E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সিপাহী বিদ্রোহের নায়ক মঙ্গল পান্ডের ১৯৬তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা

২০২৩ জুলাই ১৮ ১৯:১৬:১৫
সিপাহী বিদ্রোহের নায়ক মঙ্গল পান্ডের ১৯৬তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা

গোপাল নাথ বাবুল


১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ। দিনটি ছিল ভারতের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। ওইদিনই রচিত হয়েছিল এক মহান ইতিহাস। আর এ ইতিহাসের নায়ক এবং অন্যতম নক্ষত্র ছিলেন একজন ভারতীয় সিপাহী মঙ্গল পান্ডে। ওইদিন অপরাহ্নে ৩৪ নং নেটিভ ইনফ্যানট্রির সিপাহীরা দলে দলে জটলা করছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান ঘাঁটি ব্যারাকপুরের প্যারেড ময়দানে। সৈনিকদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। বিপুল উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। এমন সময় মঙ্গল পান্ডে সিপাহী বিদ্রোহের ডাক দিয়ে দীপ্ত ভঙ্গিতে বন্দুক উঁচু করে চিৎকার করে ওঠলেন, ভাইসব আর চুপ করে বসে থেকো না। ফিরিঙ্গির পায়ের তলায় আর কতদিন থাকবে। ওরা আমাদের সোনার দেশ, গর্বের  মাতৃভূমি লুটেপুটে খাচ্ছে। আর আমরা মরছি অনাহারে। ওরা আমাদের বেঁচে থাকার অস্তিত্বে হাত দিয়েছে। আমাদের করেছে জাতিভ্রষ্ট। ভগবানের দোহাই তোমরা বেরিয়ে এসো। গুলি করে মেরে ফেলো ফিরিঙ্গি শয়তানদের। এসো মারো মারো।  

কেউ যখন এগিয়ে আসার সাহস দেখালেন না, তখন অদ্ভূত এক উম্মাদনায় পবিত্র মাতৃভূমি রক্ষায় চিবুক উর্ধ্বমূখী করে একাই বন্দুক হাতে হাঁটতে হাঁটতে গর্জন করে চলছেন মঙ্গল পান্ডে। এ অবস্থায় মেজর হিউসন পান্ডেকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু একজন সৈনিকও তার নির্দেশ পালনে এগিয়ে এলেন না দেখে তিনি নিজেই ঘোড়া ছুটিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের চেষ্টা করলে সাথে সাথে পান্ডেজির হাতে থাকা বন্দুক গর্জে ওঠল। এতে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে হিউসন মাটিতে পড়ে গেলে এগিয়ে এলো লেফটেন্যান্ট বার্গে। বার্গে পান্ডেকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে সে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পান্ডেজি একটু এগিয়ে গিয়ে হাতের তলোয়ার দিয়ে তার মুন্ডু ধড় থেকে আলাদা করে ফেলেন। সবাই দেখলো, ছয় ফুট দীর্ঘ, উন্নত পেশীবহুল দীর্ঘ চেহারা, ধীরস্থির, শান্ত, ভদ্র ও ধার্মিক এবং নিজের স্বভাবের গুণে সকলের কাছে দারুণ জনপ্রিয় মঙ্গল পান্ডের নতুন এক রূপ। সকল সৈন্য গভীর আগ্রহে পান্ডের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কেউ বিশ্বাসও করতে পারছেন না, সবার প্রিয় পান্ডে এমন ভয়ানক হতে পারেন!

লেফটেন্যান্ট বার্গে ধরাশায়ী হওয়ার পর ইংরেজদের দালাল পল্টু এসে পান্ডেকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরল। পান্ডে হাতের তলোয়ার দিয়ে পল্টুকে ধরাশায়ী করে নিজেকে মুক্ত করলেন। বিদ্রোহের খবর শুনে সেনাক্যাম্পে চলে এল সেনাপতি হিয়ার্সে। সাহায্যে একজন সৈনিকও এগিয়ে না আসায় অভিমানী পান্ডে সিদ্ধান্ত নিলেন, ইংরেজদের হাতে মরবেন না। আত্মহত্যা করবেন। হঠাৎ পান্ডের পিস্তল গর্জে ওঠল। নিজের মাথায় গুলি করলে ফসকে যায়। রক্তাক্ত মঙ্গল পান্ডে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুস্থ করে নির্মম শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু তখনও তিনি হাসপাতালের বিছানায় মরণাপন্ন অবস্থায় শায়িত। বাঁচার কোনো আশা নেই। এমন অবস্থায় ৬ এপ্রিল প্রহসনের এক বিচারে তাঁকে বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক প্রমাণিত করে বিচারক ১৮ এপ্রিল তাঁর ফাঁসির আদেশ দেন। কথায় আছে, চোরের মনে পুলিশ পুলিশ। হঠাৎ ভারতীয় সিপাহীদের এমন উম্মাদনা দেখে ইংরেজরা মারাত্মক ভয় পেয়ে যান। তাই নির্ধারিত ১০ দিন আগে ৮ এপ্রিল মরণাপন্ন মঙ্গল পান্ডেকে ব্যারাকপুরের সকল সৈনিকদের সামনে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেন, যাতে অন্য সিপাহীরা কোনোদিন বিদ্রোহ করার সাহস না করেন। ওইদিন মঙ্গল পান্ডেকে গ্রেফতার করতে অস্বিকৃতি জানানোর কারণে ঈশ্বর পান্ডে নামক একজনকেও ফাঁসি দেন ইংরেজরা। তবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম জীবন দেওয়া বীর শহীদ মঙ্গল পান্ডের জীবনদান বৃথা যায়নি। তাঁর এ আত্মদান ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে প্রবল সাড়া জাগিয়েছিল। ফাঁসির দু’সপ্তাহ পরই দিল্লী, এলাহাবাদ, মিরাট, অযোধ্যা, কানপুর, লখনৌ, ঝাঁসি, বারানসি, পাটনাসহ সারা ভারতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং মে মাসে মিরাটের সেনা ছাউনিতে সিপাহীরা সরকারি নির্দেশ অমান্য করে কর্ণেল ফিনিসকে গুলি করে হত্যা করেন। এতে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

মঙ্গল পান্ডে উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার নাগওয়া গ্রামে কারও কারও মতে, ফৈজাবাদ জেলার সুরহুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৯ জুলাই, ১৮২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম দিবাকর পান্ডে। দারুণ আর্থিক সংকটের মধ্যে কোনোরকমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাস করেন। তারপর দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত মঙ্গল পান্ডে ১৮৪৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল আর্মিতে সিপাহী পদে যোগ দেন। এখানে চাকরি করতে এসে তিনি নানারকম বৈষম্য ও অন্যায় দেখতে পান, যা মঙ্গল তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। বৃটিশ উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা প্রতিমুহূর্তে ভারতীয়দের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল। বৃটিশদের ক্লাবের বাইরে লেখা থাকত, কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ। কোনো ইংরেজ অফিসার হেঁটে গেলে তাদের ভারতীয় সিপাহীদের হাতের বন্দুক উঁচু করে সম্মান দেখাতে হত। কিন্তু কোনো ভারতীয় অফিসারদের বেলায় বৃটিশ সৈন্যরা কোনো ধরণের সম্মান প্রদর্শন করত না। যুদ্ধে কোনো ভারতীয় সিপাহী মারা গেলে বৃটিশরা তাঁদের পরিবারের কোনো খোঁজ-খবর নিত না। কিন্তু বৃটিশ সৈন্য বা অফিসারদের ক্ষেত্রে ছিল অর্থনৈতিক সহযোগীতাসহ অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা।

তাছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিমের সুন্দর সম্প্রীতিই ছিল বৃটিশদের ভয়ের অন্যতম কারণ। তাই তারা সবসময় চেষ্টা করত এ সম্প্রীতি নষ্ট করতে। ১৮৫৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল ৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড (পি/৫৩) রাইফেল। রাইফেলগুলোর কার্তুজ গরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে তৈরি হত এবং কার্তুজ দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে রাইফেলে লোড করতে হত। গরু ও শূকরের চর্বি মুখে দেওয়া হিন্দু-মুসলিম সৈন্যদের জন্য ছিল অধার্মিক ও গর্হিত কাজ। যার ফলে ভারতীয় সৈন্যরা এ বন্দুক প্রত্যাহারের দাবি জানালে প্রতিশ্রুতি দিয়েও ইংরেজরা তা প্রত্যাহার করতে বিলম্ব করে। এতে সিপাহীদের মনে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্রোহের জন্ম নেয়। ফলে সিপাহী বিদ্রোহের জন্ম হয়।

পরিশেষে বলা যায়, ইংরেজরা এ বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করলেও এর মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়। ভারতীয়রা ফিরে পেল আস্থা। নেমে পড়ল মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে। অত্যাচারী ফিরিঙ্গিদের ধ্বংস করার বজ্রগর্ভ সংকেত পৌঁছে গেল ভারতের প্রতিটা নগর-বন্দর সহ প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে। ১৯ জুলাই এ মহান বিপ্লবী মঙ্গল পান্ডের ১৯৬তম জন্মদিনে জানাই শুভেচ্ছাসহ বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test