E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দলীয় ‘প্রার্থী’ বনাম দলীয় ‘স্বতন্ত্র’ এবং আওয়ামী লীগ

২০২৩ ডিসেম্বর ২৮ ১৮:৪৯:০৩
দলীয় ‘প্রার্থী’ বনাম দলীয় ‘স্বতন্ত্র’ এবং আওয়ামী লীগ

রিয়াজুল রিয়াজ


আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ আসনেই আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিপরীতে কমপক্ষে একটি করে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। কোন জতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন বিক্রি হয়েছে এবার (৩৩৬৩ টি)। আর দলের মনোনয়ন বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারনী মহলের প্রথম বক্তব্য হচ্ছে, 'এতো প্রার্থীর সবাইকে তো আমরা দলীয় মনোনয়ন দিতে পারবো না, তবে কেউ চাইলে এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে দল তাকে কোন বাধা দেয়া হবেনা। যদি কেউ তার জনপ্রিয়তা দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে নৌকার ভোটে জিতে আসতে পারেন, তবে দল তাঁকে স্বাগত জানাবে।' 

দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে, 'এবার কেউ যেনো বিনা ভোটে নির্বাচিত না হয়ে আসেন। বিনা ভোটে নির্বাচিত হলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে দল! যদি কোন আসনে কেউ স্বতন্ত্র না দাঁড়াতে চায় তবে ড্যামি প্রার্থী দিলেও দিতে হবে।' দলের তৃতীয় বক্তব্য হলো, আওয়ামী লীগ সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে চায়, তাই তাঁরা সেটার বাস্তবায়ন করতে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে।' এছাড়া, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, 'কোন ধরনের আধিপত্য বিস্তার না করে ভোটারদের কাছে গিয়ে দলের উন্নয়নের কথা তুলে ধরে ভোট চাইতে হবে। জনগণকে ভোট কেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত করতে হবে। জনগণ যাকে ভোট দিবে, সে নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসবে। ভোটে আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী আধিপত্য বিস্তার বা প্রভাব খাটালেই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।'

অপরদিকে প্রায় সারা দেশে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত নেতারা দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ লুফে নিয়ে দলীয় মনোনীত প্রার্থী বিপরীতে প্রার্থী হতে থাকেন সারা দেশে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এই ভেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন যে, শেষ পর্যন্ত এই বিষয়ে দল ছাড় না দিলে তাঁরা মনোয়ন তুলে ফেলবেন! কিন্তু পরবর্তীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দলীয় ছাড় দেয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগ পুরোপুরি পরিস্কার করলে প্রার্থীরা ভাবেন; যেহেতু স্বতন্ত্র প্রার্থীকে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর তকমা দিয়ে দল বহিষ্কার করবেনা, তাহলে তো নির্বাচনে প্রার্থী হতে কোন সমস্যা নাই। প্রথম দিকে এই বিষয়ে একটু ধোঁয়াশা থাকলেও পরে তা আরো নিখুঁতভাবে দলের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে দেয় আওয়ামী লীগ।

এ বিষয়ে দলের স্পষ্ট বক্তব্য হলো: 'প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন, ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি ও উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট দেখতে চায় আওয়ামী লীগ। তাই, নির্বাচনে অংশ নেয়া দলের কোন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে দল বহিষ্কার করবেনা। এরপর দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে, দলের তৃণমূলের কর্মীদের অবস্থানও পরিস্কার করে দেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ জানায়, 'দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীরা সাধারণ ভোটারদের মতো দলীয় মনোনীত প্রার্থী বা দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে যে কারো সাথে নির্বাচন করতে পারবে। এতে দল তাঁদের কোন প্রকার শাস্তির আওতায় আনবেনা।' সুতরাং দলের তৃণমূলের কর্মীরাও স্বাধীন হয়ে যায়। এদিকে দলের এমন সিদ্ধান্তে দলীয় মনোনীত প্রার্থীরা খুশি না হলেও খুশি হতে দেখা যায় দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। তাই, তৃণমূল নির্ভাবনায় তাঁদের পছন্দের প্রার্থীর জন্য কাজ করে আসছে এখনও। প্রথম প্রথম সব ঠিকঠাক থাকলেও নির্বাচনের দিন যতো ঘনিয়ে আসছে ততোই গরম হচ্ছে ভোটের মাঠ। আওয়ামী লীগের বিরোধী দল যেন আওয়ামী লীগ, এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে দিনদিন।

ইদানিং গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে দলীয় মনোনীত নৌকার প্রার্থীদের সব ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থীর আগ্রাসী মনোভাবের খবরা-খবর। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা, তাদের মারধর ও তাদের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটার অভিযোগও উঠেছে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে। অবশ্য কোথাও কোথাও এর উল্টো খবরও দেখা যাচ্ছে। দল এসব ব্যাপারে বারবার সতর্ক করলেও তাঁরা এখন পর্যন্ত তেমন কোন দলীয় একশনে গিয়েছেন বলে চোখে পড়েনি। যদিও নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন এই বিষয়ে প্রথম থেকেই যথেষ্ট সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তথাপিও এমন পরিবেশ আর কিছুদিন চলতে থাকলে ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কমে যাওয়া ও ভোটে সহিংসতা হওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। এসব ক্ষেত্রে নৌকার প্রার্থীরা তাঁদের দলের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তকে কতোটা সম্মান করছেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে!

বিএনপি নির্বাচনে না আসায় বঙ্গবন্ধু কন্যার দলীয় 'নৌকা-স্বতন্ত্র' নীতিটি যে আশায় প্রনয়ণ করেছেন তা সফল হলে আওয়ামী লীগ আরেকটি রাজনৈতিক সাফলতা পাবে এতে কোন সন্দেহ নাই। আর যদি ব্যর্থ হয় তবে তা দল, দেশ ও জাতীর জন্য একটা বড় সংকটের সৃষ্টি করবে। শুধুমাত্র এই চিন্তা টুকুনও যদি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা করে থাকতেন, তাহলে তাঁরা নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উপর আধিপত্য বিস্তারের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করতেননা। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করেই খেলতেন। নৌকার প্রার্থী হিসেবে এডভান্টেজ নিয়ে সরকারের সাফল্য তুলে ধরে ভোটের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করতেন! নিজ দলীয় স্বতন্ত্রদের জোর করে দমনের চেষ্টা করে নির্বাচনে সহিংসতা বৃদ্ধি করলে তা যে আত্নঘাতী মনোভাবের সামিল হবে, সেটিও স্পষ্ট অনুধাবন করতেন।

মনে রাখবেন, এই অবস্থার উন্নতি না হলে, নির্বাচন হয়ে গেলেও নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের দলীয় বিভেদ আরও বাড়বে ছাড়া কমবেনা! যা দলটির ভবিষ্যতের জন্য খারাপ ছাড়া ভালো কিছু বয়ে আনবে বলে মনে হচ্ছেনা। তাই, আওয়ামী লীগের সকল প্রকার প্রার্থীদের প্রতি অনুরোধ এখনও সময় আছে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে তাঁর আশার সফল প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করুন। দেশের নির্বাচনটিকে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও উৎসব মুখর পরিবেশে শেষ করার চেষ্টা করুন। যাতে দেশ বিদেশের এই নির্বাচনকে কোনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না করতে পারেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকুন। জনগণকে তাঁদের ইচ্ছে মতো প্রতিনিধি বেছে নিতে এবং নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার সুযোগ করে দিন। তা নাহলে ভোটের আগেই শেষ হয়ে যেতে পারে ভোট! সুযোগ খুঁজছে ও সুযোগ খুঁজবে- দেশ বিরোধী এবং ভোট বিরোধী জোট!

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test