E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভেজাল রাজনীতিতে ভালো মানুষের আকাল

২০২৩ অক্টোবর ০২ ১৭:৫৪:২৪
ভেজাল রাজনীতিতে ভালো মানুষের আকাল

মীর আব্দুল আলীম


সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন- "মাঝে মধ্যে বড় কষ্ট লাগে, আমার দেশের রাজনীতি থেকে কেন যেন মনে হয় ভােলো মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে"। কথা শতভাগ সত্য। বাস্তব উপলব্ধি থেকে তিনি এ কথা বলেছেন নিশ্চিত। এই সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তবে খারাপ মানুষ চাটুকারিতার মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই চাটুকারদের কারণে রাজনীতিতে ভালো মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

এটা কিন্তু মোটেও ভালো লক্ষণ না। রাজনীতির জায়গাটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেলে দেশের জন্য অমঙ্গল বটে! ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, অনিয়ম, সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজ, ভুমিখোর, ভেজাল কারবারীরা রাজনীতিবিদের ছত্রছায়াই সৃষ্টি। এ দেশে এসব অখাদ্যে ভরে গেছে। তাই দেশে এত উন্নতির পরেও নানাভাবে অর্থনীতিতে ধাক্কা খাচ্ছে। লুটেরা সিন্ডিকেট সব সুনামেই হুল ফুটাচ্ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস সড়ক, বিশ্বমানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেলসহবহ মেঘা প্রকল্প দেশের কল্যাণে হলেও কতক রাজনৈতিক ব্যক্তি তাদের ছাত্র ছায়ায় থাকা অমানুষদের কারণে সব অর্জন ম্লান হচ্ছে। লুটপাট, অতিকথন, অর্থ পাচার কমানো গেলে এ যাবৎ দৃশ্যমান উন্নয়ন আসবে বলেই বিশ্বাস করি। অতি সন্নিকটে জাতীয় সংসদের দ্বাদশ সরকার দলকে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। ‌ চিটা, গান্ধা পঁচা রাজনীতিবিদ যাদের কারণে সুনাম ক্ষুন্ন তাদের ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে পরিছন্ন, সৎ এবং বিজ্ঞ মানুষদের মনোনয়ন দিয়ে শুদ্ধাচার প্রয়োজন। বিরোধী দল গুলোও এ ব্যাপারে সতর্ক থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের নমিনেশন দিয়ে জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করি।

তবে হতাশার কথা অনেক আছে। রাজনৈতিক দলগুলো নমিনেশন এর নামে কেনাবেচা হাট জমানোর একটা পুরনো ট্র্যাডিশন রয়েছে। কোন দলই বোধ করি বোধ এর বাইরে নয়। কেউ আবার ঘুরিয়ে-ফুরিয়ে নানা ফিকিরে নমিনেশনের নামে অর্থাৎ আদায় করেন। এখানেই যত ঝামেলা। এজন্যই জাতীয় সংসদে ভালো লোক কমে । পবিত্র সংসদে ভালো লোক বাড়াতে হলে নমিনেশনের কেনাবেচা বন্ধ করতে হবে, বাংক লুটেরা, সিন্ডিকেট ওয়ালা এবং সিন্ডিকেটের সহযোগ, ভূমি দস্যু, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের হারাম করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ কাজটি করতে পারলে আগামী নির্বাচনে তার দল জনপ্রিয়তা পাবে।

১৪ বছর কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার পর শত ভালো কাজ করলেও কিছুটা হলেও জনবিচ্ছিন্ন হয়। তাছাড়া অনেক সংসদীয় এলাকার রাজনীতিবিদদের অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি সন্ত্রাস ভূমিদস্যুতা মানুষকে অসহায়ত্ব করার অভিযোগ হামেশাই পত্রিকা গুলো ছাপছে। অনেক এলাকায় দলীয় লোকজনও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। অনেক সংসদীয় আসনে শুধু জনগণ নয় দলীয় নেতাকর্মীরাও পরিবর্তন চায়। সদস্যদের নিকট লোকজন এবং দলীয় নেতা কর্মীদের জুলুম অত্যাচারের কাছ থেকে পরিত্রাণ চায়।

জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বার অনেকেই আগের মত নেই। অনেকের মধ্যে জনস্বার্থ নেই; নেই দেশ প্রেম। এদের অনেকেই নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে অধিকাংশ সময়। সব জনপ্রতিনিধি এবং নেতাকর্মীদের কারণে দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়ে বটে! এদের কারণে উন্নয়নের সকল অর্জন ধুলায় ভুলন্ঠিত হয়। এখন থেকেই সজাগ থাকতে। শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। স্থানীয় নির্বাচন গুলো দলীয়করণ করার কারণে অযোগ্য ব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। আর নানা কারণে নানা সময় জনগণের উপর চড়াও হয়। উন্নয়ন ভালো লাগলেও ওসব কথা মনে করে অনেকে মধ্যে অসন্তোষ থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ বিষয়টির অতি সজাগ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন মনে করি।

আগের জনপ্রতিনিধি কেমন ছিলো? আমার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এখানেতা সামনে আনতে চাই।

বৃহত্তর ঢাকা জেলার তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জের রূপসী গ্রামে আমার জন্ম। প্রিয় স্থান। যেখানে শেষ বেলা ঘুমনোর স্বপ্ন দেখি আমি। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত আমার ছোটবেলা ওই গ্রামেই কেঁটেছে। ছোট বেলায় আমার মায়ে কাছে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প শুনেছি। তিনি গল্প শুনিয়েই আমাকে বড় করেছেন। মায়ের গল্পগুলো ছিল বাস্তবতার সঙ্গে মিলানো। বলছিলাম হেমিলনের বাঁশিওয়াল গল্পের কথা। জার্মানির হ্যানোভারের ৩৩ মাইল দক্ষিণে হ্যামিলন শহরে হ্যামিলনের বাঁশির সুরে যেমন প্রথমে ইঁদুর ও পরে শিশুদের ঢল নেমেছিল ঠিক তেমনি বিরল ঘটনা ঘটতে দেখেছি আমার জন্মস্থান, রূপসীর অজপাড়া গাঁয়ে। এখনকার স্বনামধন্য পূর্বাচল খ্যাত এলাকাটি তখন নিভৃত গ্রামই ছিল বলা চলে। এখন শিল্প সমৃদ্ধ শহর। যা কিনা হতে যাচ্ছে এশিয়ার সর্ব বৃহৎ স্যাটেলাইট শহর।

তখনকার একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কথা আমার বেশ মনে পরে। নাম তাঁর সোনামিয়া। যার নামের পরে কবে যে চেয়ারম্যান শব্দটি যোগ হয়েছে এখনও তিনি সেই নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি বেঁচে নেই। চেয়ারম্যান চাচা যখন গাঁয়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন, যুব, বৃদ্ধ, শিশুর দল তার সঙ্গে ছুটতো। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো অত ইঁদুর আর শিশুর দল তার সঙ্গে না থাকলেও গোটা ৫০ লোক তো তখন সব সময়ই তার পিছু পিছু ছুটতে দেখতাম। তিনি এ তল্লাটে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তার কথায় তখন সবাই উঠত-বসত। বিচার সালিশ থেকে সব কিছুই সোনামিয়া চাচা অতি সহজে করে দিতেন। তার কোনো সিদ্ধান্তে কারও অমত করতে দেখিনি কখনও। সারা থানাই ছিল তার প্রভাব পতিপত্তি। তার প্রভাব চলতো গরিব অসহায় মানুষের পক্ষে। এখন কি দেখি? নিজেদের নিয়েই ভাবেন অনেকে।

সোনা মিয়া চেয়ারম্যানরা দেশে আছেন কি? থাকলে ক’জন? আজকাল কেউ কাউকে মানতে চায় না। যেন সবাই নেতা। গ্রাম একটা, আর নেতা ১৪ জন। আমার জন্মস্থান রূপসীতেও এখন তাই ঘটছে। দিন দিন গ্রামের মানুষগুলো যেন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। আর রাজনীতিতে বিশুদ্ধতার বড্ড অভাব দেখা দিচ্ছে। তাই সবার সঙ্গে সবার বনিবনা কম হচ্ছে। আগের মানুষগুলো কই? আগের সেই দিনগুলো কই? নেই। হারিয়ে গেছে। পৃথীবি বদলে গেছে, যা দেখি তা তো সবই নতুন লাগে। আগে অনেক সুন্দর দিন কাটাইতাম। আগে বাঙালি ছিলাম ভালোই তো ছিলাম। সাহেব হয়ে, শহুড়ে হয়ে আর্টিফিসিয়াল হয়ে যাচ্ছি আমরা। আমার দাদা সুবেদ আলী মীর, নানা এখলাছ উদ্দিন ভূঁইয়ার মতো ভালো মানুষ এখন আর দেখি না কেন? কাদা মাটিতে গড়া মানুষ। আমরা এমন হতে পারছি না কেন? ছলচাতুরি, বাটপারি, মিথ্যাচার তাদের কাছেই কখনও ভিড়ত না। গ্রামের বিচার আচার তারাই করতেন। চুলচেরা বিচার। এখন আইন আদালতে ভরে গেছে দেশে। জজ, ব্যারিস্টারের অভাব নেই। সুবিচারের অভাব? এমন দিনের প্রত্যাশায়ই কি ছিলাম আমরা?

স্বাধীতার আগে এবং পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গল্প আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার কাছে অনেক শুনেছি। আপামর দেশের মানুষ নাকি তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতেন। তার কোনো আদেশ পেলেই তাই সাদরে গ্রহণ করত আমজনতা। এখন এই বাংলাদেশেই কত শত নেতা-নেত্রী দেখছি। সবাই ক্ষমতা ধর। কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলে না; মানতে চায় না; বিশ্বাস করেন না।
রাজনীতিতে এখন বড় ভেজাল হয়ে গেছে। শুদ্ধতা, পরিপক্বতা খুবই কম। আগের সেই ত্যাগী নেতাও নেই। সে সময় গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বারদের অনেক ইজ্জত ছিল। এখন নেই তা বলব না। কতটা আছে জনগণ আপনারাই তা ভালো বলতে পারবেন। এখন চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মানুষ মানতে চায় না। নানা বিভেদ ও স্বার্থের কারণে রাজনৈতিক দলের নেতা-নেতৃও কেউ মানতে চায় না। সমীহ করে কতটুকু তা তো দেখছিই প্রতিদিন। করলেও ভয়ে করে বেশি। সমীহ করে মামলার ভয়ে, হামলার ভয়ে,
জান খোয়ানের ভয়ে। তবে এভাবে সবাইকে এক কাতারে ফেলা বোধ হয় আমার সমীচীন হচ্ছে না। ভালো মানুষ, ভালো চেয়ারম্যান, মেম্বার, কমিশনার, নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী-এমপি নেই তা বলা বোধ হয় ঠিক না। তবে তারা সংখ্যায় খুবই নগণ্য।

যার কারণে কতৃত্ব, মর্যাদা হারাচ্ছে রাজৈতিদক দলের নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা। এ অবস্থায় দেশের শৃঙ্খলা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কোনোটাই সঠিকভাবে হবে না বলেই মনে করছি। এ বিষয়টি আমাদের দেশপ্রেমিক জনগণ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক এবং বিজ্ঞজন সবাই ভাবনায় এনে নেতৃত্ব এবং জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হবেন এটাই আমরা কায়মনে চাই।

লেখক : মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test