E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস 

বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন জন্ম নিবন্ধন

২০২৩ অক্টোবর ০৫ ১৭:০৫:২৪
বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন জন্ম নিবন্ধন

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শুক্রবার ৬ অক্টোবর জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস ২০২৩। সাধারণ মানুষকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে উৎসাহিত করতে এ দিনকে ‘জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস’ ঘোষণা করেছে সরকার।

এর আগে দিনটি ‘জাতীয় জন্ম নিবন্ধন দিবস’ নামে পালন করা হতো। ২০২১ সাল থেকে এর নাম পরিবর্তন করে জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

কেউ জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ করলে ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করতে হবে। আইন অনুযায়ী এখন থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে এ নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করতে ২০২১ সালের ৯ আগস্ট মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ৬ অক্টোবরকে ‘জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস’ ঘোষণা করে সরকার।

জানা যায়, ১৮৭৩ সালের ২ জুলাই ব্রিটিশ সরকার অবিভক্ত বাংলায় জন্ম নিবন্ধন-সংক্রান্ত আইন জারি করে। এরপর ২০০১-০৬ সালে ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহায়তায় পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ২৮টি জেলায় ও ৪টি সিটি করপোরেশনে জন্মনিবন্ধনের কাজ নতুন করে শুরু হয়।

জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ এর ৮ ধারা অনুযায়ী, শিশু জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন এবং কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু নিবন্ধন করতে হবে। জন্ম নিবন্ধন শিশুসহ বয়স্কদেরও একটি নাগরিক অধিকার। একটি শিশুর জন্ম নিজ দেশকে, বিশ্বকে আইনগতভাবে জানান দেয়ার একমাত্র পথ জন্মের পর জন্ম নিবন্ধন করা। প্রথম জন্ম নিবন্ধনের অধিকার জাতিসংঘের শিশু সনদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, এভরি চাইল্ড টু বি রেজিস্টার্ড ইমিডিয়েট আফটার বার্থ। বাংলাদেশের জাতীয় শিশু নীতি-২০১১ অনুযায়ী সব শিশুর জন্মের পর পরই জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। এটি শিশুর মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় অধিকার।

কয়েক বছর আগেও জন্ম নিবন্ধন করা হতো মূলত বহির্বিশ্বে গমন বা বিশেষ প্রয়োজনে। যদিও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন রয়েছে ব্রিটিশ আমল থেকেই কিন্তু তার কার্যকারিতা ছিল খুবই নগণ্য। ১৮৭৩ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে প্রথম জন্ম ও মৃত্যুবিষয়ক একটি আইন পাস হয়। এখন সময় পাল্টেছে। দেশের সবমানুষকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের আওতায় আনতে ২০০১ সালে ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহায়তায় প্রকল্প শুরু হয়। তখন হাতে লেখা জন্ম ও মৃত্যু সনদ দেয়া হতো। জন্ম ও মুত্যু নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সরকার তা বাধ্যতামূলক করেছে। এ লক্ষ্যে সরকার নতুন করে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ (সংশোধিত ২০১৩) প্রণয়ন করে। জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, শিশু অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে আইনটি ৩ জুলাই, ২০০৬ থেকে কার্যকর করা হয়েছে।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন অনুসারে, জন্ম নিবন্ধন হলো একজন মানুষের নাম, লিঙ্গ, জন্মের তারিখ ও স্থান, মা-বাবার নাম, তাদের জাতীয়তা এবং স্থায়ী ঠিকানা নির্ধারিত নিবন্ধক কর্তৃক রেজিস্টারে লেখা বা কম্পিউটারে এন্ট্রি প্রদান এবং জন্ম সনদ প্রদান করা। একইভাবে মৃত্যু নিবন্ধন হলো মৃতব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ, মৃত্যুর স্থান, লিঙ্গ, মাতা/পিতা বা স্ত্রী/স্বামীর নাম নির্ধারিত নিবন্ধক কর্তৃক কম্পিউটারে এন্ট্রি প্রদানসহ ডেটাবেজে সংরক্ষণ ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ প্রদান করা। সাধারণত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা/সিটি করপোরেশনের মেয়র বা মেয়র কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কাউন্সিলর বা অন্য কোনো কর্মকর্তা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের এক্সিকিউটিভ অফিসার এবং দূতাবাসসমূহের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো অফিসার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করে থাকেন। পাশাপাশি, ওয়েবসাইটেও সংশ্লিষ্ট নিবন্ধকের কার্যালয় বরাবর অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করা যায়। আবেদনের প্রিন্ট কপি নিবন্ধন অফিসে দাখিল করলে নিবন্ধক জন্ম নিবন্ধন করতে পারবেন।

শিশু জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন ফ্রি। জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিন পর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত নিবন্ধন ফি দেশে ২৫ টাকা, বিদেশে ১ ডলার। ৫ বছর পর নিবন্ধন ফি দেশে ৫০ টাকা, বিদেশে ১ ডলার। জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য আবেদন ফি দেশে ১০০ টাকা, বিদেশে ২ ডলার। অন্যান্য তথ্য সংশোধন এবং বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সনদের নকল সরবরাহের জন্য আবেদন ফি দেশে ৫০ টাকা, বিদেশে ১ ডলার। ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় দেশে-বিদেশে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের এ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

জন্ম নিবন্ধন করা থাকলে একজন শিশু বা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ বহু ধরনের সুবিধা পেতে পারেন। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪-এর ধারা ১৮ অনুযায়ী পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদান, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জমি রেজিস্ট্রেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র, লাইসেন্স ইন্স্যুরেন্স পলিসিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। একইভাবে সাকসেশন সার্টিফিকেট প্রাপ্তি, পারিবারিক পেনশন প্রাপ্তি, মৃত ব্যক্তির লাইফ ইন্স্যুরেন্স দাবি, নামজারি ও জমিজমা প্রাপ্তিতে মৃত্যু সনদ জরুরি।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সব নাগরিকের একটি শুদ্ধ ডেটাবেস প্রস্তুতকরণে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন তথ্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপ হিসেবে, সবার জন্ম নিবন্ধন করতে ২০১০ সাল থেকে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। সারাদেশে সরাসরি জন্ম নিবন্ধনের পাশাপাশি অনলাইনেও নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। শুধু অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন ও সনদ ডাউনলোডই নয়, জন্ম নিবন্ধন যাচাইও করা যায় সহজেই। এখন যে কেউ মোবাইলে ‘জন্ম তথ্য যাচাই’ অ্যাপস ব্যবহার করে জন্ম নিবন্ধন অনলাইন কপি যাচাই করে দেখতে পারেন। সরকারের এমন যুগান্তকারী উদ্যোগে বন্ধ হয়েছে দ্বৈত নিবন্ধন কার্যক্রম।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০ ভাগ মানুষকে নিবন্ধনের আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন আইনে সবাইকে জন্ম ও মৃত্যুর দেড় মাসের মধ্যে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে ‘জাতীয় জন্ম নিবন্ধন দিবস’কে ‘জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

দেশ ও দেশের বাইরে পাঁচ হাজার ৫৩২টি জায়গা থেকে জন্ম নিবন্ধন করা যায়। দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের পাশাপাশি বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসে অনলাইনের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

২০০১ সালে হাতে লিখে প্রথম নিবন্ধন শুরু হয়। ২০১০ সালে ইউনিসেফের সহযোগিতায় ডিজিটাল নিবন্ধন শুরু হয়।

রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রমের শুরু থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ১৭ কোটি ৬৪ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩১ জনের। এর মধ্যে জন্মের ৫ বছরের মধ্যে নিবন্ধন হয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ১ হাজার ২১১ জনের। ২০২০ সালে জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ৩৮ লাখ ৩৯ হাজার ২৮ জনের। শুরু থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট মৃত্যু নিবন্ধন হয়েছে ৯৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯০০ জনের। এর মধ্যে ২০২০ সালে মৃত্যু নিবন্ধন হয়েছে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪০০ জনের। আর ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত জন্ম নিবন্ধন করেছে ২০ কোটি ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৭২৪ জন। দ্বৈত নিবন্ধনের কারণে সংখ্যাটি দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বড় বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা সবশেষ জনশুমারি অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৪০ লাখ ৭৭ হাজার ২০৩ জন এবং নারী ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৩ হাজার ১২০ জন। বাকিরা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী। মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ গ্রামে এবং ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ শহরে বাস করেন।বিভাগভিত্তিক জনসংখ্যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বড় বিভাগ ঢাকার গণনাকৃত জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন, সমন্বয়কৃত জনসংখ্যা হলো ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৫ জন, যা দেশের মোট সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার ২৬.৬৮ শতাংশ। সবচেয়ে কম জনসংখ্যা বরিশাল বিভাগে, মোট সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার ৫.৪৯ শতাংশ।

প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন, নারী ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। নতুন জরিপ অনুসারে পুরুষের এনসিই ২.৮১ শতাংশ, সে হিসাবে সমন্বয়কৃত পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৪০ লাখ ৭৭ হাজার ২০৩ জন, নারীর এনসিই ২.৬৯ শতাংশ, সে হিসাবে সমন্বয়কৃত নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৩ হাজার ১২০ জন। তৃতীয় লিঙ্গের জনসংখ্যা খুব কম হওয়ায় তার এনসিই হিসাব করা হয়নি।পরিশেষে বলতে চাই, জীবনের সত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হলো সঠিক জন্ম-তারিখ লিপিবদ্ধ করা- এটা বোঝানোর জন্য ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেজন্য জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীর পাশাপাশি বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিককর্মী, সাংবাদিক, লেখক-বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।তাই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সকল নাগরিকের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন তথ্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর সে লক্ষ্যে সেমিনার ও প্রশিক্ষন কর্মসূচির মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ অতীব জরুরি।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test