E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

১৩৫তম আবির্ভাব দিবস

পরমপ্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

২০২৩ সেপ্টেম্বর ১৯ ১৬:৩৫:৩২
পরমপ্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

গোপাল নাথ বাবুল


বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার পদ্মা নদীর তীরে ছোট্ট একটা গ্রাম হিমায়েতপুর। সে গ্রামেই ১৮৮৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর (৩০ ভাদ্র, ১২৯৫ বাংলা) বিশ্বমানবের পরম কল্যাণস্বরূপ হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন পরম প্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুলচন্দ্র। পিতা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন একজন খাঁটি ও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এবং মাতা মনমোহিনী দেবী ছিলেন একজন সতীসাধ্বী রমণী। 

হিমায়েতপুর গ্রামেই ঠাকুরের শৈশব, বাল্য ও কৈশোর কাল কাটে। ১৮৯৩ সালে তিনি হিমায়েতপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি পাবনা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারপর অমিতাবাদের রায়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করার পর তিনি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়েই প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য মনোনীত হয়েও ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের পক্ষে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ পরের দুঃখে ব্যতীত ঠাকুর এক সহপাঠী পরীক্ষার ফিসের টাকা যোগাড় করতে পারেনি বলে তাকে নিজের টাকাটা দিয়ে দেন। এভাবেই সবার দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বলে ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র সহপাঠীদের কাছে খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন। কেউ তাঁকে বলতেন ‘রাজা ভাই’, কেউ আবার একধাপ এগিয়ে বলতেন ‘প্রভু’।

পরে মায়ের ইচ্ছে পূরণের জন্য তিনি কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং অতি কষ্টের মধ্য দিয়ে তিনি হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রি অর্জন করেন। এ সময়টা ছিল ঠাকুরের জীবন সংগ্রামের সময়। কারণ, পিতা অসুস্থ ছিলেন বলে ঠাকুরের পরিবার খুবই অর্থকষ্টে পতিত হয়। ঠিকমতো খাবার পর্যন্ত জুটত না টাকার অভাবে। কখনও কখনও রাস্তার ধারের কলের জল খেয়ে দিনযাপন করতে হত। আশ্রয়ের অভাবে অনেকদিন ফুটপাথে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে। কলকাতার যোগেন ভট্টাচার্যের কয়লার গুদামেও কিছুদিন ছিলেন। এতে তাঁর জামাকাপড় নোংরা হত, শরীর মলিন হত কিন্তু তাঁর মনের উজ্জ্বল শুভ্রতা কখনও ম্লান হত না। এত আর্থিক কষ্টের মধ্যেও ঠাকুরের মধুর ও অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে হেমন্ত কুমার চ্যাটার্জী নামক প্রতিবেশী এক ডাক্তার ওষধসহ একটি ডাক্তারি বাক্স তাঁকে উপহার দেন। ঠাকুর এ বাক্স দিয়েই শুরু করেন হিমায়েতপুরে কুলিমজুরদের সেবা। ফলে তাঁর অর্থ কষ্টের অবসান ঘটে। তিনি উপলব্ধি করলেন, শুধু দেহের চিকিৎসা করলে হবে না। মানুষের দুঃখের স্থায়ী নিবারণ করতে হলে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক এ তিন রকম রোগেরই চিকিৎসা করতে হবে।

ঠাকুরের মা মনমোহিনী দেবী ছিলেন উত্তর ভারতের যোগীপুরুষ শ্রী শ্রী হুজুর মহারাজের শিষ্য। ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র মায়ের কাছেই দীক্ষা গ্রহণ করে নতুন কাজ, নতুন জীবন শুরু করে দেন। তিনি নবউদ্যমে উৎফুল্ল মনে লেগে যান মানুষের চরিত্র গঠনের কাজে। তিনি পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে কলুষমুক্ত করার জন্য এত অপমান, এত গঞ্জনা সহ্য করে চলেছিলেন তাঁর আপন গতিপথে। যেখানে অন্যায়-অত্যাচার, যেখানে অসৎ প্রকৃতির লোকেদের উৎপাত, যাদের বিভিন্ন চেষ্টা বা রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সঠিক পথে আনা যাচ্ছে না, সেখানেই তিনি প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে দেবদূত হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি মানুষের দেহের চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক ব্যাধীর চিকিৎসা শুরু করেন। কারণ শারীরিক সুস্থতাই অনেকটা মানসিক সুস্থতার উপর নির্ভর করে। অসহায় ও অবহেলিত যারা, ঠাকুর অনুকুলচন্দ্র ক্রমান্বয়ে তাদেরই প্রাণের বন্ধু হয়ে উঠলেন। তিনি নামের মাহাত্ম্য প্রচারের লক্ষ্যে কীর্তনের দল গড়ে তোলেন। কীর্তনের সময় ঠাকুর মাঝে মাঝে দিব্যভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। ধীরে ধীরে এলাকার শিক্ষিত তরুণরাও তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন। মূলত তখন থেকেই তিনি সবার ঠাকুর হয়ে উঠেন। ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের এমন মহিমার কথা ক্রমশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

কীর্তন মানুষের মনে প্রশান্তি আনে সত্য, কিন্তু মনের স্থায়ী উন্নতির জন্য প্রয়োজন সৎনাম স্মরণ ও মননের সাহায্যে ব্রহ্মার উপলব্ধি, যার জন্য আবশ্যক দীক্ষা, তা ঠাকুর উপলব্ধি করলেন। তাই তিনি সত্যনিষ্ঠা, সৎকর্মানুষ্ঠান এবং দীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষের আত্মিক উন্নতি বিধানের লক্ষ্যে হিমায়েতপুরেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৎসঙ্গ আশ্রম’। শুরু হল সৎনাম প্রচারের মহিম্মানিত অধ্যায় এবং মানুষ তৈরির আবাদ। লক্ষ্য হল কর্মের মাধ্যমে যোগ্যতর মানুষ গড়া। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প ও সুবিবাহ- এ চারটি হল সৎসঙ্গের আদর্শ। এ চার স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে ‘সৎসঙ্গ আশ্রম’-এ বিভিন্ন কর্ম প্রতিষ্ঠানের বিদ্যায়তন গড়ে উঠল। ব্রহ্মচর্যা, গাহর্স্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস সনাতন আর্য জীবনের এ চারটি স্তরই সৎসঙ্গ আশ্রমভূমিতে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ যুগোপযোগী রূপ লাভ করে। দেখে যেন মনে হয়, প্রাচীন ঋষিদের এক নবতর সংস্করণ। এতে ভক্ত ও অনুরাগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল। দলে দলে লোক সৎসঙ্গ আশ্রমে এসে ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে লাগলেন। ‘সৎসঙ্গ’ সম্পর্কে ঠাকুর বলেন, ‘সৎ ও সংযুক্তির সহিত তদগতিসম্পন্ন যাঁরা তাঁরাই সৎসঙ্গী, আর তাঁদের মিলনক্ষেত্র হল সৎসঙ্গ।’
ক্রমান্বয়ে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত হিমায়েতপুর সৎসঙ্গ আশ্রমের নাম সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মহাত্মা গান্ধী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, গুলজারীলাল নন্দার মত মহৎ ব্যক্তিত্বরা এ সৎসঙ্গের কর্মকান্ড দর্শন করে ভূয়সী প্রশংসা করেন।

বাল্যকাল থেকেই সবকিছু নিয়ে ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের কৌতুহল ছিল। যে কোনও ব্যাপারে নিজের মত করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন তিনি। পুঁথিগত বিদ্যার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনীহা। সবসময় তিনি সত্যকেই জানতে চাইতেন নিজের মত করে। পিতা-মাতার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভক্তি। একবার পিতার অসুখের সময় সংসারে খুব অর্থকষ্ট দেখা দেয়। বালক অনুকুলচন্দ্র এ সময় সংসারের হাল ধরলেন। প্রতিদিন আড়াইমাইল হেঁটে গিয়ে শহরে মুড়ি বিক্রি করে সে অর্থ দিয়ে অসুস্থ পিতার জন্য ঔষধ আনতেন, পত্য আনতেন। মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাতে তিনি যে কোনো কষ্ট সহ্য করতেন। মা-বাবার ইচ্ছেতে তিনি ১৭ বছর বয়সে পাবনা শহরের পাশের ধোপাদহ গ্রামের রামগোপাল ভট্টাচার্যের প্রথম মেয়ে সরসী বালা দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার জীবন শুরু করেন।

১৯৪৬ সাল। বিংশ শতাব্দীর অত্যুন্নত বৃটিশ রাজত্বকাল। বাংলার রাজধানী কলকাতা মহানগরীর বুকে অভিশপ্ত আগস্টে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নাটকীয় বীভৎসতা ও নৃশংসতা চলমান। তৎকালীন ঘরে-বাইরে নানা আপদ-বিপদ ও ঝঞ্ঝাটের দরুণ শ্রীশ্রীঠাকুরের স্বাস্থ্য কিছুদিন যাবৎ ভালো যাচ্ছিল না। রক্তচাপ ও হৃৎপিন্ডের দুর্বলতাজনিত নানান উপসর্গে তিনি খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন। এমন অবস্থায় চিকিৎসক, শিষ্যবৃন্দ ও আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধে ঠাকুরকে বায়ু পরিবর্তনের জন্য কোনও স্বাস্থ্যকর স্থানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। শেষে ঠাকুরের ইচ্ছেতে বিহারের দেওঘরে নেওয়া হল।

ঠাকুরের খুবই পছন্দ হল স্থানটি। তিনি সেখানে সৎসঙ্গের আদর্শপুষ্ট একটি নতুন আশ্রম গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে সেটা বিশ্ব সৎসঙ্গের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। লোকহিতার্থে তিনি দেওঘরে তপোবন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, পাবলিশিং হাউজ, ছাপাখানা ইত্যাদি গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঠাকুর আর পাবনায় ফিরে আসেননি।

পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকুল চন্দ্র মানবের দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে স্মরণীয় ও অনুসর্তব্য বহুবিধ অমূল্য নির্দেশ দান করেছেন। তিনি ধর্ম, কর্ম, পরমার্থ, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, শিক্ষা, বিবাহ, কৃষি, শিল্পকলা, বাণিজ্য, বৃত্তি, সত্তা, ব্যষ্টি, সমষ্টি, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবকিছুকে এক মহা সমন্বয়-সূত্রে সংগ্রথিত করে এবং পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন তাঁর অমৃতবাণীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এ মহাবাণীগুলো জনসাধারণের মাঝে পরিবেশনকল্পে বিষয়বস্তু বিচারে ভাগে ভাগে ও ভিন্ন-ভিন্ন গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। এক হিসেব মতে, ঠাকুরের রচিত বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা ৮৫ এবং ইংরেজি গ্রন্থের সংখ্যা ১২। এসব গ্রন্থে ধর্মশিক্ষা, সমাজ সংস্কার প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে ঠাকুরের উপদেশ সমূহ বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে সত্যানুসরণ, পুণ্যপুঁথি, অনুশ্রুতি (৬ খন্ড), চলার সাথী, শাশ্বতী (৩ খন্ড), প্রীতিবিনায়ক (২ খন্ড), বিবাহ বিধায়না, সমাজ সন্দিপন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

পরিশেষে বলা যায়, পরমদয়াল শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র যেমন মানুষকে ভালোবাসতেন, ঠিক তেমনি মানুষ্ও যেন ভালোবাসাময় হয়ে উঠেন সর্বান্তকরণে। মানবজাতিকে যে অমৃতময় সন্ধান দিয়ে গেছেন তা ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোরভাবে অনুসরণ করলে উত্তীর্ণ হতে পারেন যে কোনও মানুষ। “মাটির শরীর মাটি হবে মাটি ছাড়া নাই বিধান, মাটিরে তুই কররে খাঁটি অমৃতেরই এনে নিদান।” মানুষের তরে অগণিত এমন বাণী পরিবেশন করে ভারত, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে বিহারের দেওঘরে পরমপ্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র ১৯৬৯ সালের ২৬ জানুয়ারি তাঁর দেহত্যাগ করেন।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test