E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমেরিকা যাদের বন্ধু, তাদের শত্রুর প্রয়োজন হয়না

২০২৩ সেপ্টেম্বর ২৩ ২০:৩৮:৩২
আমেরিকা যাদের বন্ধু, তাদের শত্রুর প্রয়োজন হয়না

মিনার সুলতান


সারা বিশ্বে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, অবিচার, জুলুম ও নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি ও হত্যাযজ্ঞ চলছে।  যদি প্রশ্ন করা হয় এর জন্য দায়ী কে, তাহলে সহজভাবেই উত্তর আসবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সে সকল যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে এর জন্য দায়ী আমেরিকা।

স্থানীয় আদিবাসীদের নির্মম-নিষ্ঠুর পন্থায় হত্যা করে ইউরোপীয় বেনিয়ারা ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই প্রতিষ্ঠা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠা লাভের পর ২৪৭ বছরে এক দিনের জন্যও এ দেশটি বিনা যুদ্ধ বসে থাকেনি। এরা বিশ্বের মোড়ল। মানবতা রক্ষার নামে নিজেরা অস্ত্র ব্যবহার করে। আবার অন্যদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে তা ব্যবহার করার জন্য। এরা যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে বন্ধুত্বের মাধ্যমে, তারপর নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভিন্ন ধরণের চাপ প্রয়োগ করতে থাকে, ছড়ি ঘুরাতে থাকে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের উপর। নিজেদের প্রেস্ক্রিপশানে বন্ধু রাষ্ট্রকে চালাতে থাকে, কথা না শুনলেই শুরু করে যুদ্ধ মিশন। কখনও সরাসরি আবার কখনও অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে সংঘাত জিইয়ে রাখে। নিকট অতীতে আমেরিকার কূটকৌশলে অনেক দেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে ।

১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানকে দখল করে রেখেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি আমেরিকা। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে হটানোর জন্য আফগানিস্তানে তালেবান যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণসহ অস্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহ করতে থাকে আমেরিকা। সৃষ্টি হয় সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদার। একসময় আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

পরবর্তীতে আমেরিকা তালেবানদের নিয়মিত অর্থ এবং অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিলে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল কায়েদা আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলা করে যা আমেরিকা এবং আফগানিস্তানকে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। সন্ত্রাস নির্মূলের নামে যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে সৈন্য মোতায়েন করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট' অনুসারে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধে আফগানিস্তানে ১,৭৪,০০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়।

২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান দোহায় শর্তসাপেক্ষ শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে বলা হয় যে ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে, পরিবর্তে তালিবান চুক্তির শর্তাবলী অনুযায়ী আল-কায়েদাসহ এর কোনো সদস্য, অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে এমন কার্যক্রম করার অনুমতি প্রদান করবে না ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা পারমাণবিক বোমা দিয়ে জাপানের হিরোশিমাতে প্রায় ১,৪০,০০০ এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোককে হত্যা করে। পরবর্তীকালে এ দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২,১৪,০০০ মানুষ। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের বেশির ভাগই ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তি।

মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি ইসলামিক রাষ্ট্রপ্রধান আমেরিকার সকল অসংগতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে আসছিল তখন। এসকল রাষ্ট্রপ্রধানদের ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে নেমে পড়ে আমেরিকা। একনায়কতন্ত্র হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগানকে সামনে রেখে একে একে প্রতিটি দেশের জনগণকে উস্কে দেয় আমেরিকা। আরব বসন্তে অবদান রাখায় একজন নারী সাংবাদিককে নোবেল শান্তি পুরস্কারও দেয়া হয়। যদিও একটা বড় অংশের দাবী, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যই নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে আন্দোলনকে আরো উস্কে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

মিসরে ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রতিবাদকারীরা মাঠে নামে। প্রতিবাদ ক্রমেই উত্তাল হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক পদত্যাগ করেন। দেশটি ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করলেও দুই বছর পর ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতেই যায়। আরো কঠোরভাবে ফিরে আসে সেনাশাসন। যে তিউনিসিয়া থেকে আরব বসন্তের সূচনা হয়েছিল সেখানে গণতন্ত্র খুব শক্ত ভিত গাড়তে পারেনি। অগ্রগতি যা হয়েছে তা সামান্যই।

পার্শ্ববর্তী লিবিয়া গাদ্দাফিকে হটালেও দেশটি গৃহযুদ্ধ থেকে বের হতে পারেনি। সরকারিভাবে লিবিয়ায় মার্কিন সৈন্যের সংখ্যা সীমিত। কিন্তু সৈন্য সংখ্যা কম থাকার মানে যে লিবিয়ার ভেতরে তাদের তৎপরতা কম, তা কিন্তু নয়। গাদ্দাফিকে হত্যার পর থেকেই লিবিয়াতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। তার মৃত্যুর পর যারা দেশটিতে ক্ষমতায় এসেছে তাদের চেয়ে তিনি অনেক ভালো ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ ইতালি এরইমধ্যে নিজেদের এই ভুল স্বীকারও করেছে।

ইয়েমেনে সৌদি-মার্কিন আগ্রাসন ছিলো ভয়াবহ। ইয়েমেনকে রক্ষার নামে সেখানে গণহত্যা চলেছে যার নেতৃত্বে ছিলো সৌদি মার্কিন জোট। মার্কিন সরকার স্বীকার করেছে যে, ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহর বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে তারা সীমিত পর্যায়ে সামরিক সমর্থন দিয়েছে। এতে কিন্তু স্পষ্ট এই ইয়েমেনে তথাকথিত যুদ্ধের নামে সেখানে কী করেছে তারা!

সিরিয়ায় এখন ১৫০০ মার্কিন সৈন্য তৎপর রয়েছে। এরা সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স, এসডিএফ-কে নানা ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলছে, এসব সাহায্যের মধ্যে রয়েছে বোমা বর্ষণ করা, স্থানীয় বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা এবং অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করা। সিরিয়ায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে অন্তত ৩.৫ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। আরও ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি গৃহহীন জীবন যাপন করছে। প্রশ্ন হলো, ভিনদেশে যেখানে সে দেশের জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনা করবে সেখানে আমেরিকান সৈন্য কেন থাকবে? কেন এত রক্তপাত ঘটাবে?

এভাবেই আরব বসন্তের নাম করে আমেরিকা নিজেদের বিরুদ্ধাচারণ করা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে গেছে। এক হিসাবে বলা হয় আরব বসন্তের ফলে মাত্র পৌনে দুই বছরে লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনের মোট দেশীয় উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে দুই হাজার ৫৬ কোটি মার্কিন ডলার।

ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র রয়েছে। আর তা থেকে ইরাকি জনগণকে মুক্ত করতে সেনা অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র এই অনুমান নির্ভর তথ্যের উপর ভিত্তি করে ২০ মার্চ, ২০০৩ তারিখে মারণাস্ত্র ধ্বংস করার নামে তেলসমৃদ্ধ দেশ ইরাকে হামলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট। হামলায় ২ লাখ বেসামরিক ইরাকিকে হত্যা করে আমেরিকা এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে বন্দি করে পরবর্তীতে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। দখল করে নেয় ইরাকের সকল তেলের খনি।

সাদ্দামকে সরানোর পর ইরাকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন প্রভিশনাল অথরিটি নামে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। যার প্রধান ছিলেন পল ব্রেমার। এ সময় ইরাকে সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থা ভেঙে দেয়া হয়। এছাড়া ইরাকে বহু বছর ক্ষমতায় থাকা বাথ পার্টিকেও সরকার গঠনে অংশ নিতে বাধা দেয়া হয়। এসময় দেশটিতে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সেনা সদস্য বেকার হয়ে পড়ে এবং সরকার ও প্রশাসনে শূন্যতা তৈরি হয়। নতুন করে মাথা চারা দিয়ে উঠে জঙ্গিবাদ ।

বাস্তবতা হলো, ওই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ২০ বছর পার হয়ে গেলেও ইরাকে আজ পর্যন্ত এখনো মারণাস্ত্র পায়নি যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এই অভিযোগেই ইরাকে হামলা চালানো হয়। দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে ঝুলানো হয় ফাঁসির দড়িতে। পরবর্তীতে আমেরিকা স্বীকার করে নেয় যে, ইরাক হামলা তাদের ভুল ছিলো এবং কোন মরণাস্ত্র ইরাকে ছিলো না।

মধ্যপ্রাচ্য, এর মজুত তেল এবং কৌশলগত জলপথ (সুয়েজ খাল) নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসরাইল-ফিলিস্তিনের দীর্ঘ সংঘাতে ইসরাইলের পক্ষপাতিত্ব করে আসছে আমেরিকা। মূলত আরব দেশগুলোকে চাপে রাখতে ইসরাইলকে সরাসরি সমর্থন দেয় আমেরিকা।

দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানকে জঙ্গিবাদের হাব হিসেবে ব্যবহার করে আসছে আমেরিকা। তালেবান কিংবা আল কায়েদার উত্থানে তাদের প্রশিক্ষণে যেভাবে আমেরিকা পাকিস্তানের ভূমিকে ব্যবহার করেছে একইভাবে তালেবান/আল কায়েদার ধ্বংসের জন্যও পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছে আমেরিকা। এই সুযোগে বছরের পর বছর পাকিস্তানকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কিনতে বাধ্য করেছে আমেরিকা। যা পাকিস্তানের সামরিক খাতের বরাদ্দ দেখলেই বুঝা যায়। ২০২১-২২ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও প্রতিরক্ষা খাতে পাকিস্তানের বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১৬ শতাংশ।

বলা হয়ে থাকে যে, এ পর্যন্ত পাকিস্তানে যত সামরিক শাসক ক্ষমতায় এসেছে সবাই আমেরিকার পছন্দসই ব্যক্তি ছিলেন। পাকিস্তানে কে কখন সরকার প্রধান হয়ে ক্ষমতাসীন হবে আবার কে কখন ক্ষমতাচ্যুত হবে তা অনেকাংশেই আমেরিকার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বক্তব্য থেকেই যা স্পষ্ট হয়ে যায়।

আমেরিকার নির্দেশনায় চলা পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত কোন রাষ্ট্রপ্রধান তার ক্ষমতার মেয়াদ পুরোপুরি শেষ করে যেতে পারেনি। মূলত নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যই আমেরিকা পাকিস্তানের রাজনীতিতে যখন যাকে প্রয়োজন তাকে ক্ষমতাসীন করে আবার যখন ক্ষমতাচ্যুত করে। ফলস্বরূপ পাকিস্তানে দিনের পর দিন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক টানাপোড়ান চলতেই থাকে।

লেখক : সংবাদকর্মী।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test