E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অর্থনীতির স্বার্থে পোশাক শিল্পকে দ্রুত শঙ্কামুক্ত করুন

২০১৫ ফেব্রুয়ারি ২২ ১৬:৪৬:৫৫
অর্থনীতির স্বার্থে পোশাক শিল্পকে দ্রুত শঙ্কামুক্ত করুন

মো. আতিকুর রহমান : বর্হিবিশ্বের আমাদের এই ছোট ভূ-খণ্ড বাংলাদেশকে অধিক পরিচিত করাতে দেশের সম্ভাবনাময় যে খাতটি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে তা হলো তৈরি পোশাক শিল্প। আজ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই শিল্পের বদৌলতে এদেশকে চিনতে শিখেছে। দেশের সম্ভাবনাময় এই রপ্তানি পোশাক শিল্পটি দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। নারীর ক্ষমতায়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ, অধিক কর্মসংস্থান এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উক্ত খাতটি বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

বিশেষ করে এই খাতে প্রায় ৮৫ ভাগ নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান প্রদান, যা বিরল তা হয়তো বা অন্য কোন খাতে সম্ভব নয়। যদিও আমরা অতি অল্প সময়ে শিল্পে শতভাগ সাফল্য, সেই সঙ্গে শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও উদ্যোক্তাদের এই খাতে অধিক বিনিয়োগ বিশ্বে উক্ত শিল্পকে দ্বিতীয় অবস্থানে নিতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু ধারাবাহিক চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতায় দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া এই খাতটি এখন ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। লাগাতার হরতাল-অবরোধের কারণে প্রতিদিন এই খাতে প্রায় ৬৯৫ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তথ্য মতে, চলমান রাজনৈতিক ডামাঢোলে এরই মধ্যে ১২টি পোশাক কারখানায় ১২৯ কোটি টাকা ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। এই খাতে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন, ব্যাংক ঋণ পরিশোধসহ নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও শিল্পকে বিনষ্ট করে, আতঙ্ক সৃষ্টি করে, মানুষ মেরে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে এবং দেশের অর্থনীতির কবর রচনা করে কোনো রাজনৈতিক দলের এহেন রাজনৈতিক কর্মসূচী চলতে পারে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব এহেন রাজনৈতিক এজেন্ডা পরিহার করে দেশের অর্থনীতিকে আরো কিভাবে অধিক চাঙ্গা করা যায় সেই দিকে রাজনৈতিক দলগুলো আরো অধিক মনোনিবেশ করবেন এমনটিই সকলের প্রত্যাশা।

যদিও দুঃখজনক হলেও সত্য, এই খাতে বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের নাশকতা ও অনিশ্চয়তার হাত থেকে যখন পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িকরা কিছুটা স্বস্তি পেতে শুরু করেছে এবং আগামি সাত বছর অর্থ্যা ২০২১ সালে দেশের স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে এই খাতে রপ্তানি আয় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ বিলিয়নের উন্নীত করার স্বপ্ন দেখছে, ঠিক সেই মূহুর্তে ব্যবসায়িকদের উক্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতার বিপরিতে গত ৫ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে বিএনপি জোটের লাগাতার অবরোধে, হরতাল ও নাশকতা উক্ত শিল্পের অগ্রগতির ধারাকে বাধাগ্রস্ত করছে। যদিও বাস্তবতার নিরিখে বলতে হয়, যখনই উক্ত শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে শুরু কওে, ঠিক তখনিই কোন কোন ভাবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ শিল্পকে ঘিরে নানা রকম নাশকতা সৃষ্টি হয়, যা কাম্য নয়। তাই দেশের স্বার্থে উক্ত শিল্পকে বাচাতে যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক সহিংসতা নিমূর্ল করতে হবে এবং শিল্পটিকে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকান্ড, হরতাল ও অবরোধের মত কর্মসূচীর আওয়ামুক্ত রাখতে হবে। যদিও এ খাতের সাফল্য হিসেবে বলতে হয়, বিগত বছরে রাজনৈতিক নানামুখী অস্থিরতার মধ্যেও এই খাতে ১১ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এবং ব্যবসায়িকদের ভাষ্য মতে, অনুকুল পরিবেশ পেলে তা ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে, যা সকলের জন্যই গৌরবের বিষয়। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেটি বাধাগ্রস্ত হবে তা কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত যত দ্রুত সম্ভব বস্ত্র, পোশাক শিল্প তথা সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা ও সমগ্র অর্থনীতির স্বার্থে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অবসানের পথ খুঁজে বের করা ও প্রয়োজনে হরতাল নামের এই নাশকতাকে আইন করে দ্রুত বন্ধ করা এবং শিল্পের সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরী। সেইসঙ্গে সকল রাজনৈতিক দলের উচিত দেশের অর্থনীতি সচল রাখার মতো রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করা। যদিও বলতে দ্বিধা নেই, যেখানে দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি এই শিল্পকে সচল রাখতে ব্যবসায়িকদের চাইতেও সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভুমিকা হওয়ার কথা ছিল মুখ্য, কেননা তার দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতি করেন। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমরা দেখছি এর পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র যা দুঃখজনক। কেবলমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত হীনস্বার্থে, দেশ ও দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে এবং জনগণকে জিম্মি করে দলগুলোর ক্ষমতা দখলের এহেন রাজনীতি দেশ তথা জনগণের স্বার্থে কখনই কাম্য হতে পারে না। তাই রাজনৈতিক দলগুলো উচিত দেশ ও জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করার যে নছিয়ত তাঁরা সর্বদা করেন, তা সত্যিকারে বাস্তবায়নে দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে সচল রেখে রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করা সমীচীন। সেই পথেই রাজনীতিকরা হাঁটবেন তথা দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করবেন এমনটিই জাতি অধিক প্রত্যাশা করেন।

বিগত বছরে তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ধস, জিএসপি প্রত্যাহার ও অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স কারাখানা পরিদর্শনসহ নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে পোশাক শিল্প উদ্যোক্তরা যখন রফতানি আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক তখনি বিরোধী দলের টানা হরতাল-অবরোধের কারণে বর্তমানে এই শিল্পে ৩০ শতাংশ অর্ডার কমে গেছে, যা দুঃখজনক। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যবসায়িকদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধসহ শিল্পে সমগ্র সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে পড়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যা দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও এই শিল্পকে কঠিন এক বিপর্যয়ের দিকে ধাপিত করবে। এইরূপ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির দাবিতে দেশ ও দেশের সার্বিক অর্থনীতি তথা উক্ত শিল্পের স্বার্থে এক প্রকার নিরুপায় হয়েই শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীকদের পক্ষ থেকে সাদা পতাকা মিছিল, মানববন্ধন ও দুই নেত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করতে হয়েছে। এখন দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও অধিক কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া উক্ত শিল্প তথা পোশাক ব্যবসায়িকদের ২০২১ সালের কাঙ্খিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো স্ব স্ব অবস্থান থেকে কে, কি ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়? আমরা আশা করবো দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি এই শিল্পকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ এই শিল্পের জন্য নিরাপদ প্ল্যাটফম তৈরির লক্ষ্যে উনারা উভয়ই প্রয়োজনীয় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। যা হবে দেশ ও দেশের সার্বিক অর্থনীতি, ব্যবসায়িক ও শিল্পে নিয়োজিত হতদরিদ্র্য শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও বর্তমানে দেশের গর্ব তৈরী পোশাক শিল্প ঘিরে বারবার ষড়যন্ত্র, নাশকতা ও অচলাবস্থা তা কার স্বার্থে, এখন প্রশ্ন এখন সকলের মুখে মুখে? যদিও অনেকেই উক্ত শিল্পে অস্থিতিশীল পরিস্থির জন্য রাজনৈতিক কর্মকান্ডের দিকেই বারবার আঙুল তুলছেন। দেশের অর্থনীতির প্রাণ যে পোশাক শিল্প তা রাজনৈতিক এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য এখন অনেক ক্রেতাই অর্ডার দিচ্ছেন না বাংলাদেশকে, যা ইতিমধ্যেই পোশাক শিল্প মালিকদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। যদিও বা এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কিছু ক্রেতা দেশ এখনও কাজ দিচ্ছে কিন্তু বিদ্যমান ধারাবাহিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তারা পূর্বে পন্য সরবরাহের দামের চাইতে তা আরো কমাতে নতুন করে দরকষাকষি শুরু করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা এদেশে পোশাক কেনার আগ্রহ দেখালেও দিতে চাইছেন না পূর্বের দাম। এতে রাজি না হলে তারা অন্য দেশে চলে যাওয়ার হুমকি ও নানা শর্ত দিয়ে পোশাক মালিকদের ওদের জালে আবদ্ধ করছে। আবার অনেকে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝামেলা এড়াতে বেশি দামে পন্য কিনতে পার্শ্ববতী দেশের দিকে অধিক ঝুকছেন। যা এদেশের তৈরী পোশাক শিল্প তথা দেশের সার্বিক অর্থনীতি, অধিক কর্মসংস্থান এবং সকলের জন্য অশুভ বলে মনে করি। এই প্রসঙ্গে জাতীয় এক দৈনিকে বিজিএমইএ এর সভাপতি মো. আাতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে ৫ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি নয়, এ দেশের মাটিতে পোশাকশিল্পের কবর রচনা হবে।’ যা কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যেকোন কর্মসূচী দেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে উক্ত বিষয়গুলোকে মনে রাখতে হবে।

বর্তমানে পোশাক শিল্পে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে শিল্পে যদি কোন ক্ষতি হয় তবে তার হাওয়া লাগবে সকলের গায়েই। দেশ হবে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, যার নেতিবাচক প্রভাব পরবে দেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায়। সামাজিক অবক্ষয়, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বেকারত্ব ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশ ও জাতি ক্রমেই অন্ধকারের অতল গহবরে নিমজ্জিত হবে। যা হবে পুরো দেশ ও জাতির জন্য অমঙ্গলময়। আমরা চাই না, এই শিল্পকে নিয়ে আর কোন ষড়যন্ত্র ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হোক। ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বেকারত্ব এদেশের মানুষকে গ্রাস করুক। যা হয়তো কারো জন্যই সুফল বয়ে আনবে না। আমরা চাই শিল্পেকে ঘিরে যে নৈরাজ্য ও অচল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এর স্থায়ী সমাধান। আর এর জন্য প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের অধিক সদিচ্ছা। বিশেষ করে দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় ও অধিক কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া পোশাকশিল্পের যথাযথ গুরুত্ব ও অবদানের কথা মাথায় রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিল্পে নৈরাজ্যকর ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি লাঘব করতে সরকার ও বিরোধী দলগুলো দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। বিশেষ করে শিল্পে চলমান বৈরী পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের মনে রাখতে হবে কারো কোন ভুলের কারণে যেন উক্ত শিল্পটি বিপর্যস্ত ও কবর রচনা না হয়। তাই যতদ্রুত সম্ভব শিল্পকে রাজনৈতিক সকল এজেন্ডার উর্ধ্বে রেখে হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত করতে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কার্যকরি ভূমিকা রাখবেন এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতির কল্যাণ স্বার্থে সকলে মিলে শিল্পকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন-এমনটিই ব্যবসায়িক তথা জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান ও কলামিস্ট

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test