E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

২০২৩ নভেম্বর ২০ ১৬:৩৯:৪৪
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

গোপাল নাথ বাবুল


এ সুন্দর পৃথিবীতে এমন কিছু নৃশংস ঘটনা ঘটে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য স্মৃতিতে ধরে রাখা প্রতিটা নাগরিকের কর্তব্য। কারণ অতীতের এসব ঘটনা এক সময় ইতিহাসে রূপ নেয় এবং এসব ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, কাঁদায়, তাড়িত করে, মানুষকে তাদের অতীত জানতে সাহায্য করে। কথায় আছে, ইতিহাস জীবন্ত, ইতিহাস কথা বলে।

১৯৮৭ সালের একদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা, বর্তমানে বিজয়নগর উপজেলার নিদারাবাদ গ্রামের শশাঙ্ক দেবনাথকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। গ্রামবাসী বা তাঁর পরিবার কেউ জানতেন না, শশাঙ্ক কোথায়। তার ঠিক ২ বছর পর ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ উধাও হয়ে যান শশাঙ্কের পুরো পরিবার। এক রাতেই হাওয়া হয়ে গেলেন শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী বিরজাবালা (৪৫) সহ তাঁর ৫ সন্তান যথাক্রমে কন্যা নিয়তিবালা (১৭), প্রণতিবালা (১০), পুত্র সুভাষ দেবনাথ (১৪), সুপ্রসন্ন দেবনাথ সুমন (৫) ও সুজন দেবনাথ (২)।

শশাঙ্ক আগেই ভারতে চলে গিয়েছে। তারপর সুযোগ বুঝে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের অতি সঙ্গোপনে নিয়ে গেছে। এমন একটি বক্তব্য পরেরদিন সকাল থেকে কয়েকজন গ্রামবাসী পুরো গ্রামে প্রচার করতে থাকেন। এমনকি কয়েকজন দাবি করতে থাকেন যে, শশাঙ্ক নিজেই তাঁর বাড়িঘর ও জায়গাজমি দাবিকৃতদের কাছে বিক্রি করে গেছেন। দাবিকৃতদের একজন ছিলেন তাজুল ইসলাম, পরে যিনি কসাই তাজুল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শশাঙ্কের সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দাবিকৃতদের মধ্যে একাধিকবার ঝগড়াঝাটি হলেও এক সময় তা আবার মিটেও যায়।

এমন ঘটনায় শশাঙ্ককে সবাই গালাগাল করতে থাকে। শালা মালাউনের বাচ্চা মালাউন, এক সম্পত্তি তিন জনের কাছে বিক্রি করে গেছে। বেঈমান, মীরজাফর, দেশদ্রোহী ও মোনাফেক ইত্যাদি বলে। কসাই তাজুলের নেতৃত্বে শশাঙ্কের সম্পত্তি ক্রয়ের দাবিকৃত খুনিরা নিরীহ শশাঙ্কের পরিবারের ৬ সদস্যকেই গ্রামের প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে ধুপাজুড়ি বিলে নিয়ে খুন করে টুকরো টুকরো করে কেটে ড্রামে চুন মিশিয়ে তাতে লাশ ভরে বিলে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনার ১১ দিন পর ওই গ্রামেরই এক শিক্ষক আবুল মোবারকের মাধ্যমে এ ঘটনা প্রকাশ পায় এবং শশাঙ্কের স্ত্রী বিরজা বালা ও তাঁর ৫ অবুঝ সন্তানের টুকরো লাশে ভরা ২টি ড্রাম পানির তলা থেকে তুলে আনা হয়। ওই ৬ খুনের ঘটনার কথা মনে করে এখনও নিদারাবাদের মানুষ আঁৎকে ওঠেন। নৃশংসতার দিক দিয়ে এ ঘটনা এতটাই আলোচিত ছিল যে, পরবর্তীতে এ ঘটনা অবলম্বনে ‘কাঁদে নিদারাবাদ’ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়।

উল্লেখ্য তাজুল ইসলামকে বিরজাবালা ধর্মবাবা বলে ডাকতেন। এ সুযোগেই কসাই তাজুল ইসলাম শশাঙ্কের সম্পত্তির খুঁটিনাটি জেনে নিয়ে ভূয়া দলিল তৈরি করে শশাঙ্কের সম্পত্তিগুলো তার আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা চালায় একেবারে পুরো পরিবারটাকেই খুন করে। সামান্য কিছু সম্পত্তির লোভেই তাজুল নামের এ কসাই পুরো একটি পরিবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। এর ২ বছর আগে শশাঙ্ককেও একইভাবে খুন করে এ কসাই।

এ নৃশংস ঘটনার ঠিক ১৪ বছর পরে আরেক নৃশংস ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়েনের শীলপাড়ায়। দেশে-বিদেশে আলোচিত এবং সমালোচিত এতবড় নৃশংস ঘটনার মামলাটি ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও বাদীপক্ষ কোনো বিচার পাইনি। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নিঃস্ব হয়ে গেছে মামলার বাদী ডাক্তার বিমল শীল। এভাবে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বিচারের কাজকে প্রভাবিত করে এবং খুনিরা আরও নৃশংস ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত হয়।

২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের শীলপাড়ায় রাতের অন্ধকারে ডাকাতরূপী একদল নরপশু এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বিশাল দোতলা মাটির ঘরের বাইরে থেকে প্রায় ৮টি দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে ন্যাক্কারজনক ও নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারে ১১জন সংখ্যালঘু হিন্দুকে। নিহতরা হলেন তেজেন্দ্র শীল (৭০), বকুল বালা শীল (৬০), অনিল কান্তি শীল (৪২), স্মৃতি রানী শীল (৩০), সোনিয়া শীল (৭), রমণী শীল (১১), বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদী শীল (১৭), এ্যানী শীল (১৫), দেবেন্দ্র শীল (৭০) এবং ৪ দিনের শিশু কার্তিক শীল।

আর এ মামলার আসামিরা হলেন-আব্দুল করিম (কালা করিম), আহমদ মিয়া (তোতাইয়া), মাহবুবুর রহমান (মাহবুব আলি), জাবেদ হোসেন, মো. হাসান (আর্মি হাসান), সরওয়ার উদ্দিন, আবু তৈয়ব, মো. শাহাজান, আমিনুল হক, শাহজাহান (দুলামিয়া), আকবর আলি, আহমদ হোসেন, মতলব, সফিউল আজম, জসিম উদ্দিন, আমিনুর রহমান চৌধুরী (আমিন চেয়ারম্যান), আমিনুল হক (আমিনিক্যা), আনুমিয়া, মো. সেলিম, বক্কর, রুবেল, আজগর (রুবেল), আবু, অজি আহমদ, আজিজ আহমদ, ফজল কাদের (ফজল্যা) এনাম, লেদু, কামরুল ইসলাম, আমির হোসেন, নুরুল ইসলাম (বাইট্যা), মো. ইউনুছ, আবুল কালাম, নুরুন্নবী (কালাইয়া), রশিদ আহমদ, আব্দুল নবী, সবুর আহমদ (মাজু)।

মামলার বাদী বিমল বাবু জানান, ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে তার স্ত্রী, তিন বছর ও এক বছর বয়সি দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে নগরীতে তার শ্বশুরের বাসায় গিয়েছিলেন। আর বিমল নিজে বাড়িতে ছিলেন। দুই তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে জীবন বাঁচালেও পা ভেঙ্গে বেশকিছু দিন তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, “আমার স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান বাড়িতে থাকলে তাদের কী পরিণতি হত ঈশ্বর জানে।”

উক্ত হত্যাকান্ডটি ঘটানোর পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিন্দা জানিয়ে ওই মামলায় সহযোগীতার আশ্বাস দিলেও পরবর্তীতে কেউ খোঁজ-খবর নেন নি বলে জানিয়েছিলেন বাদী ডাক্তার বিমল শীল ২০১৭ সালের ১১ জনের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে। এ খবর জানার পর থেকে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর্থিকভাবে সহযোগীতা করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় চার্জশিট পরিবর্তন করে সর্বশেষ ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি ৩৯ জনকে আসামি এবং ৫৭ জনকে সাক্ষী করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিআইডি’র এএসপি হাচিং প্রু আদালতে সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করেন। পরে রাজনৈতিক বিবেচনায় এক আসামিকে বাদ দেয়ায় আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮ জনে। এমন ন্যাক্কারজনক ও নৃশংস ঘটনাটি ঘটানোর পর দীর্ঘ ২০ বছর হতে চললেও এখনও পর্যন্ত মামলার সুরাহা হয়নি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, একে একে ৪ বার চার্জশীট পরিবর্তন করা হলেও ওই মামলার প্রধান আসামি বিএনপি নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনো বারই অভিযোগ করা হয়নি। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়-স্বজনসহ আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত অন্যায় করে পার পাচ্ছেন না, সেখানে একজন বিএনপি নেতার ভাই হওয়ার কারণে একটা ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বাদীর বার বার আবেদনের পরেও অভিযোগ গঠন করা হয়নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা সাম্প্রদায়িক ঘটনার ইতিহাসে একটি ন্যাক্কারজনক স্বজনপ্রীতির উদাহরণ হয়ে থাকবে। বর্তমানে আসামিরা শার্টের বোতাম খুলে দিয়ে হাওয়া খেয়ে সবার সামনে ঘুরে বেড়ালেও প্রশাসনের দৃষ্টিতে তারা সবাই পলাতক বলে জানা যায়।

মামলাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়, চট্টগ্রাম তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার কাজ চলছে। গত ২০ বছরে ৫৭ জনের মধ্যে সাক্ষী দিয়েছেন মাত্র ২৭ জন। হারাধন শীল নামক একজন সাক্ষী মারা যাওয়ায় আরও ২৯ জনের সাক্ষী বাকি রয়েছে। তাই বাকি সাক্ষীদের অপেক্ষায় বিচার কাজ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

মামলার পিপি এডভোকেট ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী জানান, ‘পুরানো মামলা হওয়ায় সাক্ষীদের অনেকে সাক্ষ্য দিতে আসে না। এছাড়া সাক্ষ্য দিতে না আসায় এ মামলায় অনেক সাক্ষীর নামে ওযারেন্ট হয়েছে। পুলিশও তৎপর আছে তাদের হাজির করতে। কয়েকজন হাজির হলেও কিছু বলতে রাজি হয় না। এখন গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকজনের সাক্ষ্য নিয়ে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রপক্ষ। আশা করা যায়, আগামী বছর মামলাটি নিষ্পত্তি করা যাবে।’

তিনি আরও বলেন, মামলার বাদীর সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে। সাক্ষীদের উপস্থিত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শত শত পাড়া-প্রতিবেশির সামনে এমন ন্যাক্কারজনক মর্মান্তিক ঘটনাটি সংঘটিত হলেও দীর্ঘ ২০ বছরেও এ মামলার কোনো কুলকিনারা না হওয়ায় দেশবাসী হতাশ।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কিছুটা হতাশ স্বরে মামলার বাদী বিমল শীল বলেন, ‘মামলার তারিখ পড়লে আদালতে আসি। এছাড়া মাঝেমধ্যে অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ নিতে আসি। গত ২০ বছরে এভাবেই আসা-যাওয়া চলছে। কিন্তু মামলার কোনও কিনারা হয় না। এটা নিয়ে আমি হতাশ। কোথায়, কার কাছে গেলে বিচার পাব জানি না।’

শীল পাড়ায় যান না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. বিমল বলেন, ‘মাঝেমধ্যে যাই। গ্রামের বাড়িতে গেলে মনে হয়, প্রাণ হারানো স্বজনেরা জিজ্ঞেস করছেন, আসামিদের শাস্তি কবে হবে। শ্মশানের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের কিছুই বলতে পারি না। তাঁদের যে কবে বলতে পারব, আসামিদের শাস্তি হয়েছে।’
দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চলতে থাকা মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সহায়তা চান বিমল বাবু। তিনি জানান, ঘর তৈরির জন্য গত বছর তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক অনুদান চেয়েছিলেন। এতে সায় দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেঁচে যাওয়া তিন ভাইকে ৪৫ লাখ টাকা দেন। সে টাকা খরচ করে আলাদা তিনটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর বেশিরভাগ কাজ শেষ। ছোটখাট কিছু কাজ বাকি আছে। সে ঘর তৈরি হলে বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারবেন বলে আশা করেন মামলার বাদী ডা. বিমল শীল।

আলোচিত এ হত্যাকান্ডের বিচার গত ২০ বছরেও না হওয়ায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত হতাশা প্রকাশ করে একটি জাতীয় পত্রিকাকে জানান, “দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে অনেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উৎসাহিত হন। এর উদাহরণ বাঁশখালীর এই হত্যাকান্ড।”

তিনি আরও বলেন, ‘নিরাপত্তাহীনতার কারণে সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়ছেন। এ জন্য সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নসহ কয়েকটি দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এখনও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। এ কারণে দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।’

সুতরাং এমন নৃশংস ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ওই নারকীয় হত্যাকান্ডের সুষ্ঠ বিচারের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধতা কামনা করে দ্রুত বিচারের দাবি জানাচ্ছি। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ বর্তমান আইনমন্ত্রীর জরুরি সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test