E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাত : নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধ হোক

২০২৩ অক্টোবর ২২ ১৫:৩৬:১৭
ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাত : নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধ হোক

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বাংলাদেশসহ মুসলমান প্রধান দেশগুলো সবসময় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন এবং ‘নিপীড়িত’ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসলেও বড় ধরণের সংকট এলে পুরো মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় না। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি কিংবা আরব লীগও ইসরায়েলের সাথে সংকটকালে ফিলিস্তিনের পক্ষে খুব জোরালো কোন ভূমিকা নিতে পারে না।

এবার গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিতে ভয়াবহ হামলার পর নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। উভয় পক্ষের আক্রমণে বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে।তাই নিয়ম করে যেমন সূর্য উঠে এবং অস্ত যায়, তেমনি নিয়ম করে তাদের জীবনেও বারবার নির্মমতা নেমে আসে। দশকের পর দশক ধরে তা চলছে। এক সময় তাদের জমি ছিল, মাথার উপরে ছাদ ছিল। সব দখল হয়ে গেছে। সর্বশেষ আশ্রয়টুকুও দখলের পথে।পৃথিবী একটি নির্দয়-নিষ্ঠুর সময় অতিক্রম করছে। এমন সময় আগে কখনো আসেনি—বলা যাবে না। বেশ কয়েকবার এসেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারের ইহুদি নিধন, ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম অধ্যায়। তবে, এবারের নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা ও বর্বরতা একটু ব্যতিক্রমী। সমগ্র পৃথিবী এবারের বর্বরতা-নিষ্ঠুরতাকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে, যা সম্ভবত কখনো এমনভাবে দৃশ্যমান হয়নি।

বলছি ফিলিস্তিনিদের কথা। বলছি বিশ্ব শক্তির সহযোগিতায় ইসরায়েল কর্তৃক সংগঠিত দখল-হত্যা ও নিষ্ঠুরতার কথা। বিশ্বের অনেক দেশে যুদ্ধের থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। কোনো কোনো দেশের সীমান্তে যুদ্ধ চলমান অবস্থায় রয়েছে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সৌদি-ইয়ামেন যুদ্ধ, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ, পাক-ভারত যুদ্ধ, চীন-ভারত যুদ্ধ, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রগুলো চলমান। আমেরিকা-আফগানিস্তান যুদ্ধে টানা ২০ বছরের যুদ্ধ শেষে আমেরিকা ২০২১ সালে সৈন্য গুটিয়ে নিয়েছে। এসব যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ কয়েক বছর ধরে তুঙ্গে থাকলেও গত সপ্তাহ থেকে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো এখন বেশ সরগরম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, প্রায় ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ চলমান। টানা দুই সপ্তাহ পেরিয়েছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ। এতে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫৮০০ ছাড়িয়েছে। আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় ফিলিস্তিনে ৪ হাজার ৩৮৫ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ৭৫৬ জন শিশু রয়েছে। এ ছাড়া হামলায় ৯৬৭ জন নারী এবং ১১ জন সাংবাদিক রয়েছেন।

ইসরায়েলি বাহিনীর এ হামলায় ফিলিস্তিনের আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ৫০০ জন। তাদের মধ্যে ২০০০ শিশু ও ১৪০০ নারী রয়েছেন।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের এ হামলায় ১৪০০ ফিলিস্তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মধ্যে ৭২০ জন শিশু রয়েছে।

অন্যদিকে গত দুই সপ্তাহে ইসরায়েলের পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছে ৮৪ জন নাগরিক। তাদের মধ্যে ৩০ জন নারী ও শিশু রয়েছে।

এ ছাড়া এ সময়ে ফিলিস্তিনের হামলায় ইসরায়েলের ১৪০৫ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩০৭ সেনা ও ৫৭ জন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, যুদ্ধে এখন পর্যন্ত হামাসের হাতে ২১০ ইসরায়েলি সেনা ও বেসামরিক লোক বন্দি হয়েছেন। এ ছাড়া এখনো নিখোঁজ রয়েছেন আরও অন্তত ১০০ জন।

উল্লেখ্য, হামাস ২০১৭ সালের এক নীতিনির্ধারণী নথিতে ইঙ্গিত দিয়েছিল, তারা ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল যেসব অঞ্চল দখল করেছিল, সেগুলো যদি ফিরিয়ে দেয় ও অঞ্চলগুলোকে যদি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা হয়, তাহলে তারা তা মেনে নেবে।

অন্যদিকে, ইসরায়েল বরাবরই হামাসের ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও একাধিকবার বলেছেন, ইসরায়েল কখনোই ছয় দিনের যুদ্ধ দখল করা ভূখণ্ড ফেরত দেবে না বা ১৯৬৭ সালের সীমান্তে ফিরে আসবে না।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আকস্মিক রকেট হামলা চারায় হামাস। সেদিন মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে প্রায় ৫ হাজার রকেট ছোড়ে তারা। পরে সীমান্তবেড়া ভেঙে ইহুদি দেশটির অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন হামাসের যোদ্ধারা।

প্রশ্ন এখানেই, জাতিসংঘের মতো পৃথিবীতে সংঘ থাকতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত এত যুদ্ধক্ষেত্রের আবির্ভাব হয় কীভাবে? যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে বাস্তবায়নে কতটা সফল পৃথিবীর বিবেকখ্যাত এ সংঘটি?

পৃথিবীতে এসব যুদ্ধ আসলে হঠাৎ করেই সংঘঠিত হয়নি। আজ যে বড় বড় ঘটনা ঘটছে, সে ঘটনা অতীতের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রতিফলন মাত্র। অতীতের ঘটনাগুলোই বর্তমানে বড়সড় হয়ে প্রতিফলিত হয়। লেখক ও অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান তার ‘বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর’ গ্রন্থে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেপথ্যে বলেছেন, ঊনবিংশ শতকের সংঘটিত ঘটনারই প্রতিফলন বিংশ শতাব্দীতে ফল হিসেবে পৃথিবী পেয়েছিল ‘প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতে, ছোট ছোট বালুকণা/বিন্দু বিন্দু জল/গড়ে তোলে মহাদেশ/সাগর অতল। শুরুতেই যে যুদ্ধগুলোর নাম উল্লেখ করেছি সেই প্রত্যেকটা যুদ্ধ কবির পঙ্ক্তির ভাষায়, ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল। তাহলে কি আমরা বালুকণা আর বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে নিকট ভবিষ্যতে সাগর, মহাসাগরের মতো তৃতীয় কোনো বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি? কেননা, আজ যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধগুলো পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করছে, কয়েক দশক পরে এই যুদ্ধগুলোই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিয়ামক হবে না তা বেশ সন্দেহাতীত। চলমান ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে একটু জেনে আসি। তাহলে বিষয়টি বুঝতে বেশ সুবিধা হবে।

সপ্তম শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘ ১২০০ বছর ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ফিলিস্তিন তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশবলয়ের বিরুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অটোমান সাম্রাজ্য পরাজয় বরণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশবলয় জয়লাভের নেপথ্যে ছিল কৃত্রিম ফসফরাস বোম। ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বেইজম্যান সেই দুর্লভ বোমার আবিষ্কারক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটিশবলয় ড. হেইস বেইজম্যানকে তাৎক্ষণিক উপহার দিতে চাইলে ড. বেইজম্যান উপহারস্বরূপ ফিলিস্তিনের বুকে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের দাবি করে। বেইজম্যানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদি রাষ্ট্র বাস্তবায়নের জন্য ১৯১৮-১৯৪৮ পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর ফিলিস্তিনকে উপনিবেশ হিসেবে ব্রিটিশরা শাসন করতে থাকে। তখন ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনি জনগণকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার মিথ্যে আশ্বাস দেয়। মূলত ৩০ বছরে এই মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁকে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে জাহাজভর্তি করে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আশ্রয় দিতে থাকে। ১৮৭৮ সালে ফিলিস্তিনে মাত্র ৩.২ শতাংশ ইহুদির বাস করত। ১৯১৮ সালে ফিলিস্তিনে যেখানে ইহুদি ছিল মাত্র ২০ হাজার সেখানে মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে ১৯৪৮ সালে ইহুদি জনসংখ্যা উন্নীত হয় ৬ লাখে! ১৯৪৮ সালে ১৪ মে রাতের আঁধারে ইসরাইল নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশ হাত গুটিয়ে নেয়। এরপর ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের পরাজিত করে ইসরায়েল বিস্তৃত এলাকা দখল করে নেয়।

১৭ বছর ধরে গাজা অবরুদ্ধ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খোলা কারাগার। ২০০৫ সালের নির্বাচনে ফিলিস্তিনিদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাহমুদ আব্বাস। ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর আল ফাত্তাহর নেতৃত্বে আসেন মাহমুদ আব্বাস। ২০০৬ সালের প্রাথমিক নির্বাচনে পরাজিত হয় ফাত্তাহ। সেই বছরই হামাস-ফাত্তাহ গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয় ফাত্তাহ। ২০০৭ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গাজায় সরকার গঠন করে হামাস। গাজার এক পাশে ভূমধ্যসাগর, এক পাশে মিশর এবং দুই পাশে দখলদার ইসরায়েল।

পরবর্তীতে ইঙ্গো-মার্কিনের সহায়তায় ইঙ্গো-মার্কিন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘে এই বিষয়টি উত্থাপিত হয়। এতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনকে দুখণ্ড ঘোষণা করার দাবি রাখে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, পেরু প্রভৃতি রাষ্ট্র। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করে ভারত, পাকিস্তান, ইরান। তবুও স্বাধীন ফিলিস্তিনকে ভেঙে ৫৭ শতাংশ ভূমি নিয়ে ইসরাইল আর ৪৩ শতাংশ ভূমি দেয় ফিলিস্তিনকে। অথচ ইহুদি জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশ। জাতিসংঘ সেদিন একপাক্ষিক ও একচোখা সিদ্ধান্ত নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সুপার পাওয়ার তথা পরাশক্তি হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে দুটি রাষ্ট্রের। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যটি রাশিয়া। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে বলা হয় ‘স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ’। ফলে গোটা পৃথিবীটা দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। এজন্য আমরা দেখতে পাই, রাশিয়া ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেয়, অন্যদিকে আমেরিকা ইসরাইলকে সমর্থন দেয়। একটা কথা খুব জোরেসোরে মনে রাখা দরকার, রাশিয়া-আমেরিকা কোনো স্বার্থ বা লাভ ছাড়া কোনো দেশ বা যুদ্ধকে সমর্থনকে করে না এবং তাদের সমর্থনই সমস্যার ক্ষত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। তাদের সমর্থন অনেকটা কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো। যে রাশিয়া ইসরাইলের পক্ষে দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থন করেছিল সে রাশিয়া পরবর্তী সময় মজলুম ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার পেছনে স্বার্থ ও রহস্য থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মূল কারণ হলো আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের দিকে তাক করা। (বলা রাখা বাহুল্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় ইউক্রেন বর্তমান রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইউক্রেন হলো পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্র। আমেরিকা-ব্রিটিন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ন্যাটো জোট চায় পূর্ব ইউরোপে তাদের আধিপত্য ও শক্তির বলয় বিস্তার করতে। তাই ২০০৮ সাল থেকেই ইউক্রেনকে ন্যাটোর জোটে যোগ করার আশ্বাস দিয়ে আসছে। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভদিমির জেলেনেস্কি ন্যাটোতে যোগ দিতে তোড়জোড় চালাচ্ছে। যদি ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয় তাহলে রাশিয়ার শক্তি অনেকটা কমে আসবে। এজন্যই মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

এদিকে আবার চীন ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখলেও ভারত আবার ইসরাইলের দিকে ইতিবাচক। অথচ চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের ১০ লাখ উইঘুর নারী-পুরুষকে ‘চরিত্রশোধনাগার’ নাম দিয়ে নির্মমভাবে দিনের পর দিন অত্যাচার করছে। আসলে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে সমর্থন দেয় না। এভাবে যদি পরাশক্তিগুলো দুইটি শিবিরে ভাগ হয়ে একটা সমস্যাকে দুইটি ভাগে ভাগ করে ফেলে তাহলে সে সমস্যা আজীবনেও সমাধান হবে না। সমস্যা লেগেই থাকবে। আর গাজায় কাজের সংকট, খাদ্য সংকট নিত্যদিনের। কিন্তু মাদকের সংকট নেই। ইসরায়েল গাজায় হরেক রকমের মাদক প্রবেশের সুযোগ তৈরি করে দেয়। উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনিদের মাদকাসক্ত করে গড়ে তোলা।

মিশরের সঙ্গে দক্ষিণ গাজার সীমান্ত রাফাহ এখন বন্ধ। এই সীমান্ত খোলার আলোচনা চলছে। হাজারো ফিলিস্তিনি রাফাহ সীমান্তে জড়ো হয়েছে। এ কথা সত্য যে হামাস ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে নির্মমতা চালিয়েছে। প্রশ্ন এসেছে—হামাস কেন ইসরায়েলে আক্রমণ করল? কারণ হতে পারে দুটি।

প্রথমত, যেসব দেশের অবস্থান ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ও ইসরায়েলের বিপক্ষে ছিল, তারাও ক্রমান্বয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। বিশেষ করে আরব বিশ্ব, সৌদি আরব যার নেতৃত্বে। ফিলিস্তিনিরা বা হামাস মনে করছে, তাদের স্বার্থ এখন আর কেউ দেখছে না। হামাস ইসরায়েলে হামলা করে বুঝিয়ে দিলো যে, ফিলিস্তিনিদের বাদ দিয়ে কোনো শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না।

দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল প্রতিদিনই একটু একটু করে ফিলিস্তিনিদের জায়গা দখল করে ইহুদি বসতি স্থাপন করছে। ফিলিস্তিনিদের নিপীড়ন করছে, হত্যা করছে। ইসরায়েল সরকার তার নাগরিকদের নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, যা কিছুই ঘটুক না কেন, তারা নিরাপদ। হামাস আক্রমণ করে বোঝাতে চাইল ইসরায়েলি জনগণও নিরাপদ নয়।

হামাসের আক্রমণ নিয়ে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ চলছে। সেই ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের প্রায় সবই পক্ষপাতদুষ্ট। পৃথিবীর সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে, একই রকম আচরণ করছে তাদের গণমাধ্যমও। ইসরায়েলি বর্বরতাকে জাস্টিফাই করে, তারা শুধু সামনে আনছে হামাসের নির্মমতা।

ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধে গাজায় পানি নেই, জ্বালানি নেই, ওষুধ নেই। কমপক্ষে ১৫টি হাসপাতাল বোমা ফেলে ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। শিশুখাদ্য তো বটেই, সামগ্রিকভাবেই খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে গাজায়। বোমাবর্ষণ চলছে। নৌ ও স্থল আক্রমণ আরও তীব্র করার ঘোষণা দিয়ে উত্তরাঞ্চলের গাজাবাসীকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ জারি করেছে ইসরায়েল।

সবাই জানে গাজার উত্তরের ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণে চলে যাওয়ার বিষয়টি অবাস্তব, অসম্ভব। এমনিতেই গাজা ঘনবসতিপূর্ণ। উত্তরের ১০-১২ লাখ গাজাবাসীর ঠাঁই হবে না দক্ষিণে। ইসরায়েল মূলত দুটি কারণে উত্তর গাজার ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বলেছে। এর মাধ্যমে বেসামরিক ফিলিস্তিনি হত্যার বিষয়টি তারা জায়েজ করতে চায়। বলবে, আগেই তো সরে যেতে বলেছিলাম। সরে না যাওয়ায় তারা মারা গেছে। আর দ্বিতীয় বা প্রধান কারণ, গাজার উত্তর অংশে ইসরায়েল দখল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। গাজার উত্তর অংশে ফিলিস্তিনিদের আর কখনো আসতে দেবে না ইসরায়েল।

পটভূমি

এ ফিলিস্তিনি অপারেশনটি হঠাৎ ও অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু হয়ে গিয়েছিল; এমনকি হিব্রু সংবাদপত্র হারেৎজ স্বীকার করে যে, "গাজা থেকে আক্রমণটি ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দাদের জন্যে একটি বড় বিস্ময়কর ও অপ্রত্যাশিত বিষয় ছিল। অপারেশনটি পূর্বে সংঘটিত অক্টোবর যুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকীর একদিন পর হয়। দেইফ ভিডিও ক্লিপে নিশ্চিত করেছেন–যেটিতে তিনি অভিযানের প্রকৃত সূচনা ঘোষণা করেছেন–যে, অপারেশনটি "আল–আকসা মসজিদের ইসরায়েলি অপবিত্রকরণ ও অবৈধ বসতিস্থাপনকারী ইস্রাইলীদের ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার" প্রতিক্রিয়া হিসাবে শুরু হয়েছে।

হামাস নেতা সালেহ আল-আরৌরি বলেন, এ অভিযান ছিল "দখলদারী অপরাধের" সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া। তিনি আরো যোগ করেন যে, যোদ্ধারা আকসা মসজিদ এবং দখলদার ইস্রায়েলের হাতে বন্দী হওয়া হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে রক্ষা করছে। এনজিও আডমির অনুমান করেছে যে, প্রায় ৫,২০০ জন ফিলিস্তিনি বন্দী রয়েছেন; যাদর মধ্যে ৩৩ জন মহিলা এবং ১৭০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক।

ফিলিস্তিনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের শোক দিবস ঘোষণা করেছেন

ফিলিস্তিনের জন্য ২১ অক্টোবর শনিবার শোক দিবস ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শনিবার ফিলিস্তিনের জন্য আমাদের শোক দিবস ঘোষণা করেছি। সেদিন আমাদের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখেছে। শুক্রবার জুমার পর সারাদেশের মসজিদগুলোতে দোয়া ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনারও অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী। সেই মোতাবেক শুক্রবার (২০ অক্টোবর) সারাদেশে মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের পর ফিলিস্তিনের মজলুম স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ-পরবর্তী মোনাজাতে অংশ নিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে চোখের পানি ফেলেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ফিলিস্তিনের শান্তিকামী মানুষের জন্য শূন্যে দুই হাত তুলে দোয়া করেন মহান রবের দরবারে। ধ্বংসলীলার পরিবর্তে সৃষ্টিকর্তা যেন শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন সেই প্রার্থনা করেন তারা।শুধু মসজিদ নয়, এদিন অন্য ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রার্থনা করা হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান পৃথিবীতে চলমান এই ছোট ছোট যুদ্ধক্ষেত্রগুলোই আগামীর পৃথিবীতে ভয়াবহ এক সমস্যা সৃষ্টি করবে, যার বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে আরেকটা নরকীয় হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এক্ষুণি থামানো দরকার। ফিলিস্তিন-ইসরাইলকে শুধু সমর্থন নয়, তাদের নিজ নিজ অধিকার বুঝিয়ে দেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, ইসরাইল পারমাণবিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। ইসরাইলকে এখন সম্পূর্ণ উৎখাত করে সমস্যা সমাধান করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শুরুতে ৪৩ শতাংশ ভূমি দিয়ে ফিলিস্তিনকে যে ভূমিখণ্ড দেয়া হয়েছিল সে ফিলিস্তিনকে ৪৩ শতাংশ ভূমিতেই স্বাধীন ফিলিস্তিন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হোক। তাদের আরও ভাবা উচিত, সমাজ এক অখণ্ড জিনিস। অনেকগুলো উপাদান নিয়ে সমাজ গঠিত হয়। পৃথিবীর এক কোণের কোনো সমাজে বিপ্লব হলে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এসে ধাক্কা সে যুদ্ধের হাওয়া লাগে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। পুরো পৃথিবীতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে।

জাতিসংঘের এখনই উচিত স্বাধীন ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেয়া। এই ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে আরও শক্ত হস্তে দমন করতে হবে, অনেকটা কঠোর হতে হবে। পৃথিবীর মানুষ রাশিয়া-আমেরিকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, রাজনৈতিক স্বার্থে রক্তারক্তি খেলা আর পুনরায় দেখতে চায় না। এই রক্তারক্তি খেলা বন্ধ হোক। নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধ হোক।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test