E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন গ্রেডের বৈষম্য নিরসণ হওয়া জরুরি 

২০২৩ আগস্ট ০৭ ১৬:১৩:৫৬
তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন গ্রেডের বৈষম্য নিরসণ হওয়া জরুরি 

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


বেতন বৈষম্য নিয়ে কথা বলার আগে বর্তমান বাজার ব্যবস্থা নিয়ে কিছুটা কথা বলে নেওয়া জরুরি। লাগামহীণ বাজার ব্যবস্থার সাথে তাল মিলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন গ্রেডভূক্ত কর্মচারীদের। বাজার ব্যবস্থার সাথে বেতন কাঠামোর একটা সামঞ্জস্য থাকা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে বাজার ব্যবস্থার সাথে কোন ভাবেই তাল মেলাতে পারছে না তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। যত দিন যাচ্ছে লাগামহীন ভাবে বেড়ে চলছে দ্রব্যমূল্যের দাম স্তর। হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে কর্মচারীদের সাথে সাথে সাধারণ মানুষও। সবদিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উপায় মিলছে না কোনো কিছুতেই। সরকারের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পূর্বেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বাজার মূল্য। আবার মাঝে মাঝে দ্রব্যমূল্যের দাম কমিয়ে সরকার যখন নির্ধারণ করে সাধারণ জনগণ তা থেকে সুবিধা পায় না ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারনে। ব্যবসায়ীরা বিশ্ব বাজারের দোহাই দিয়ে প্রতিনিয়ত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করে চলছে। যেন চলছে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। 

ব্যবসায়ীদের এ সিন্ডিকেট ভাঙ্গার সাধ্য যেন কারো নেই। এ সমস্যা সমাধানের কোন পথও সামনে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতি ও আমাদের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থাতে কোনো রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মধ্যবিত্তরা। যাদের প্রতিনিয়ত আয় পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। আরো বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সরকারি চাকুরিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। সরকারি চাকুরি সোনার হরিণ কারন এ চাকুরির রয়েছে নিশ্চয়তা। আগে যখনই বাজেট আসতো তখন চলতো ভিন্ন রকমের প্রতিযোগিতা। যে যার মতো পণ্যের মজুদ বাড়িয়ে জনগণের কাছ থেকে ফায়দা লোটার চেষ্টা চালাতো। এখন ব্যবসায়িরা আর বাজেটের অপেক্ষা করে না সারা বছরই পণ্যের দাম নিয়ে করে নয়ছয়। একদিকে করোনা পরবর্তী বিশ্ব অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একেবারে ব্যাটে বলে মিলে গেছে ব্যবসায়ীদের। আবার সামনে নির্বাচন তাই মনে হয় সরকারের না দেখার ভান। বারবার বিভিন্ন পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করার কথা বলা হলেও বাস্তবতার সাথে এর কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশে পণ্যের দাম বাড়ানো হয় কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে সেভাবে আর দেশে কমানো হয় না। এসব কারণে প্রতিনিয়তই বাজার ব্যবস্থাপনা অস্থিতিশীল হচ্ছে। যার বলি হচ্ছে নিম্নস্তরের সাধারণ জনগণ। এই মুল্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতার সাথে মিলে যাচ্ছে সরকারের বেতনভূক্ত ১১- ২০ গ্রেডভূক্ত কর্মচারীদের বেতন কাঠামো। ১১ থেকে ২০তম গ্রেডের পার্থক্যটা দেখলে বুঝা যাবে সত্যিকার অর্থেই এসব গ্রেডের কর্মচারীদের কোন চাকুরীজীবি হিসেবেই দেখা হয়নি। ১১ থেকে ১২ তম গ্রেডের পার্থক্য ১২শ টাকা, ১২ থেকে ১৩তম গ্রেডের পার্থক্য ৩শ টাকা, ১৩ থেকে ১৪তম গ্রেডের পার্থক্য ৮শ টাকা, ১৪ থেকে ১৫তম গ্রেডের পার্থক্য ৫শ টাকা, ১৫ থেকে ১৬ তম গ্রেডের পার্থক্য ৪শ টাকা, ১৬ থেকে ১৭তম গ্রেডের পার্থক্য ৩শ টাকা, ১৭ থেকে ১৮তম গ্রেডের পার্থক্য ২শ টাকা, ১৮ থেকে ১৯তম গ্রেডের পার্থক্য ৩শ টাকা ও ১৯ থেকে ২০ তম গ্রেডের পার্থক্য ২শ টাকা।

সরকারি চাকুরিতে এখনও ৪টি শ্রেণি বিদ্যমান রয়েছে যা ২০টি গ্রেডে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ১ম থেকে ৯ম গ্রেড প্রথম শ্রেণি, ১০ গ্রেড ২য় শ্রেণি, ১১- ১৬ গ্রেড তৃতীয় শ্রেণি ও ১৭-২০ থেকে চতুর্থ শ্রেণি। প্রতি বারই বাজেট দেওয়ার সময় চেয়ে থাকে একটু সুযোগ সুবিধা বাড়বে বলে। বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা একটু বেশিই প্রত্যাশা করে থাকে কারন তাদের বেতন স্কেলটি নিয়ে সবসময় হতাশায় থাকে। কিন্তু প্রতিবারই সে আশায় গুড়েবালি। বর্তমানে ২০১৫ সালের ঘোষিত জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী সর্বনিম্ন বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার টাকা মুল বেতন চালু রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি ভাগ করা হলেও নিম্নস্তরের কর্মচারীদের যেসব স্কেল প্রদান করা হয়েছে তা হতাশাজনক। সরকার ইতোমধ্যে বৈশাখি ভাতা এবং শিক্ষা ভাতা চালু করেছে যা নি¤œস্তরের কর্মজীবিদের আশার সঞ্চার করেছে।

বাজেটের আগে শুনা গিয়েছিল প্রতি বছরের ৫% ইনক্রিমেন্ট বাড়ানোর সাথে মুদ্রাস্ফীতির সাথে সমন্বয় করে প্রণোদনা প্রদান করা হবে। কাগজেপত্রে মুদ্রস্ফীতির সাথে সমন্বয় করে ৫% প্রণোদনা দেওয়া হলেও বাজার ব্যবস্থার সাথে একেবারেই মিল নেই। নি¤œ গ্রেডভূক্ত কর্মচারীরা এ প্রাপ্তিতে হতাশ হয়ে পড়েছে। ২০১৫ সালের বেতন স্কেলের পর পুনরায় নতুন স্কেল প্রদানের দাবী উঠেছে। আগে প্রতি ৫ বছর পর পর স্কেল দেওয়ার কারনে সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তারা লাভবান হতেন বেশি। কারন প্রতি ৫ বছর পর পর স্কেল প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেত। বর্তমানে প্রতি বছর বছর ৫% বৃদ্ধির ফলে আগের মতো আর বেতন বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস ওয়েব সাইটের পাওয়া তথ্য থেকে বিভিন্ন দেশের বেতন স্কেলের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশের স্কেলের গ্রেড সংখ্যা আন্তর্জাতিক মানের। যেমন- বাংলাদেশের ২০টি, পাকিস্তানের ২২টি, ভারতের ১৮টি, যুক্তরাষ্ট্রের ১৫টি, ফিলিপাইনের ৩৩ টি, কেনিয়ার ১৮টি গ্রেড রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সর্বনি¤œ মূল বেতন ৮,২৫০ টাকা, পাকিস্তানের ৯,১৩০ রুপি, ভারতের ১৮,০০০ রুপি, যুক্তরাষ্ট্রের ১৮,৭৮৫ ডলার, ফিলিপাইনের ১০,৫১০ পেসো, কেনিয়ার ১১,৫৫৩ শিলিং। আবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মূল বেতন ৭৮,০০০ (২০১৫) টাকা, পাকিস্তানের ৮৫,৭০০ (২০১৮) রুপি, ভারতের ২,৫০,০০০ (২০১৮) রুপি, যুক্তরাষ্ট্রের ১,০৫,১২৩ (২০১৯) ডলার, ফিলিপাইনের ২,৮৯,৪০১ (২০১৮) পেসো, কেনিয়ার ২,৯২,৭৬৫ (২০১৯) শিলিং।

এ পর্যন্ত আলোচনায় স্কেলগুলো সঠিক বলেই মনে হয় কিন্তু পরবর্তী আলোচনায় হতাশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পার্থক্যের মূল জায়গাটা হলো ১-১০তম গ্রেডে প্রতি ধাপে পার্থক্য রাখা হয়েছে গড়ে ২০% অন্যদিকে ১১-২০তম গ্রেডে পার্থক্য রাখা হয়েছে গড়ে ৪%। যা অন্য কোন দেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই ব্যবধানের ফলে পরবর্তী গ্রেডে স্থানান্তর হলে তেমন কোন লাভ হয় না এসব গ্রেডের কর্মচারীদের। অন্যদিকে বাসা ভাড়ায় তৈরি হয় ব্যাপক বৈষম্য। উপর এবং নিঁচু গ্রেডে পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু যে পরিমাণ ব্যবধান রাখা হয়েছে তা রিতিমতো হতাশা তৈরি করছে। তাই উচিত এসব বেতন স্কেলের বৈষম্য দূরীকরণ করা। খুব দ্রুত এসব বৈষম্য দূর করতে না পারলে টাইম স্কেল বাড়ানো, সিলেকশন গ্রেড প্রদান, ইবিক্রস, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, রেশন ব্যবস্থা চালু করা এবং বাড়ি তৈরির জন্য সহজ শর্তে অধিক পরিমাণে ঋণ প্রদান করা যেতে পারে। কারন প্রতিটি দপ্তরে প্রায় সকল কাজই বাস্তবায়ন করে থাকে এইসব গ্রেডভূক্ত কর্মচারীরা।

সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ৫% প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে। ফলে কর্মচারীদের মাঝে তৈরি হয়েছে এক প্রকার হতাশা। এই প্রণোদনা প্রদান বর্তমান জীবনমানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই মনে হয়। দীর্ঘদিন যাবত স্কেল প্রদান না করার ফলে আগের মতো আর বেতন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রেষণা প্রদানের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে বেতন বৃদ্ধি। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে আয় না বাড়ার কারনে হতাশ হয়ে পড়েছে নিম্ন বেতনের কর্মচারীরা যার ফলে কাজের বেলায়ও প্রভাব পড়ছে। তাই সার্বিক বিচার বিশ্লেষণ করে গ্রেড সংক্রান্ত জটিলতা দূর করা এখন সময়ের দাবী। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে এইসব কর্মচারীদের শ্রমের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

লেখক :প্রাবন্ধিক।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test