E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইতিহাসের ভবিষ্যৎ!

২০২৩ ডিসেম্বর ১৭ ১৬:১১:০৪
ইতিহাসের ভবিষ্যৎ!

রায়হান রশীদ


শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। সকাল থেকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল আর ফেসবুকের আলোচনাগুলো লক্ষ্য করছি। গুরুত্বপূর্ণ মতামত আর আবেগ উঠে এসেছে সে সব আলোচনায়। অনেকে আবার এই সুযোগে শহীদ দিবসের উত্তপ্ত তাওয়ায় গণতন্ত্র, নির্বাচন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদিও ভেজে নিচ্ছেন একটু করে। এতে সমস্যা নেই। এই বিষয়গুলো অবশ্যই গুরুত্বের দাবীদার, এবং এই আলোচনাগুলো সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু নির্দিষ্ট যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আজকের অন্তত এই দিনে "সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ" ও সময়োপযোগী ছিল বলে মনে করছিলাম সেটি কোথাওই আর উত্থাপিত হতে দেখলাম না। তাই এই পোস্টটি লেখার তাগিদ অনুভব করছি। ধৈর্য্য ধরে যদি পড়েন, কারণ এটি একটি দীর্ঘ পোস্ট হতে যাচ্ছে, তাহলে কৃতজ্ঞ হবো। 

এই যে উপরে লিখলাম "সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ", কথাটা কিন্তু এতটুকু বাড়িয়ে বলিনি। এই পোস্টটি পড়লে আপনার কাছেও হয়তো সেটি স্পষ্ট হবে এবং আপনিও হয়তো একমত হবেন। আমার মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়া অবধি এ সংক্রান্ত গত ১৫ বছরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ৩টি ঘটনাকে যদি চিহ্নিত করি আমরা, তাহলে সম্ভবত এই পোস্টে যে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছি সেটি হতে যাচ্ছে তার একটি। একটু ধারণা দিই। এমনকি, হয়তো শাহবাগ আন্দোলনও এই তিন প্রধান ঘটনার তালিকার মধ্যে পড়বে বলে আমার মনে হয় না! তাহলে একটু মন দিয়ে পড়ুন।

আপনারা জানেন, ১৯৭১ এর বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারীদের একজন হিসেবে চোধুরী মুঈনউদ্দিন নামে একজনের বিচার হয়েছিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি-তে)। আসামীর অবর্তমানে তার বিচারের রায়ে তাকে সন্দেহাতীতভাবে দোষী সাব্যস্ত করে আইসিটি, এবং তাকে ফাঁসীর দন্ড প্রদান করা হয় ২০১৩ সালে। দন্ডপ্রাপ্ত আসামী মুঈনউদ্দিন যুক্তরাজ্যে বসবাস করায় সেই সাজা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। কেন হয়নি বা কি কি করা সম্ভব ছিল বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে, তা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে, এখন সে কথা থাক। মুঈনউদ্দিনের পুরো ঘটনা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে নতুন মোড় নিয়েছে, সেটি মনে হয় আপনাদের সবার আগে জানা থাকা দরকার।

২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর জঙ্গীবাদ এবং ইসলামিজম বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, মূলত অনলাইনে। সেখানকার একটি "ফুটনোটে" চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয় যে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইসিটির একটি রায়ও রয়েছে। যুক্তরাজ্যে মুঈনউদ্দিনের নিযুক্ত আইনজীবিরা দাবী করে যে রিপোর্টে তার রায়ের এই বিষয়টির এমনকি উল্লেখও নাকি তার বিরুদ্ধে মানহানীর সামিল, এবং এই মর্মে তারা স্বরাষ্ট্র দফতরকে আইনী নোটিশ পাঠায়। স্বরাষ্ট্র দফতর এই লিগ্যাল নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে সেই ফুটনোটটি সরিয়েও নেয় অনলাইন থেকে। তারপরও মুঈনউদ্দিন যুক্তরাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টে মানহানীর মামলা দায়ের করে।

আদালতে মুঈনউদ্দিনের বক্তব্য ছিল - বাংলাদেশের আদালতের রায়কে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টিই তার জন্য মানহানীকর, কারণ বাংলাদেশের আইসিটির নাকি কোন ধরণেরই গ্রহণযোগ্যতা নেই। সুতরাং, আইসিটির মাধ্যমে ১৯৭১ এর যে ধরণের ইতিহাস প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং রায় দেয়া হয়েছে তার সবই ভিত্তিহীন। এসবের ফলে নাকি যুক্তরাজ্যের একজন সম্মানিত নাগরিক হিসেবে মুঈনউদ্দিনের মানবাধিকার এবং সম্মান ক্ষুন্ন হয়েছে। বিপরীত পক্ষ (অর্থাৎ, যুক্তরাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের আইনজীবীরা) পাল্টা অভিযোগ আনে এই বলে যে অন্য একটি দেশের আদালতে ইতিমধ্যে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তিকৃত একটি বিষয় পুনরায় উত্থাপন করে মুঈনউদ্দিন যেটা করার চেষ্টা করছে তা হল মূলত যুক্তরাজ্যের আইনব্যবস্থার অপব্যবহার সুতরাং মুঈনউদ্দিনের মামলাটি খারিজ করে দেয়া হোক।

হয়তো বুঝতে পারছেন, পরোক্ষভাবে এই মামলাটির অন্যতম বিচার্য বিষ‍য়ই হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাজ্যের আদালতে আইসিটি আর বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা যাচাই। যুক্তরাজ্য হাইকোর্ট মুঈনউদ্দিনের মামলাটি খারিজের নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে মুঈনউদ্দিন আপিল করে যুক্তরাজ্যের উচ্চতর আপীল আদালতে।আপীল আদালতের ৩ জন বিচারকের মধ্যে ২ জন হাইকোর্টের নির্দেশের সাথে একমত হন, কিন্তু ১ জন বিচারক মুঈনউদ্দিনের পক্ষে (অর্থাৎ মামলা খারিজের বিপক্ষে) রায় দেন। এই ১ বিচারকের রায়ের ভিত্তিতে মুঈনউদ্দিন আবার আপিল করে - এবার যুক্তরাজ্যের সুপ্রীম কোর্টে। এটাই যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত।

গত ১ এবং ২ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের সুপ্রীমকোর্টে মামলার বিষয়টির চূড়ান্ত শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচ বিচারকের সামনে সেই শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। মুঈনউদ্দিন এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে দেশের প্রধান দু'টি ল'ফার্মের আইনজীবীরা সেখানে পাল্টাপাল্টি অংশ নেন।

গত চার বছর ধরে, এবং বিশেষ করে গত ন'মাস ধরে আমি এই মামলার পুরো বিষয়টি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছি। সরাসরি মামলার পক্ষ না হতে পারার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজের সীমিত সাধ্য আর সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তার শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করে গেছি পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ দু'ভাবেই এই মামলায় ১৯৭১ এর ভিকটিমদের এবং আইসিটির মূল দিকগুলো সামনে নিয়ে আসার। উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাজ্যের মামলার আইনজীবীদের দু'পক্ষের সাবমিশনে যে মৌলিক বিষয়গুলো একেবারেই উঠে আসেনি সেগুলোর পাশাপাশি তাদের এবং যুক্তরাজ্যের বিচারকদের করা জ্বলজ্যান্ত ভুলগুলো তুলে ধরা।

চূড়ান্ত বিচারে কতটুকু সফল হয়েছি তা এখনি বলা মুশকিল, কারণ, যুক্তরাজ্য সুপ্রীম কোর্টে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত রায়ের জন্য অপেক্ষাধীন। তবে এটুকু উল্লেখ না করলেই না। যুক্তরাজ্য সুপ্রীম কোর্টে দু‌'পক্ষের শুনানী শেষ হওয়া পর্যন্ত আমার অন্তত যা মনে হয়েছে, তা হল- পুরো মামলাটির শুনানী আইসিটির জন্য ইতিবাচক হয়েছে তা বলা যাবে না। যুক্তরাজ্য সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিদের দৃষ্টিভঙ্গী হয়তো (ধরে নিচ্ছি যদিও) অনেকাংশেই নির্ভর করেছে মুঈনউদ্দিন এবং যুক্তরাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের দুই পক্ষের আইনজীবীদের কাছ থেকে তারা এ পর্যন্ত যা শুনেছেন বা যা শুনেননি শুধু তার ওপরই।

যে কোন দিনই রায় হতে পারে। জানি না যুক্তরাজ্যের বিচারকরা কি রায় দেবেন শেষ পর্যন্ত, এবং তা কিভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্ধৃত এবং (অপ) ব্যবহৃত হতে পারে ১৯৭১, বিচার, আর ভিকটিমদের বিরুদ্ধে!

যুক্তরাজ্য সুপ্রীম কোর্টের এই রায়টি কেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, সেটি জানিয়ে রাখাটা প্রয়োজন মনে করছি, যে কারণে মূলত এই পোস্টটি লেখা।

চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের এই মানহানি মামলাটিকে যুক্তরাজ্য সুপ্রীমকোর্ট যদি সর্বতোভাবে এবং সর্বসম্মতিক্রমে খারিজ করে দেয় তাহলে তো কিছুই বলার নেই। সেই সম্ভাবনা এখনো আছে। তেমনটি হলে এই মামলাটি হয়তো ইতিহাসের বা আইনের বইয়ের কোন একটি ছোট ফুটনোট হয়ে থেকে যাবে। কিন্তু রায়ে যদি এর বিপরীতটি ঘটে, অর্থাৎ, মুঈনউদ্দিনের মানহানীর দাবী যদি টিকে যায়, তাহলে নিচের আশংকাগুলো বাস্তব হয়ে ওঠার এক ভিন্ন বাস্তবতা তৈরী হবে আমাদের সবার জন্য। অনেকগুলো সম্ভাব্য ফলাফল আর আশংকার মধ্যে শুধু চারটি উল্লেখ করছি নিচে:

প্রথমত: যুক্তরাজ্য সুপ্রীম কোর্ট মুঈনউদ্দিনের পক্ষে (অর্থাৎ আইসিটির প্রক্রিয়ার বিপক্ষে) রায় দিলে সেই রায়টি দেশে বিদেশে যুদ্ধাপরাধী আসামী পক্ষ উদ্ধৃত করবে আইসিটির পুরো প্রক্রিয়া এবং এর প্রতিটি বিচারের রায়কে চূড়ান্তভাবে প্রশ্নবিদ্ধভাবে করার কাজে। অবশ্যই, আইনী বিচারে যুক্তরাজ্যের রায় বাংলাদেশের আইসিটির রায়ের ব্যাপারে কোন ধরণের বাধ্যবাধকতা তৈরী করে না, তবে প্রচার/অপ-প্রচারের বিভ্রান্তিকর রাজনীতিতে এবং ১৯৭১ এর ইতিহাসকে ঘোলা করার কাজে যুক্তরাজ্যের আদালতের রায় শক্তিশালী এক হাতিয়ার হয়ে উঠবে ১৯৭১ বিরোধী-পক্ষের হাতে। এই যে প্রথম সম্ভাবনার কথাটি লিখলাম, তা হল আমার লেখা চারটি সম্ভাবনার মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর, কারণ বাকিগুলো আরও সুদূরপ্রসারী!

দ্বিতীয়ত: যদি যুক্তরাজ্যের আদালতে বাংলাদেশের আইসিটির বিরুদ্ধে করা সমালোচনাগুলো ধোপে টিকে যায়, তাহলে এর প্রভাব হবে মুঈদনউদ্দিনের মামলা ছাড়িয়েও আরও বিস্তৃত। কারণ, তখন সমালোচনাগুলো পশ্চিমের এক গুরুত্বপূর্ণ আদালতের বদৌলতে এক ধরণের আইনী বৈধতার সীল পেয়ে যাবে। এই বিষয়টিকে তখন আইসিটির বিচারে দন্ডপ্রাপ্ত সব আসামীই ব্যবহার করতে পারবে এ জাতীয় কৌশলগত মানহানী মামলায়। তাদের উদ্দেশ্য হবে ১৯৭১ ইস্যুতে নিজেদের কৃতকর্মের ইতিহাস চাপা দেয়া। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের আইনব্যবস্থা ও আদালত এমনিতেই এ জাতীয় মানহানী মামলার ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় ফোরাম হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের অন্য সব ব্যবস্থার তুলনায়। এই সুযোগটি ঢালাওভাবে নেয়ার সুযোগ তৈরী হবে তখন যুদ্ধাপরাধী পক্ষের দিক থেকে। এভাবে ১৯৭১ এর প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস একটু একটু করে বিকৃত হতে থাকবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।

তৃতীয়ত: আইসিটির রায়ের পরও যদি দন্ডিত একজন অপরাধী এই রায়কে মানহানীকর বলে যুক্তরাজ্যের আদালতে উতরে যেতে পারে, তাহলে ১৯৭১ এ সংঘটিত অপরাধগুলো (যেমন: গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ) নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব ধরণের গবেষণা আর লেখালিখির কাজ আর উদ্যোগগুলো এক বড় ধরণের প্রতিবন্ধকতার সম্মূখীন হবে। লেখক এবং গবেষকদের তখন তাদের কাজগুলো করতে হবে প্রতি পদে মানহানী মামলার খড়গ মাথায় নিয়ে। আইন বিষয়ে যাদের কিছুমাত্র ধারণা আছে তারা জানবেন- কাউকে হয়রানী করতে, বা আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করতে মানহানী মামলার কোন জুড়ি নেই।

চতুর্থত: বাংলাদেশের গণহত্যার বৈশ্বিক সার্বজনীন স্বীকৃতি অর্জনের যে প্রজন্মব্যাপী আন্দোলন মাত্র শুরু হয়েছে, তার পুরোটাই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হবে।

ধৈর্য্য নিয়ে পড়বার জন্য ধন্যবাদ। আশা করি এই লেখাটি পরিস্থিতির সম্ভাব্য গুরুত্ব অনুধাবনের পাশাপাশি পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। জয় বাংলা।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test