E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভূমিকম্পে কাঁপল বাংলাদেশ, প্রয়োজন জনসচেতনতা 

২০২৩ ডিসেম্বর ০২ ১৭:০৩:২২
ভূমিকম্পে কাঁপল বাংলাদেশ, প্রয়োজন জনসচেতনতা 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। শনিবার (২ ডিসেম্বর) সকাল নয়টা ৩৫ মিনিটে এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এটি অন্তত কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। প্রাথমিকভাবে ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল কুমিল্লা বলে গুগলের অ্যান্ড্রয়েড আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেম থেকে জানা যায়। অন্তত কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হ‌ওয়া এই ভূমিকম্পে রাজধানীতে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। গুগলের অ্যান্ড্রয়েড আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেম তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়েছে, ভূমিকম্পটি ৫ দশমিক ২ মাত্রার ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে এতে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।এদিকে উরোপীয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমএসসি) ও মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানায়, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল কুমিল্লা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণপশ্চিমে এবং লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে। ভূপৃষ্ঠ থেকে এর গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫.৫।আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.৬। ভূমিকম্পটির উৎপত্তি ঢাকা থেকে ৮৬ কিলোমিটার দূরে, কুমিল্লায়।

ভারতের ভূমিকম্প বিষয়ক সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি জানিয়েছে, বাংলাদেশ সময়ে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে হ‌ওয়া ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ৫৫ কিলোমিটার।

এদিকে রাজধানীর বাইরে রায়পুরা, ভোলা, খুলনা, কোটালীপাড়া, চট্টগ্রাম, দেবীদ্বার, ঝালকাঠি, বরগুনাতে তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বলে জানিয়েছেন এসব এলাকার প্রতিনিধিরা। তবে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, চলতি বছরেই মোট ১১ টি ভূমিকম্প দেখেছে দেশ। প্রথম ভূমিকম্প অনুভূতি হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি।

৩ দশমিক ৯ মাত্রার এ ভূমিকম্পে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের পাশাপাশি কেঁপে ওঠে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলাও। এরপর আরো ১০ টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে এসব ভূমিকম্পে কোনো ক্ষয়ক্ষত হয়নি। গত ০২ অক্টোবর ২০২৩) সন্ধ্যা ৬ টা ৪৫ মিনিট ভূকম্পন অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ভারতের মেঘালয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মেঘালয়ের রেসুবেলপাড়া থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও নেপাল, ভূটান এবং চীনেও অনুভূত হয়েছে এর কম্পন।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে ৪ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ওই ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ৫ কিলোমিটার। ৯ সেপ্টেম্বর ভারতের আসাম রাজ্যে ৪ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলা।

এ ছাড়া ২৯ আগস্ট সিলেট মহানগরীর আশপাশ এলাকায় ৩ দশমিক ৫ মাত্রার মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তাপুরে ছিল এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল।

১৪ আগস্ট সিলেটে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। একই সঙ্গে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায়ও এটি অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল আসামের মেঘালয়, গভীরতা ছিল ৩৫ কিলোমিটার।

গত ১৬ জুন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ, মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৫।

এর আগে ৫ জুন ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে বঙ্গোপসাগরে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের কাছে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে।

ঠিত এর এক মাস আগে গত ৫ মে রাজধানীতে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার সিটি সেন্টার থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে দোহারে। এ ছাড়া গত ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রামে ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পন অনুভূত হয়।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে ৪ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে বাংলাদেশের কক্সবাজারেও ভূকম্পন অনুভূত হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৪টি মাঝারি মানের ভূমিকম্প বাংলাদেশ ও এর আশপাশ অঞ্চলে হয়েছে, যার অধিকাংশেরই উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত; বিশেষ করে ত্রিপুরা, আসাম ও মিজোরাম অঞ্চলে। ১৯৮৮ সালে ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প সিলেট অঞ্চল বেশ জোরেশোরে কেঁপে উঠে, যার স্থায়িত্ব ছিল ৫০ সেকেন্ডেরও বেশি। আর এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এবং এর পরের বছর ১৯৮৯ সালে ফের সিলেট ও এর আশপাশ এলাকা প্রায় ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে।

২০০৭ ও ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এলাকাগুলোতে ৫.৩ মাত্রার ভূকম্পন সংঘটিত হয়। ২০০৩ সালে পার্বত্য অঞ্চলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যার স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৪০ সেকেন্ডের মতো। সেসময় পুরো পার্বত্য এলাকাজুড়েই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি হয়েছিল, যদিও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ২০২১ সালে ২ ফেব্রুয়ারির সকাল ৬টায়, ৭ জুলাই বিকাল ৩টা ও অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে মোট তিনটি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, যার স্থায়িত্ব ছিল ৩০ থেকে ৫০ সেকেন্ডের মতো। ২০২২ সালে ৩০ অক্টোবর ৪.৩ মাত্রার একটি ৪০ সেকেন্ড স্থায়িত্বের ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৮ সালে তিনবার, ২০১৯ সালে একবার, ২০২০ সালে দুবার, ২০২১ সালে তিনবার ও ২০২২ সালে একবার ভূকম্পন হয়েছে এ অঞ্চলে, যার গড় মাত্রা ছিল ৪.১ থেক ৫.৬ এর মধ্যে।তবে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার চেয়ে এ সম্পর্কে সচেতন হওয়া বেশি জরুরি। ভবন বানানোর সময় যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে চলা, সর্বোপরি ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে করণীয় কী, সেসব জানা জরুরি।ভূমিকম্প হচ্ছে ভূমির কম্পন।ভূ অভ্যন্তরে যখন একটি শিলা অন্য একটি শিলার উপরে উঠে আসে তখন ভূমি কম্পন হয়।

পৃথিবী পৃষ্ঠের অংশবিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনই ভূমিকম্পন। হঠাৎ যদি ঘরের কোনো জিনিস দুলতে শুরু করে—যেমন, দেয়ালঘড়ি, টাঙানো ছবি বা খাটসহ অন্য যেকোন আসবাব—বুঝতে হবে ভূমিকম্প হচ্ছে। সহজ কথায় পৃথিবীর কেঁপে ওঠাই ভূমিকম্প।আর ভূমিকম্প এটি এমন একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ, যার পূর্বাভাস দেয়ার উপায় এখনো বিজ্ঞানীরা বের করতে পারেনি। আমাদের দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে মানুষ বাড়ার পাশাপাশি আবাসিক-অনাবাসিক স্থাপনা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু সেইসব স্থাপনা কতটা মান সম্পন্ন, বড় ধরনের ভূমিকম্পে সেগুলো টিকে থাকবে কি না এই আশঙ্কা প্রবল। ভূমিকম্পের মতো দূর্যোগে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গাও নেই আমাদের বড় শহরগুলোতে। অভিযোগ রয়েছে, দেশে ভবন নির্মানে বিল্ডিং কোড মানা হয় না। ফলে মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পও মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। আর বড় ধরনের ভূমিকম্প ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। তাই ভূমিকম্পের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে সব ধরনের স্থাপনা এ দূর্যোগ মোকাবিলার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।

সারা পৃথিবীতে বছরে গড়ে ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়। এগুলোর বেশিরভাগই মৃদু, যেগুলো আমরা টের পাই না। সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে—প্রচণ্ড, মাঝারি ও মৃদু। আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ভূ-পৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে অগভীর, ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে মধ্যবর্তী এবং ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে তাকে গভীর ভূমিকম্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ভূমিকম্প কেন হয়

ভূ-অভ্যন্তরে স্থিত গ্যাস যখন ভূ-পৃষ্ঠের ফাটল বা আগ্নেয়গিরির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে তখন সেই গ্যাসের অবস্থানটি ফাঁকা হয়ে পড়ে আর পৃথিবীর উপরের তলের চাপ ওই ফাঁকা স্থানে দেবে গিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখে। তখনই ভূ-পৃষ্ঠে প্রবল কম্পনের অনুভব হয় যা ভূমিকম্প নামে পরিচিত। সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে—ভূ-পৃষ্ঠের হঠাৎ পরিবর্তন জনিত কারণে, আগ্নেয়গিরি সংঘটিত হওয়ার কারণে ও শিলাচ্যুতি জনিত কারণে।

ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব

ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব সাধারণত কয়েক সেকেন্ড হয়ে থাকে। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হয়ে যেতে পারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। ভূমিকম্পের মাত্রা অনুযায়ী ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য যে যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তার নাম রিখটার স্কেল। রিখটার স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। এই স্কেলে মাত্রা ৫-এর বেশি হওয়া মানেই ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা। ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে এর মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা—৫ - ৫.৯৯ মাঝারি, ৬ - ৬.৯৯ তীব্র, ৭ - ৭.৯৯ ভয়াবহ এবং ৮-এর উপর অত্যন্ত ভয়াবহ।

ভূমিকম্প কীভাবে হয়

‘’পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। ‘’

‘’এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোন বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্টে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।‘’

যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন।

বর্তমানে উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মি. আখতার বলছেন, ‘’প্লেট বাউন্ডারি যেখানে তৈরি হয়েছে, সেটাকে আমরা বলি ফল্টলাইন। এর আশেপাশের দেশগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে।’’

বিশ্বের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে জাতিসংঘ গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম নামে একটি কর্মসূচী চালু করেছিল। সেটার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলোর একটি মানচিত্র তৈরি করা, যাতে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করবে।

সেই প্রকল্পের আওতায় অতীতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের তথ্য এবং গবেষণার ভিত্তিতে বিশ্বকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বের যেসব এলাকা বিজ্ঞানীদের বিশেষ নজরে রয়েছে:

ভূমিকম্প ঝুঁকি ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

প্রাকৃতিক যে সকল দুর্যোগ সংঘঠিত হয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছাস, নদীভাঙ্গন ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা থাকলেও ভূমিকম্প সম্পর্কিত তিক্ত জ্ঞান নেই বললেই চলে৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জাতিসংঘ বলছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম৷

এছাড়া বাংলাদেশ পৃথিবীর ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল এ অবস্থিত বিধায় প্রাচীনকাল থেকে এই দেশে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়৷ উপরন্তু হিমালয় রেঞ্জ হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল৷ যদিও সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের জনগণকে শক্তিশালী ভূমিকম্পের তিক্ত স্বাধ গ্রহণ করতে হয়নি তথাপি গত দুই শতাব্দির ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে, দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ভূমিকম্পের বড় ধরনের আশংকাআছে৷ উদাহরণ স্বরূপ ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন মেঘালয়ের শিলং এর কাছে যে মারাত্বক ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল তার ফলে বাংলাদেশের ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ অনেক শহরের দালান কোঠা ভেঙ্গে পড়ে এবং অনেক লোক প্রাণ হারায়৷ বিগত ২১শে নভেম্বর ১৯৯৭ সালে চট্রগ্রাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় এক প্রচন্ড ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং অনূরূপভাবে ১৯৯৯ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে মহেষখালি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রায় চার দফা ভূমিকম্প সংঘটিত হয় যার ফলে এই সব এলাকায় বেশ কিছু লোক মারা যায় এবং বাড়ি ঘর ধ্বংস প্রাপ্ত হয়৷ এছাড়া রেকর্ড অনুযায়ী ১৯৯৮ সালে ১০বার, ১৯৯৯ সালে ২১বার, ২০০০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত মোট ১৪বার ভূ কম্পন হয়েছে যা সুস্পষ্টভাবে ইহাই ইঙ্গিত করে যে ভূমিকম্প যে কোন মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য অভিশাপের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ আর শুধু গত এক বছরে বাংলাদেশে ১৭টি ভূমিকম্প হয়েছে। বেশির ভাগের মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫–এর মধ্যে।

ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের মধ্যে বেশি মাত্রা ছিল ২০০৩ সালের ২৬ জুলাইয়ে সৃষ্টি হওয়া একটি ভূমিকম্পের। সেটি চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতে অনুভূত হয়। মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬।

বাংলাদেশে গত এক বছরে তিনটি ৫ মাত্রার বেশি ক্ষমতার ভূমিকম্প হয়েছে। সোমবারেরটির বাইরে বাকি দুটি হলো ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট ৫ দশমিক ১ মাত্রা এবং গত ২৩ জানুয়ারি ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প। সবমিলিয়ে গত এক বছরে বাংলাদেশে ১৭টি ভূমিকম্প হয়েছে। বেশির ভাগের মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫–এর মধ্যে। ১০টির উৎস ছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায়।

ইতিহাস থেকে জানা যায় ভূমিকম্পের কারণে নদ নদীর গতি পরিবর্তন হয়ে গেছে বা পাহাড় ও টিলার সৃষ্টি হয়েছে৷ ব্রহ্মপুত্র নদীর গতি পরিবর্তন, মধুপুরের গড় সৃষ্টি ভূমিকম্পের কারণেই হয়েছে বলে ভূ-তত্ত্ববিদরা ও ইতিহাসবিদরা মনে করেন৷ উপরন্তু মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইল এলাকায় ১৭ কোটি লোকের বসবাস, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ অননুমোদিত ভবন সম্ভাব্য ভুমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে৷ এহেন পরিস্থিতিতে ভূমিকম্প সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ তথা সচেতন হওয়া একান্ত প্রয়োজন

ভূমিকম্পের সময় কী করবেন

* ভূমিকম্প হচ্ছে টের পেলে বা খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা ও উন্মুক্ত স্থানে আশ্রয় নিন।

* উঁচু ভবনে থাকলে এবং বের হতে না পারলে জানালা বা দেয়ালের পাশে অবস্থান না নিয়ে শক্ত কোনো বীম, টেবিলের নিচে অবস্থান নিন।

* হতবিহ্বল না হয়ে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।

* বহুতল ভবনে একই জায়গায় অনেক মানুষ একসঙ্গে না থেকে ভাগ হয়ে আশ্রয় নিন।

* আপনার মুঠোফোনে ফায়ার সাভির্স এবং দরকারি মোবাইল নম্বরগুলো আগাম সতর্কতা হিসেবে আগেই রেখে দিন। বিপদের সময় আপনার কাজে লাগবে।

* দ্রুত নামার জন্য ভবন থেকে লাফিয়ে পড়বেন না।

* ভূমিকম্পের সময় সম্ভব হলে মাথার ওপর শক্তকরে বালিশ অথবা অন্য কোনো শক্ত বস্তু [কাঠবোর্ড, নরম কাপড় চোপড়ের কুণ্ডলি] ধরে রাখুন।

* গ্যাস এবং বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে দূরে অবস্থান নিন।

* উচু ভবন থেকে দ্রুত নামার জন্য লিফট ব্যবহার করবেন না।

* ভূমিকম্পের সময় গাড়িতে থাকলে গাড়ি খোলা জায়গায় থামিয়ে গাড়িতেই থাকুন।

* একবার ভূমিকম্পের পরপরই আরেকটা ছোট ভূমিকম্প হয় যাকে ‘আফটার শক’ বলে।

নিজেকে বিপদমুক্ত। তাই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকেই এ বিষয়ে মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে থাকে। একটি ভবন নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সব নিয়ম মেনে করছে কি না, তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারকে এখনই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে, বড় মাত্রার ভূকম্পন হওয়ার পর কংক্রিটের স্তূপ সরানোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা, শহরের দুর্বল অবকাঠামোগুলোকে চিহ্নিত করে তা ভেঙে ফেলা বা রেক্ট্রোফিকেশন করা, নতুন ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মেনে চলা, রাজউককে শক্তিশালী করা, রাজউক থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা, সঠিকভাবে ভবনের নকশা প্রণয়ন ও তা যাচাই করা, জায়গাভেদে চার-পাঁচতলার বেশি উচ্চভবন না করা, ক্লাস্টার হাউজিংয়ে নিরুৎসাহিত করা, জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ না করা, জলাশয় ভরাট আইনত দণ্ডনীয় তা প্রতিপালন করা, শহরের খালগুলো পুনরুদ্ধার করা, নদীগুলো দূষণমুক্ত রাখা এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নিয়ে ভূমিকম্প সেল গঠন করা ইত্যাদি। ভূমিকম্পের ক্ষতি কমাতে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে ভূমিকম্প বিষয়ক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করা, প্রতিটি অফিসে মাঝেমধ্যে ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে তা ব্যাপকহারে শহরের মানুষদের উজ্জীবিত করবে এবং মানুষ ভূমিকম্পের সময়ে করণীয় সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হবে।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test