড়ে মোট জনংখ্যার ৯১ দশমিক ০৪ শতাংশ হয়েছে। ২০১১ সালের শুমারিতে এই হার ছিল ৯০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

অপরদিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ থেকে কমে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে।

একইভাবে বৌদ্ধ ধর্মানুসারী ০.৬২ শতাংশ থেকে কমে ০.৬১ শতাংশ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর হার ০.৩১ শতাংশ থেকে কমে ০.৩০ শতাংশ হয়েছে।

> বেড়েছে সাক্ষরতার হার

নতুন শুমারিতে দেশের ৭ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ ভাগে উন্নীত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। ২০১১ সালের শুমারিতে এই হার ছিল ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

বর্তমানে দেশের ৭৬ শতাংশ পুরুষ, ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ নারী এবং ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ হিজড়ার সাক্ষরজ্ঞান রয়েছে।

> মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী

দেশে ৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এর মধ্যে ৬৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ পুরুষ, ৪৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ নারী।

আবার ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে ৭২ দশমিক ৩১ শতাংশ মানুষ মোবাইল ব্যবহার করে। তাদের ৮৬ দশমিক ৭২ শতাংশ পুরুষ, ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ নারী।

> ইন্টারনেট ব্যবহারকারী

৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আবার ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের ৩৭ দশমিক ০১ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।

> খাবার পানির প্রধান উৎস

দেশের ৮৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষ গভীর বা অগভীর টিউবওয়েলের পানি পান করেন। ট্যাপ বা পাইসে সরবরাহ করা পানি পান করেন ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ মানুষ। ০.৫৯ শতাংশ মানুষ বোতল বা জারের পানি পানি করেন।

এখনও ০.৮৯ শতাংশ মানুষ পুকুর নদী খাল লেকের পানি, ০.৩৫ শতাংশ মানুষ কুয়ার পানি, ০.১২ শতাংশ মানুষ ঝরনা বা ছরার পানি এবং ০.৪২ শতাংশ মানুষ বৃষ্টির পানি পান করেন।

> টয়লেট সুবিধা

দেশের ৫৬ দশমিক ০৪ শতাংশ মানুষ পানি ঢেলে নিরাপদ নিষ্কাশন সংবলিত টয়লেট ব্যবহার করেন। পানি ঢেলে অনিরাপদ টয়লেট ব্যবহার করেন ১২ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

স্ল্যাবসহ পিট ল্যাট্রিন বা ভেন্টিলেটেড ইম্প্রুভড ল্যাট্রিন ব্যবহার করেন ২১ দশমিক ৭২ শতাংশ মানুষ। এছাড়া স্ল্যাব ছাড়া পিট ল্যাট্রিন বা উম্মুক্ত পিট ল্যাট্রিন ব্যবহার করেন ৪ দশমিক ০৮ শতাংশ। কাঁচা, ঝুলন্ত ল্যাট্রিন ব্যবহার করেন ৪ দশমিক ০৭ শতাংশ মানুষ। ১ দশমিক ২৩ শতাংশ মানুষ কাজ সারেন খোলা জায়গায়।

> বিদ্যুৎ সুবিধা

দেশের মোট জনসংখ্যার ৯৭ দশমিক ৬১ শতাংশ নাগরিক জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ মানুষ। ০.১৯ শতাংশ মানুষ অন্যান্য উৎসের (যেমন জেনারেটর) বিদ্যুৎ পেলেও ০.৭৫ শতাংশ মানুষ কোনো ধরনের বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে।

পরিশেষে বলতে চাই,শিক্ষা, সচেতনতাই গড়তে পারে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। আর এই রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম উপাদান হলো জনসংখ্যা। জনসংখ্যা না থাকলে দেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা কঠিন। আবার অধিক জনসংখ্যা একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে হুমকীর মুখে ফেলতে পারে। বলা হয়, একটি দেশের জনসংখ্যাকে ওই দেশের সম্পদ বলা হলেও অতিরিক্ত জনসংখ্যা সম্পদ নয়, বরং বোঝা বলা যায়। কিন্তু শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি আর সচেতনতা জনসংখ্যাকে হুমকীর পরিবর্তে জনসম্পদে রূপ দিতে পারে। যখন জনসংখ্যা কোন দেশের জনসম্পদের রূপ নেয়, সেই দেশ সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছায়। বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে এটা বলা জরুরী হয়ে পরেছে, জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য হয়ে উঠুক জনসংখ্যা বোঝা নয়, হয়ে উঠুক জনসম্পদ। সেই লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে কাজ করা দরকার। মাত্র ১০ থেকে ১১ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মানুষের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ লাখের মতো।

হাজার শতাব্দীতে দিতে এসে দাঁড়ায় ১০০ কোটিতে। মাত্র ১৩০ বছরে তা ডাবল হয়ে দাঁড়ায় ২০০ কোটি। তারপরে মাত্র ৫০ বছরের কম সময়ে তা আবারও দ্বিগুণ হয়ে ৪০০ কোটিতে পৌঁছায়। ১৯৭৫ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৪০০ কোটি। আর বর্তমানে প্রায় ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ছুই ছুই। তাই জনসংখ্যা নিয়নান্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জনগোষ্ঠীকে সুশিকক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কৌশল গ্রহণ করতে হবে। আমরা মনে করি জনসংখ্যা বড় সমস্যা নয়, বড় সমস্যা হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারগুলোর সঠিক নিশ্চয়তা প্রদান করা। মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলে জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ যেমন জরুরী, তেমনি জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপ দিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করাও জরুরী। আমরা চাই, সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ জনসংখ্যাকে বোঝা না ভেবে জনসম্পদে পরিণত করার পরিকল্পনা নেবে। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, জনসংখ্যা জনসম্পদে রূপ নিক।এজন্য পরিকল্পিত উপায়ে জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করাই হোক জনসংখ্যা দিবসের মূল লক্ষ্য।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test