E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর কী ভোট কেন্দ্রে যাবেন?

২০২৩ ডিসেম্বর ১৮ ১৮:৫৬:৫২
কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর কী ভোট কেন্দ্রে যাবেন?

বিপ্লব কুমার পাল


শীতের সকাল। কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে নাটোরের চলনবিলের মাঠ। বর্ষাকালে চলনবিলে পানি থৈ থৈ করলেও শীতের সময় সেটিই হয়ে ওঠে উর্বর জমি। সেই জমিতে পেঁয়াজ ক্ষেতে যত্ন নিচ্ছিলেন নলডাঙ্গার সোনাপাতিল গ্রামের কৃষক ষাটোর্ধ্ব দিলবর প্রামাণিক। ভোটের এই সময়ে যেমন তার কদর বেড়েছে, তেমনি পেঁয়াজের দাম বেশি থাকায় খুশি কৃষক দিলবর। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কারণে এমপি প্রার্থীর সমর্থকেরা প্রতি মুহূর্তে খোঁজ খবর রাখছেন, সালাম বিনিময় করছেন। দুই কারণে এবার তার খুশির মাত্রাটা বেশিই।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তবে কী মানুষ ভোট দিতে যাবে? এমন প্রশ্ন ছিল জ্যেষ্ঠ কৃষক দিলবর প্রামানিকের কাছে। তিনি বলছিলেন, ‘ভোট দিতে য্যাবো। দ্যাশের সরকার নির্ধারণ করতে হবি। বাড়িত যেমুন গারজেন লাগে, তেমনি দ্যাশেরও তো গারজেন লাগবি। নাগরিক হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না?’

কৃষক দিলবরের বাড়ি থেকে ভোট কেন্দ্রের দুরস্ত এক কিলোমিটার। এত দূরে গিয়ে ভোট দিয়ে কি লাভ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিজের লাভ দ্যাখলি হবি না। দ্যাশের লাভই মুর লাভ। আমি দ্যাশের গারজেন ঠিক করবো বুচ্ছেন। তাছাড়া আমার গ্রামের অনেক উন্নতি হইচে। রাস্তা পাকা হইছে, ব্রিজ হইছে। আমি কৃষি ভর্তুকি পাই। আমার বউ ভাতা পায়, ফসলের দাম ভালো পাচ্ছি, এগুলা পাওয়া কি কম?’

চলবিলের মাঠে কথা হয় তেঘরিয়া গ্রামের কৃষক ৪৮ বছর বয়সী জালাল উদ্দিন ফকিরের সঙ্গে। এক সময় জামায়াতের সমর্থক ছিলেন। চারদলীয় জোটের পর তিনি হয়ে যান বিএনপির সমর্থক। যদিও ২০১৮ সালের ভোটের সময় নৌকার প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন। অপকটে সেকথা স্বীকারও করেন তিনি। এবার ভোট কি দেবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তার সরাসরি জবাব, ‘অবশ্যই ভোট দিবো। কেন ভোট দিতে চান? কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘ভোট দেওয়া আমার কর্তব্য, ভোট না দিলে হবি? হবি না। ভোট দিত্যায় হবি। আমার ভোটের সরকার হবি। আমি বিএনপি সমর্থক, কিন্তু তারা ভোটে দাঁড়ায়নি। তাই বলে আমার দায়িত্ব পালন করবো না, তা তো হবি না। আনন্দ নিয়্যাই ভোট কেন্দ্রে যাবো, ভোট দিবো।’

গাইবান্ধা এক সময় মঙ্গা এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। সেসময় ঘরে খাওয়া থাকতো না। নিদারুণ কষ্টে দিন কাটতো। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। মঙ্গা বলে এখন কিছু নেই। গাইবান্ধার সদর উপজেলার বানিয়ারজান গ্রামের কৃষিশ্রমিক আয়েশা খাতুনের সাথে কথা হয়। ৩৫ বছর বয়সী আয়েশা নিজের আয় দিয়ে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করান। আগে দিনে একশো টাকা মজুরি পাওয়াই কঠিন ছিল। এখন দিনে পাঁচশ’ টাকা আয় করেন। ধান কাটার মৌসুমে ছয়শ’ টাকা মজুরি পান তিনি। কৃষিশ্রমিক ভোট নিয়ে বেশ সচেতন। ভোট দেওয়া তার দায়িত্ব বলে মনে করেন। আয়েশা খাতুন বলেন, ‘নিজের কাম নষ্ট করে ভোট দিবার যামো। হামার একট্যা দায়িত্ব আছে না। যতি গন্ডগোল না হয়, তাই ভোট দিবার যামো।’

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া গ্রামের হোটেল শ্রমিক লতা বেগমের (৪০) গতবারের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে দেখেন সংঘর্ষ চলছে। তিনি বলেন, ‘গেল বছর ভোট দিবার যাইয়া দেখি ক্যাচাল লাগছে, ভোট না দিয়ে ঘুরে আচ্ছি। আর ভোট দিবার পাইনাই। এবারও মেলা কয়জন দাঁড়াছে। এলাকার কাজ কাম করে দিবের চাবে তাকে এবার ভোট দেমো।’

বরগুনা সদরের হেউলিবুনিয়া এলাকার দিন মজুর আব্দুস সালাম। ৬৯ বছর বয়স। সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ আগ্রহ তার। আব্দুস সালাম বলেন, ‘পাঁচ বছর পর সংসদ নির্বাচন, মোর ঘরের ছয় সদস্য সবাই ভোট দিতে যামু। আগের চেয়ে এহন মোরা ভালো আছি। আগে হারাদিন বদলা দিয়া পাইতাম ৪০০-৫০০ টাহা। এহন পাই ৭৫০ টাহা। সব কিছুর দাম বাড়লেও মোরাওতো বেশি টাহা পাই। তয় রাস্তা-ঘাটের অবস্থা খারাপ, সব রাস্তা ভাঙ্গা। সরকার যদি রাস্তাগুলা ভালো ক‌ইরা দেয়, হেলে মোগো আর কোন কষ্ট থাকপে না।’

বরগুনা সদরের গৌরিচন্না ইউনিয়নের বাঁধঘাট এলাকার টমটম চালক মোহাম্মদ আল-আমিন বলেন, ‘নির্বাচনের আগে অনেকে অনেক কতা কয়। এবার আর ভুল মার্কায় ভোট দিমু না। মোরা এবার আগেই বাইচ্চা রাখছি। এফির আর কেউর কতায় ভোট দিমু না।’

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখলা চা বাগানে শ্রমিকের কাজ করেন নিতাই চাষা। তিনি মনে করেন, একমাত্র ভোটের কারণে নেতাদের কাছে তাদের কদর বেশি। তা নাহলে কেউ তাদের কথা মনেই করতো না। তিনি বলেন 'সবাই ভোটে আসলে ভোট জমতো। তবে আমি ভোট দিতে যামু।’ আর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা সদরে রিকশাচালক রাসেল মিয়া বলেন, 'ভোট দেওয়াত যাইমু, পছন্দর মানুষরে ভোট দিমু।'

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরপুর-দূর্গাপুর ইউনিয়নের কৃষিশ্রমিক আব্দুর রহিম বলেন, ‘সারাদেশে সুষ্ঠ একটা ভোট হোক। আওয়ামী লীগ যাক, বিএনপি যাক, জাতীয় পার্টি যাক, জাসদ যাক। রাজনীতি বুলতে সবাই য্যাবে। আমার ভোট দিতি যাতি কোনো বাধা নাই। আমার ভোট যাকে খুশি তাকে দিবো।’ একই ইউনিয়নের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভোটের মাঠে আমাদের যাতিই হবে। ঘটনা হইলো যে, একদলীয় ভোট, এজন্য একটু সমস্যা, তবুও আমরা চিন্তা-ভাবনা করবো। প্রার্থী যে ভালো, ভোট তাকিই দিবো।’

প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হয়ে গেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল। দেশজুড়ে প্রচারে নেমে পড়েছেন প্রার্থীরা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাও মাঠে নেমে পড়েছেন। বহু নাটকের পর সংসদের বিরোধী জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। কিন্তু বিএনপিসহ সমমোনা কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ভোটার উপস্থিতি নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। কেউ বলছেন, ভোটার উপস্থিতি কম হবে; আবার কেউ বলছেন, এবারের নির্বাচন অংগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।

সংসদ নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, কোনো আসনের নির্বাচনের প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম ভোট পেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্তের বিধান আছে। কিন্তু, একজন প্রার্থী কত শতাংশ ভোট পেলে বিজয়ী হবে, সে বিষয়টি নির্বাচনী আইনে নেই। তাই নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়ল, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনেরও (ইসি) ভাবার সুযোগ নেই। এপর্যন্ত দেশে এগারোটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এরমধ্যে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৮৬.৩৪ শতাংশ ভোট পড়েছিল। আর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২১ শতাংশ।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বা ভোট পড়ার শতাংশের হিসাব নিয়ে বিশিষ্টজনদের কথার ম্যারপ্যাচ নিয়ে সাধারণ ভোটারদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলো একমাত্র লক্ষ্য- সারাদিন পরিশ্রম করে অর্থ আয় করা, তিন বেলা পেটপুড়ে খাওয়া, আর সন্তানদের লেখাপড়া করানো। তারা মনে করেন, ভোট দেওয়া তাদের পবিত্র কর্তব্য। কে ভোটে এলো বা এলো না এনিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন নেই তাদের মনে। ভোটাররা যেন নিরাপদে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন, তারা যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন সেজন্য প্রথমেই প্রয়োজন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test