E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল

২০২৪ মার্চ ২১ ১৮:৫৮:৩২
আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল

গোপাল নাথ বাবুল


দোলযাত্রা দুই বাংলার একটি পবিত্র এবং বড় উৎসব। সনাতনীদের বারো মাসে তেরো পুজার মধ্যে দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব অন্যতম। সনাতনী ঐতিহ্যে দোলযাত্রা বা হোলি উৎসবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য্ রয়েছে। এটি একটি উৎসব মুখর দিন। এদিনে সবাই অতীতের ঝগড়া-বিবাদসহ ভুলগুলো ভুলে গিয়ে একে-অপরকে আপন করে নেন। এই উৎসব একই সাথে বসন্তের আগমন বার্তাও নিয়ে আসে। অনেকের কাছে এটা নতুন বছরের শুরুকে নির্দেশ করে। এটি মানুষের জন্য ঋতু পরিবর্তন উপভোগ করা ও নতুন বন্ধু তৈরির উৎসব। 

বাংলাদেশে এটা দোলযাত্রা বা দোল পূর্ণিমা অথবা দোল উৎসব নামে পরিচিত। তবে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় দোল পূর্ণিমা ছাড়াও এই রঙের উৎসবকে হোলি উৎসবও বলা হয়। বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও এই উৎসব ইউরোপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশসহ গায়ানা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো এবং মরিশাসেও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হয়। কিন্তু এই দোল বা হোলি দুটি একইদিনে পালন করা হয় না। অর্থাৎ বাঙালিরা যেদিন দোল খেলেন তার পরেরদিন হোলি উৎসব পালন করা হয়।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন মন্দিরে পালিত হয় দোলযাত্রার অনুষ্ঠান। অনেক মন্দিরে দোলযাত্রা উপলক্ষে বসে বিভিন্ন মেলা। আর মেলা ও দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে একত্রিত হয় পূণ্যার্থীরা। সনাতন ধর্মমতে, দ্বাপরযুগ থেকে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা বা দোল উৎসব পালিত হয়ে আসছে। দোলযাত্রা বা দোল পূর্ণিমা পালিত হয় রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনির উপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে হোলি পালন করা হয় নৃসিংহ অবতারের হাতে দৈত্য হিরণ্যকশিপু বধ হওয়ার যে পৌরাণিক কাহিনি, তার উপর ভিত্তি করে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা রাতের পরদিন দোল উৎসব পালন করা হয়। মনে করা হয়, এদিনই রাধা আর তাঁর সখীরা দল বেঁধে আনন্দে রং খেলায় মেতে উঠেছিলেন। তখন ভগবান কৃষ্ণ তাঁর মুখটি সুগন্ধি ফুলের কুড়ির রঙ দিয়ে গন্ধযুক্ত করেছিলেন। সেদিনই কৃষ্ণ রাধার প্রতি তাঁর প্রেম নিবেদন করেছিলেন বলে মনে করা হয়।

এছাড়াও হিন্দু পুরাণ মতে, একদিন ছোট্ট শ্রীকৃষ্ণ রাধার গায়ের সুন্দর রঙ দেখে কান্নাকাটি শুরু করেন এবং সবার কাছে নিজের গায়ের রঙ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলেন। মা যশোদা শ্রীকৃষ্ণের এমন দশা দেখে হাসতে লাগলেন। পরে শ্রীকৃষ্ণকে শান্ত করার জন্য মা যশোদা রাধার মুখে ইচ্ছেমত রঙ লাগিয়ে দিতে বললেন কৃষ্ণকে। মাতৃআদেশ পেয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁর বন্ধুদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ নানান রঙ মিশিয়ে রাধারাণীর জন্য রঙ প্রস্তুত করলেন। তারপর সেই রঙ রাধারাণীসহ সকল গোপীদের মুখে লাগিয়ে দিয়ে সেদিন খুব আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। ব্রজবাসীরাও মেতেছিলেন সে রঙ খেলায়। দিনটি ছিল হোলিকা দহনের পরেরদিন। সে থেকেই আজ অবধি দোলযাত্রায় রঙ খেলা চলে আসছে। আবির ছড়িয়ে একে-অপরকে রাঙিয়ে দেন। প্রকৃতিতে ফুটে উঠে শিমুল, পলাশ, অশোকসহ বিভিন্ন রকমের ফুল। ডেকে উঠে কোকিল। নবীন হৃদয় দুলে উঠে।

আবার পূর্ণিমার মাঝে চন্দ্রগ্রহণ অর্থাৎ শত বছরে এক/দু’বার খুব অল্প সময়ের জন্য আসা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল একটি সন্ধিক্ষণ। ১৪৮৬ সালের এই পূর্ণিমা তিথিতেই দিগ্বিদিক আলো করে উলুধ্বনি আর শঙ্খনাদের গর্জন-এ শচীমাতা ও জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন বলে দোল পূর্ণিমাকে ‘গৌর পূর্ণিমা’ও বলা হয়। শ্রী গৌরসুন্দর হলেন কলিযুগের মানুষদের পথপ্রদর্শক। কলির অধঃপতিত জীবদের করুণা করতে তিনি পশ্চিমবঙের শ্রীধাম নবদ্বীপে আবির্ভূত হন।

দোলের পূ্‌র্বদিন সন্ধ্যায় শুকনো লতাপাতা, ধান গাছের গোড়া অর্থাৎ ন্যাড়া, কাঠ দিয়ে তৈরি করা ঘরে আগুন দিয়ে পালন করা হয় হোলিকা দহন। যা আমাদের চট্টগ্রামে ‘বুড়ির ঘর’ নামে পরিচিত। বালক-বালিকার দল বুড়ির ঘরে আগুন দিতে দিতে কন্ঠে সেই গানটি তুলে নেয়-‘আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল/পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরিবোল’। এ তো চিরপরিচিত দোলেরই সেই অম্লান ছবি, যে দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা বড় হয়েছি। তবে প্রশ্ন থাকে-কেন এ ন্যাড়া পোড়া?

সনাতনীদের বিশ্বাস মতে, তাতে অশুভ শক্তির বিনাশ হয়। ওইদিন এলাকার কিশোর-যুবারা সমবেতভাবে গান ধরে। আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল/ পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরিবোল। এই আধুনিক যুগেও হোলিকা দহনের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। এই সময় প্রকৃতিতে উৎপাত হয়ে থাকা পোকামাকড় ফসল নষ্ট করে। হোলিকা দহনে পোকামাকড়ের উৎপাত কমে।
এই হোলিকা দহনেরও একটা মজার পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। ভাগবত পুরাণের সপ্তম অধ্যায় অনুসারে মহর্ষি কশ্যপ ও দিতির পুত্র অসুররাজ হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার নিকট থেকে অমরত্বের বর লাভের আশায় কঠোর ধ্যানে নিমগ্ন হন। এতে ব্রহ্মার তাকে অমরত্বের বর না দিলেও এমন একটি বর প্রদান করেন যাতে অসুররাজ পাঁচটি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হন। এগুলো হলো, তাকে কোনো মানুষ বা প্রাণী হত্যা করতে পারবে না, কোনো অস্ত্র-শস্ত্র দ্বারা হত্যা করতে পারবে না এবং ঘরে-বাইরে, জলে-স্থলে-বায়ুতে, দিনে বা রাতে কোথাও হত্যা করা যাবে না। এমন বর পেয়ে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে উঠেন। তিনি ঘোষণা দেন, তিনিই দেবতা।

সুতরাং দেবতা হিসেবে তাকেই পূজা করতে হবে। কেউ এই আদেশ পালন না করলে তিনি তাকে শাস্তি দিবেন বা হত্যা করবেন। এমন ঘোষণা শুনে তাকে দেবতা হিসেবে পূজা করতে প্রথমেই অস্বীকার করেন তারই পুত্র পরম বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ। তিনি বিষ্ণুর পূজাই চালিয়ে যেতে থাকেন। এতে হিরণ্যকশিপু খুবই রাগাম্বিত হন এবং প্রহ্লাদকে বিভিন্নভাবে হত্যা করার চেষ্টা করেন। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন ছিলেন হোলিকা। তাঁর ছিল ব্রহ্মার দেওয়া একটি চাদর। যা আগুনে পুড়বে না। দৈত্যরাজ প্রহ্লাদকে পুড়িয়ে মারতে হোলিকার সাহায্যপ্রার্থী হন। তাঁর কথামতো প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে হোলিকা আগুনে প্রবেশ করেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে হোলিকার শরীর থেকে ব্রহ্মার দেওয়া চাদরটি খসে ভক্ত প্রহ্লাদের শরীরের উপর পড়ে। এতে হোলিকা পুড়ে মারা যান এবং ভক্ত প্রহ্লাদ বেঁচে যান। তখন থেকেই হয়ে আসছে হোলিকা দহন বা ন্যাড়া পোড়া অথবা বুড়ির ঘর পোড়া অনুষ্ঠান।

ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু ছাড়াও জৈন ধর্ম্, নেপালের বৌদ্ধ এবং শিখ ধর্মেও এই উৎসব পালন করতে দেখা যায়। ট্রিবিউন ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুসারে, আঠারো শত সাইত্রিশ সালে লাহোরে রঞ্জিত সিংহ ও তাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তিনশ’ মাউন্ড-এর রঙ ব্যবহার করেছিলেন। বিলাবল বাগানে উদযাপিত এই উৎসবে তৎকালীন বৃটিশ ভারতের প্রধান সেনাপতি স্যার হেনরি ফেনসহ ইংরেজ কর্মকর্তাগণও যোগদান করেছিলেন। এরপর থেকে রঞ্জিত সিংহের বংশধররা এই উৎসব পালন করে আসছে।

পরিশেষে বলা যায়, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা ও দোলযাত্রা এই তিনটি প্রধান উৎসব রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণবরা পালন করেন। এই তিন বৈষ্ণবীয়-উৎসবের মধ্যে দোলযাত্রার একটা সর্ব্ ভারতীয় চরিত্র রয়েছে। ভারতের প্রতিটি কোণেই এমন উৎসব ছড়িয়ে রয়েছে। যেখানে দোলযাত্রায় সবাই একত্রিত হয়ে আনন্দে মেতে উঠেন। প্রাচীনকাল থেকে বিস্তর আনন্দের ধারায় বহমান দোল উৎসব সবাই সবার দুঃখ, বাদ-বিবাদ ভুলে গিয়ে আবার নতুনভাবে, নতুনরূপে জীবন শুরু করে পৃথিবীকে স্বর্গসম করে তুলবেন, এমন কামনা রইল।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test