E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আনন্দ-বেদনার বিজয়া দশমী

২০২৩ অক্টোবর ২৪ ১৪:১৯:৩০
আনন্দ-বেদনার বিজয়া দশমী

গোপাল নাথ বাবুল


গ্রাম বাংলার এক চিরায়ত উৎসবের রূপ এ দুর্গোৎসব। বর্তমানে গ্রামের গন্ডী পেরিয়ে এ উৎসব বাংলার শহর-নগরসহ সারাবিশ্বে মহাআড়ম্বরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে ঘুরে ঘুরে মন্ডপে মন্ডপে দেবী দর্শন করে বলেই সার্বজনীন রূপ পেয়েছে এ উৎসব। এ উৎসব বাঙালির অসম্প্রদায়িক চেতনার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে মর্ত্যবাসীর মনে-বুকে সাহস যোগান। কারণ, দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মানুষকে মহৎ হতে প্রাণিত করেন। মানুষের মনের দৈন্যতা ও কলুষতা দুর করেন এবং অন্যায় ও অসত্যকে ধ্বংস করে সত্য, সুন্দর, শুভ ও ন্যায়ের সংগ্রামে মর্ত্যবাসীকে সাহসি করে তোলেন। 

কিন্তু কথায় আছে, আনন্দের দিনগুলো দ্রুত ফুরিয়ে যায়। একটি দিন যেন ঘন্টায় আর একটি ঘন্টা যেন মিনিটে ফুরায়। মহাআড়ম্বরে সবান্ধবে পূজামন্ডপে ঘুরাঘুরি করতে করতে কখন জানি মহাষষ্ঠী থেকে মহানবমীর রজনি শেষ হতে চলেছে, তা বুঝতেও পারলাম না। সুতরাং নবমীর নিশি কেটে পরের দিনের সূর্য উঁকি দেওয়া মানে পূজা শেষের ঘণ্টা। অর্থাৎ মায়ের ফিরে যাওয়ার পালা। নিয়মানুযায়ী পিতৃগৃহ ছেড়ে উমা এবার ফিরে যাবেন কৈলাশে স্বামী মহাদেবের কাছে। তাই মর্ত্যবাসীর মন খারাপ। কিন্তু হাজারও মন খারাপের মধ্যেও হাসিমুখে সিঁদুর খেলা ও মিষ্টি মুখের মাধ্যমে মহা আড়ম্বরে ঘরের মেয়েকে তাঁর শ্বশুর বাড়ি পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সবাই।

‘দশম’ মানে হচ্ছে গাণিতিক দশ সংখ্যাটির ক্রমবাচক রূপ। আর ‘দশম’ শব্দের সঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে দশমী হয়েছে, যা একেবারে সহজবোধ্য বিষয় বলা যায়। কিন্তু শরতের বিজয়া দশমীর ‘দশম’ শব্দটির ভিন্ন অর্থ ও আলাদা তাৎপর্য বহন করে। এখানে দশমীর আগে বিজয়া শব্দটি যুক্ত হয়েছে।
মাতৃরূপিণী মহাশক্তি শ্রী শ্রী দুর্গা অশুভ শক্তির কবল থেকে বিশ্বব্রহ্মান্ড ও ভক্তকুলকে রক্ষা করেন। এ অমিত চেতনার সংগে আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতি যুক্ত হয়ে দেবী দুর্গাকে বাঙালি সনাতনি সমাজ ‘ঘরের মেয়ে’ হিসেবে বরণ করে নেন। তাই কন্যা যেমন পিতৃগৃহ থেকে স্বামীগৃহে যাবার সময় প্রত্যেক পরিবারে বিষাদের ও বেদনার ছায়া নেমে আসে, ঠিক তেমনি দশমী তিথির দিন দেবী দুর্গার স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তনে মর্ত্যবাসির মনেও বিষাদের ও বেদনার ছায়া নেমে আসে। কেননা, এ দিনেই দেবীর প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়।

কিন্তু এ দিনটিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয় কেন বা দশমীর আগে ‘বিজয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় কেন অথবা এ বিজয় কোন বিজয়কে চিহ্নিত করে ? এ সম্পর্কে জানতে হলে অনেক পৌরাণিক কাহিনী ঘাটতে হবে।

মূলত এদিনে মাতৃরূপেন দেবী মহাবলী পদ্ম নামক দৈত্যকে বধ করে ধর্ম সংস্থাপন করেছিলেন এবং বিজয়া হয়েছিলেন। তাই প্রাচীনকালে রাজারা এদিনে যুদ্ধযাত্রা করতেন। পুরাণের ‘মহিষাসুর বধ’ কাহিনী অনুযায়ী, ‘কোনো পুরুষই মহিষাসুরকে বধ করতে পারবেন না’ ব্রহ্মা কর্তৃক এমন বর পেয়ে মহিষাসুর অহংকারী হয়ে উঠেন। কারণ, কোনো পুরুষ তাঁকে বধ করার মতো শক্তি রাখেন না। এ ভেবেই তিনি স্বর্গ-মর্ত্য জয় করে নেন, এমনকি স্বর্গের রাজা ইন্দ্রকেও স্বর্গ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। তখন সকল দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে শ্রী শ্রী দেবী দুর্গা আবির্ভূত হয়ে মহিষাসুরের সাথে টানা ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করে মহিষাসুরকে বধ করেন। এর মধ্যে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম এ ৪ দিনের যুদ্ধ ছিল খুবই ভয়াবহ। ফলে দশমীর দিন দেবী দুর্গা বিজয় লাভ করেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গরাজ্য ফিরে পেলেন ও স্বর্গে-মর্ত্যে সুখ-শান্তি ফিরে এলো। একে উপলক্ষ্য করে হলো বিজয়োৎসব। তাই এ দিনটাকে ‘বিজয়া দশমী’ বলে অভিহিত করা হয়। আবার শ্রী শ্রী চন্ডীর কাহিনী অনুসারে আর্শ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী দুর্গা আবির্ভূতা হন এবং শুক্লা দশমীতে মহিষাসুরকে বধ করেন। সে হিসেবে এ দিনটি ‘বিজয়া দশমী’।

রামায়ণের কাহিনী অনুযায়ী, ত্রেতাযুগে শ্রীরাম সীতা উদ্ধারে গিয়ে লঙ্কার রাজা রাবণ বধে ব্রহ্মার নির্দেশে অকালবোধন (শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত এ ৬ মাস দক্ষিণায়নে দেবতারা নিদ্রিত থাকেন, সেজন্য দেবীকে বোধন করে জাগাতে হয়) করে দুর্গাপূজা করেন। ফলে আর্শ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে শ্রীরাম রাবণ বধ করেছিলেন। এজন্য উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীরা এ দিনে ‘দশেরা’ অনুষ্ঠান উদযাপন করেন। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘দশহর’ থেকে, যা দশানন রাবণের মৃত্যুকে চিহ্নিত করে।

কিন্তু মাইসোর দশেরা পালন করা হয় দেবী দুর্গা কর্তৃক মহিষাসুরকে বধ করার স্মরণে। কালিদাশের রঘুবংশ, তুলসিদাসের রামচরিতমানস কিংবা কেশবদাসের রামচন্দ্রিকায় এ সূত্রের সংগে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে, রাবণ বধের পরে আর্শ্বিন মাসের ৩০তম দিনে অযোধ্যায় ফিরেন রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ। এ সময় রাবণ বধ ও রামের ফিরে আসার আনন্দে অযোধ্যাবাসী দশেরা ও দীপাবলী পালন করেন।

অন্যদিকে এ দিনের তাৎপর্য নিহিত রয়েছে মহাভারতেও। ১২ বছর অজ্ঞাত বাস শেষে আর্শ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে পান্ডবরা শমীবৃক্ষে লুকানো তাঁদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিলেন এবং ছদ্মবেশ ছেড়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন। এসবই ‘বিজয়া দশমী’র তাৎপর্য বৃদ্ধি করে।

তাহলে বিসর্জন কেন দেওয়া হয়? কারণ, সনাতনী শাস্ত্রমতে, দেবীকে পূজার জন্য আহ্বান করে মাটির প্রতিমায় স্থাপন করে সাকাররূপে দেবীর পূজা করা হয়। পূজা শেষে নিরঞ্জনের মাধ্যমে দেবীকে মাটির প্রতিমা থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং দেবী নিরাকার রূপে স্বামীরগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। অনেকে প্রতিমা বিসর্জন না দিয়ে রেখে দেন। এতে প্রতিদিন পূজা করতে হয়। যেমন, চট্টগ্রামের দোহাজারী দক্ষিণেশ্বরী কালী মন্দিরের দুর্গা প্রতিমা প্রস্তরের তৈরি বলে বিসর্জন দেওয়া হয়না। এ মন্দিরে সারাবছর নিত্য দেবীর পূজা করা হয়।

বিজয়ায় বিসর্জন মানে মাকে ত্যাগ নয়, বিশেষরূপে অর্জন। এ কয়েকদিনের পূজাশেষে যে জ্ঞান অর্জিত হলো, তা হচ্ছে, মা স্বস্থানে অর্থাৎ কৈলাসে ফিরে গেলেন। এ অবস্থায় মা নিরাকারা। চর্মচক্ষের বাইরে চলে গেলেন। ‘নিরাকারা চ সাকারা সৈব....।’ (প্রাধানিক রহস্য-২৯, শ্রী শ্রী চন্ডী)

বিসর্জনের ব্যাপারে শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের এক ব্যাখ্যা রয়েছে। রাণী রাসমনির জামাতা মথুরবাবু একবার আবেগের বশে দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন দেবেন না বলে ঠিক করেন। তাঁর যুক্তি ছিল-বাড়ির মা দুর্গাকে কীভাবে জলে ভাসাবেন ? তখন শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুর মথুরবাবুকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, বিজয়ার অর্থ মা দুর্গা এবং তাঁর সন্তানদের সঙ্গে বিচ্ছেদ নয়। মা কয়েকদিন বাড়ির দালানে বসে পূজো নিয়েছেন, এবার থেকে মা হৃদমন্দিরে বসে পূজো নেবেন। শাস্ত্রমতে, যিনি সাকার তিনি আবার নিরাকার। দেবী সাকাররূপে মর্ত্যে পূজো নিয়ে নিরাকাররূপে কৈলাসে গমন করেছেন। এ ব্যাখ্যায় মথুরবাবু সন্তুষ্ট হলেন এবং প্রতিমা বিসর্জনের অনুমতি দেন।

বিসর্জন শব্দটি বি-সৃজ ধাতু থেকে উৎপন্ন, বিশেষ প্রকারে সৃষ্টি করা। যে মাতৃপূজা করলাম, সেই মায়ের সর্ব মঙ্গলাকারিণী স্নেহসুন্দরভাবে ও চরিত্রকে নিজের অন্তরে বিশেষভাবে সৃষ্ট, অর্থাৎ দৃঢ়নিবন্ধ করে তোলা চাই। মায়ের সেবায় আমাদের বৃত্তিগুলোকে নিয়োজিত করি, তখনই হয় বিসর্জনের স্বার্থকতা।

মা দুর্গা সাধারণের কাছে দেবী দুর্গা, মহামায়া, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, শ্রী শ্রী চন্ডী প্রভৃতি নামে পরিচিত। সর্বশক্তি স্বরূপিনী আদ্যাশক্তি হলেন এ মা দুর্গা। তাঁর দুর্গা নামটির মধ্যেই অসুর শক্তি নাশের পরিচয়। তিনি দুর্গ নামের এক দৈত্যকে বধ করে দুর্গা নামে খ্যাত হন। যুগে যুগে দেবতাদের কল্যাণের জন্য দেবী দুর্গা অত্যাচারী ভোগলোলুপ অসুরদের নিধন করেছিলেন। মা দুর্গা শত্রু বিনাশে যেমন ভয়ঙ্করী আবার ভক্ত বা সন্তানের কাছে তিনি স্নেহময়ী জননী, কল্যাণ প্রদায়িনী। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-“ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে বাঁ হাত করে শঙ্কা হরণ। দুই নয়নে স্নেহের হাসি ললাট নেত্র আগুনবরণ।”

বিজয়া দশমীর দিন তেল, পান দ্বারা দেবীকে বরণের মধ্য দিয়ে বাংলার সকল সধবা নারীরা সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেন। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন মানবকুল। চলে মিষ্টিমুখ। বিশ্ব সংসারে ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। আর এখানেই বিজয়া দশমীর বিশেষত্ব ও সার্থকতা।

সুতরাং আসুন, আজকের এদিনে ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, রাজা-প্রজা, পন্ডিত-মূর্খ বিবেচনা না করেই সবাই একাত্মবোধে আবদ্ধ হই এবং দূর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মায়ের কাছে প্রার্থনা করি- যেভাবে মধুকৈটব, শুম্ভ-নিশুম্ভ, মহিষাসুর, দূর্গমাসুরসহ বিভিন্ন দৈত্যাদিকে ধ্বংস করে স্বর্গবাসী ও মর্ত্যবাসীকে দূর্গতি থেকে রক্ষা করেছিলেন, ঠিক সেভাবে যেন ধর্ষকাসুর-বলাৎকারাসুরদের অন্তর থেকে অসুরবৃত্তি বিনাশ করে তাদের মানুষ হওয়ার সুযোগ দান করেন এবং সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে জর্জরিত এ মানুষগুলোর অন্তর যেন মায়া-মমতায় পরিপূর্ণ করে দিয়ে বাঙালির অসম্প্রদায়িক চেতনার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে মর্ত্যবাসীর মনে-বুকে সাহস যোগান এবং শরতের শুভ্র কাশফুলের মত অস্থির বসুমাতার অস্থির সন্তানদের হৃদয়েও পুণ্যের শ্বেতশুভ্র পুষ্পরাশি প্রস্ফুটিত হোক। এটাই হোক বিজয়া দশমীর প্রত্যাশা। অতএব, সবাইকে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test