E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দুর্গাপূজা ও নবপত্রিকা

২০২৩ অক্টোবর ২১ ১৫:৪৪:১৪
দুর্গাপূজা ও নবপত্রিকা

গোপাল নাথ বাবুল


শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে গত শুক্রবার থেকে। বেলগাছের নিচে দেবী দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের পর আসে মহাসপ্তমী। এ পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবপত্রিকা বা কলাবউ। দুর্গাপূজায় সপ্তমীর অনুষ্ঠান শুরু হয় নবপত্রিকা বা কলাবউকে স্নান করানোর মধ্য দিয়ে। এদিনই দুর্গাপূজার ঘট স্থাপন করা হয়। পূজার দিনগুলোয় নবপত্রিকাকে দেখা যায় কাপড় দিয়ে ঢাকা অবস্থায় গণেশের পাশে থাকতে। সপ্তমী থেকে দশমী, এ ৪ দিন তাঁরও পূজা হয়। নবপত্রিকার বিসর্জনেও আলাদা নিয়ম রয়েছে। তাই জানতে ইচ্ছে হয়, এ নবপত্রিকা কী ? 

সংস্কৃত ভাষায় বলা হয়- রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ / অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ। নবপত্রিকা বাংলার দুর্গাপূজার বিশেষ একটি অঙ্গ। নবপত্রিকার আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। বাস্তবে নবপত্রিকা আসলে নয়টি পাতা নয়। এটি নয়টি উদ্ভিদের সমন্বয়। এগুলো হল-কদলী বা রম্ভা (কলা), ওলকচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান। একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল-সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার তৈরী করা হয়। এতে সিঁদুর দিয়ে গণেশের ডানদিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় এ নবপত্রিকার আর এক নাম হল কলাবউ।

নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীক। পৌরাণিক দেবী দুর্গার সঙ্গে শস্যদেবীকে মিলিয়ে দেয়ার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। যেমন-কদলি বা রম্ভা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী ; কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা ; হরিদ্রা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা ; জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী; বিল্ব বা বেল গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা; দাড়িম্ব বা ডালিম গাছের অধিষ্ট্রাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা; অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা; মানকচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুন্ডা এবং ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে পূজা করা হয়। যাদের একত্রে বলে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা’। সংস্কৃতে বলা হয়, ‘রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্চাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুন্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী।’ এ নবদুর্গার পূজার মন্ত্র হল, ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ।

মহাসপ্তমীর দিন সকালে কাছের কোনও নদী বা জলাশয়ে এটাকে নিয়ে যেতে হয়। পুরোহিত কাঁধে করে সে নবপত্রিকা নিয়ে যান। পিছনে পিছনে ঢাকিরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে যান। শাস্ত্র অনুসারে স্নান করানোর পর ওই নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয় এবং পূজামন্ডপে নিয়ে এসে দেবীর ডানদিকে একটা কাঠের সিংহাসনে একে স্থাপন করতে হয়। পূজামন্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়।

নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলোতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। নবপত্রিকায় প্রবেশের আগে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুন্ডার আবাহন ও বিনম্র চিত্তে পূজা করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনও দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না।

অনেকেই নবপত্রিকাকে মনে করেন গণেশের লাজুক বধূ। কিন্তু তা ঠিক নয়। হিন্দু লোকাচারে স্ত্রী থাকেন স্বামীর বাম দিকে। কিন্তু নবপত্রিকা থাকে গণেশের ডানদিকে। দুর্গার সৃষ্টিস্থিতিবিনাশী শক্তিরূপেই নবপত্রিকা পূজিত হন। পুরোহিত দর্পণে আছে, ‘সপ্তমীর সকালে বাদ্যধ্বনি সহকারে বিল্বশাখা ও নবপত্রিকা লইয়া পূজালয়ে প্রবেশ করিবে।’ দেবীপুরাণে নবদুর্গার কথা থাকলেও নবপত্রিকার কোনও উল্লেখ নেই। মার্কন্ডেয় পুরাণেও তার কোনও উল্লেখ নেই। কালিকাপুরাণে আবার সপ্তমী তিথিতে পত্রিকা পূজার কথা থাকলেও নবপত্রিকার উল্লেখ নেই। তবে কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্রের নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ আছে। তাই গবেষকরা মনে করেন, নবপত্রিকার পূজা আসলে শস্যদেবীর পূজা। যেখানে শস্যকেই বধুরূপে দেবীর প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। আর, সেই থেকেই এসেছে কলাবউ স্নানের প্রথা।

নবপত্রিকা সম্পর্কে গবেষক ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন, “এই শস্যবধুকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবতীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে।.....বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ। সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।”

ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের মতে, “এনাদার ইমপোর্টেন্ট এসপেক্ট অব দি দেবী ইজ হার কনসেপ্ট এস দি পারসোনিফিকেশান অব ভেজিটেশান স্পিরিট, হুইজ ইজ এমপেসাইস্ড বাই হার নেইম শাকম্ভরী অলরেডি নোটেড। দিজ ফাইন্ডস ক্লিয়ার করোবোরেশান ইন দি প্রেজেন্ট ডে নবপত্রিকাপ্রবেশা চিরমণি ইন অটামনাল ওরশিপ অব দুর্গা ইন বেঙ্গল।” যার বাংলা অর্থ-“দেবীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল উদ্ভিদের আত্মস্বরূপ হিসাবে ধারণা যা তার নাম শাকম্ভরী দ্বারা জোর দেওয়া হয়েছে, যা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলার শারদীয় দুর্গাপূজায় নবপত্রিকা প্রবেশ অনুষ্ঠানে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।”

যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখেছেন, “আমি নবপত্রিকার উৎপত্তি ও প্রয়োজন বিন্দুমাত্র বুঝিতে পারি নাই। নবপত্রিকা নবদুর্গা, ইহার দ্বারাও কিছুই বুঝিলাম না। দেবীপুরাণে নবদুর্গা আছে, কিন্তু নবপত্রিকা নাই।.....নবপত্রিকা দুর্গাপূজার এক আগন্তুক অঙ্গ হইয়াছে।.....বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা-প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে।”

তবে হংস নারায়ণ ভট্টাচার্য দুর্গাপূজার সঙ্গে শস্যদেবীর পূজার অনুষঙ্গটি স্বীকার করলেও শাকম্ভরী তত্ত্বটিকে নবপত্রিকার উৎসরূপে মানেননি।

সনাতনী সম্প্রদায়ের একাংশের মতে, যেহেতু নবপত্রিকা মহামায়ারই একটি অংশ, তাই তাঁর স্নানের জল খুবই পবিত্র। অনেকে এ জল পান করেন দীর্ঘায়ু লাভের আশায়। নবপত্রিকা যেহেতু নানা দেবীর প্রতীক, তাই তাঁর এ স্নানের জল অনেকে মাথায় ছিটান। কারণ, লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, দেবীর স্নানজল তাঁকে প্রাকৃতিক এবং দৈবিক নানা বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে। অপরদিকে নবপত্রিকার প্রতিটি শস্যই মানুষ পুষ্টির জন্য খান। আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞদের মতে, ডালিম শক্তিবর্ধক ও রক্তবর্ধক। জয়ন্তী ও অশোক মহৌষধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সর্বোপরি বলা যায়-শক্তিরূপিণী উদ্ভিদ প্রকৃতিরই অংশ এবং একেকটি উদ্ভিদের সঙ্গে দেবীর এক এক রূপের সংযোগ রচিত হয়েছে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test