E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয় ও বিচিত্র অনুভূতি গাঁথা

২০১৫ মার্চ ১০ ১৭:০৭:০৪
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয় ও বিচিত্র অনুভূতি গাঁথা

মঈনুল ইসলাম রাকীব : যখন এই অনুভূতি প্রকাশের ইচ্ছে জেগেছে তখন আমি মিছিলে। হৃদয়ে সুখের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সর্বস্তরের বাঙালি,বাংলাদেশী একসঙ্গে এমন আনন্দ করা যেন ভুলতেই বসেছিল। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের বিজয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। হরতাল ১২ ঘন্টা হ্রাস করা হয়েছে। ক্রিকেটের এমন অমিত শক্তি যা সকল মতাদর্শকে একটি জায়গায় এক করেছে। ইতহাস সৃষ্টি সুখের উল্লাসে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রাণ রাস্তায় নেমে এসেছে।

৮ রানে ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর যেভাবে সেীম্য ও মাহমুদুল্লাহ প্রতিরোধ গড়েছে, মুশফিক এসে তাণ্ডব চালিয়েছে তা বর্ণনা করার মত ভাষা আমাদেও জানা নেই। আর এরপরের ঘটনা একটি ইতিহাস। রুবেল নামের বাংলাদেশী এক গতি দানবের দুটি বিধ্বংসী ডেলিভেরি প্রতীকি অর্থে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। তারপর সমগ্র বাংলাদেশ আনন্দে মেতে ওঠে। যেন সবাই আত্মহারা,কোথায় কোন হরতাল,অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও বা গুলি খেয়ে মরার ভয়?এ এক নবজাগরণ। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে উল্লাস। এ যেন পলাশীর হালকা একটি প্রতিশোধ!মিছিলের পর মিছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারী কার্যালয় থেকে ফটপাথের চায়ের দোকানে উল্লাস। এ এক অপার্থিব ভালো লাগা, এর নাম দেশাত্মবোধ,এর নাম জাতীয়তাবোধ। এই অদৃশ্য শক্তিবলে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-ছাত্র-মজুর-ব্যবসায়ী-রাজনীতিবীদ-সাংবাদিক-শিক্ষক-আস্তিক-নাস্তিক-কৃষক-শ্রমিক-বৃদ্ধ-তরুণ-শিশু-নারী-পুরুষ-বাম-ডান সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে এই বলে-তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।


যারা সমগ্র জাতিকে একটি বন্ধনে বাঁধতে মাঠে নেমেছে, খেলেছে ও জিতেছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সেইসব বীরসেনাদের প্রতি হৃদয়ের একেবারে গভীর থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ।

৯ মার্চ সকাল থেকেই দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর টিভিরুম পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এ যেন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র উপলব্ধি যে প্রিয় বাংলাদেশ আজ জিতবেই। বাংলাদেশর বিজয়ের সঙ্গে জাবির সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহাসিক হল আল-বেরুনীর আবাসিক পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী বাইওে বেরিয়ে আসে। তারা বাংলাদেশ বাংলাদেশ, রুবলের বাংলাদেশ, মাশরাফির বাংলাদেশ, মুশফিকের বাংলাদেশ বলে শ্লোগানে পুরো ক্যাম্পাস মুখরিত করে তোলে। সারা ক্যাম্পাস ঘুরে অন্যান্য হলের প্রায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে নেচে গেয়ে আনন্দ-উল্লাস করে। এসময় রাস্তা দিয়ে বাসে যাওয়া সাধারণ মানুষও হাত নেড়ে আনন্দে অংশগ্রহণ করে। রিকশাওয়ালা, দিনমজুর এমনকি কর্তব্যরত পুলিশও সমর্থকতের সঙ্গে বিজয়োল্লাসে যোগ দেয়। এর নাম প্রেম!
আমাদের গলাটা চিল্লাতে চিল্লাতে একটু বেশিই ভাঙছে। আমার গলা একবারেই বসে গেছে। ৩০ রানের পরে যখন ব্রড ছক্কা মারলো তখন চোখ দিয়ে পানি ঝরেছে শঙ্কা আর ভয়ে। আবার রুবেলের উইকেট প্রাপ্তি দেখেই তীব্র চিত্কার করে বন্ধু,বড় ভাই ও ছোট ভাইদের সঙ্গে হৈহুল্লড় শুরু করি। প্রত্যেক বলের আগেই আল্লাহ আল্লাহ করেছি আমরা। অবশেষে জিতেছি,আমাদের প্রিয় দেশটা জিতেছে। বাংলাদেশ জিতেছে।

চিৎকার করে আমরা জানিয়েছি- দ্যাখ, ব্রিটিশদের হারিয়েছে আমার দেশ, আমার বাংলাদেশ। ক্লাইভের উত্তরসুরীদের বিশ্ব লড়াই মঞ্চ থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে সিরাজের উত্তরসুরীরা, তিতুমীর, ভবানী পাঠক, সূর্যসেন, ফকির মজনু শাহ, শরিয়তউল্লাহ ও ঈশা খাঁর বংশধরেরা জেগে উঠেছে বিজয়ীর বেশে।এডিলেড যেন খেলার মাঠের পলাশীর প্রান্তর!
প্রথমবারের মত ক্রিকেট বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলো বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করে মাহমুদ উল্লাহর শতক ও মুশফিকের ৮৯ এর কাঁধে ভর করে বাংলাদেশ ২৭৫ রান করে। জবাবে ইংল্যান্ড ৯ বল বাকি থাকতেই ২৬০ রানে অলআউট হয়। রুবেল হোসেন ৪ টি, মাশরাফি ২ টি ও তাসকিন ২ টি উইবেট নেন। মুশফিকুর রহিম একাই চারটি ক্যাচ নেন।

বাংলাদেশের বিজয়ে যাদের আনন্দ প্রকাশটা একটু বেশিই ছিল আমি তাদেও একজন। কারণ আমি ভারত বা পাকিস্তান কোন দেশের সমর্থন করি না। এ দু’দেশের খেলা কবে কি এ নিয়ে কখনো আমার মাথাব্যথা থাকেনা। আমার একটাই দেশ, একটাই দল। সেটি বাংলাদেশ। আমি অহংকার করেই বলি যেস্বদেশের ঠাকুরদের ছেড়ে বিদেশের কুকুরদের প্রতি আমি আসক্ত নই। একারণেই তীব্র উচ্ছ্বাসে টিভিরুম, হল,ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশের বিজয়ে আনন্দিত অন্যদের নিয়ে। এ এক পরম তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতা, দেশের বিজয়ে শ্লোগান দেয়া যেন দেশের জন্য যুদ্ধে নামার স্বাদ!

আমরা স্কটল্যান্ডকে হারিয়েছি, ইংল্যান্ডকে হারালাম,কাল ইন শা আল্লাহ নিউজিল্যান্ডকে হারাবো। তারার আধিপত্যবাদী ভারতকে হারাবো। স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মত গ্রেট ব্রিটেনের অধীনে ছিল। এই দুই রাজ্যকে হারিয়ে বাংলাদেশ আসলে সমগ্র গ্রেট ব্রিটেনকেই হারিয়েছে। অনেকের মত আমিও বলেছি এ বিজয় পলাশীর হালকা একটা প্রতিশোধ।

বাংলাদেশ যদি নিউজিল্যান্ডকে হারায় তবে সম্ভবত পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা পড়বে। তখন স্বাধীনতার মাসে হানাদারদের উত্তরসুরীদের হারিয়ে আমরা আরো একটি ইতিহাসের জন্ম দিবো। রমিজ রাজার মত বেয়াদবের মুখে চুনকালী দিতেই আমরা জিতবো, ৭১ এর মহান শহীদদের আত্মাকে শান্তি দিতে আমরা পাকিস্তানকে পরাজিত সৃষ্টিকর্তার কৃপায়।

আর যদি নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে প্রত্যাশিত বিজয় না আসে তবে আমাদের খেলা পড়বে ভারতের সঙ্গে। আমাদের দেশ সেরা পেসার ও নিবেদিত অধিনায়ক মাশরাফি ঘোষণা করেই দিয়েছেন ভারতকে মোকাবেলা করতে আমরা প্রস্তুত। হ্যাঁ আমরা সত্যিই প্রস্তুত। ভারতকে পরাজিত করা এখন সময়ের দাবি। আজ প্রায় ১৭ বছর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পূর্ণাঙ্গ সদস্য, প্রায় ৬০ বছর ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ক্রিকেটের সাথে যুক্ত প্রতিটি দেশেই বাংলাদেশ সফর করেছে। তৎকালীন পরপর দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত সম্মানের সাথে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। অথচ একটি দেশ আজো বাংলাদেশকে তার ভূখন্ডে খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি, এমনকি ২০২০ সালের আগে আইসিসির স্বাভাবিক নিয়ম লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের সফরকে আটকে দিয়েছে। কোন সে দেশ?

সেই দেশ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত। এই বঞ্চনার প্রতিশোধ নিতেই এদের হারাতে হবে। বিপিএল বন্ধ করার প্রতিশোধ নিতে ভারতকে হারাতে হবে। বোন ফেলানীসহ সীমান্তের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে ভারতকে হারাতে হবে। তিস্তার পানি আটকানোর অপরাধে এবং আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেল, পণ্য ও সংষ্কৃতির উপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ভারতকে হারাতে হবে। সেই অপেক্ষায় ১৬ কোটি মানুষ।

এবার বাংলাদেশের কয়েকজন জাতীয় বীরকে নিয়ে কয়েকটি কথা বলি। প্রিয় অধিনায়ক মাশরাফির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অজস্র ভালবাসা যে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ঐতিহাসিক বিজয়কে উৎসর্গ করেছে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি। হাঁটুতে একের পর এক অস্ত্রপচার নিয়ে দেশের জন্য মাঠে থেকেছে মাশরাফি। পায়ে ব্যান্ডেজের পর ব্যান্ডেজ নিয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দেশের স্বার্থে যে দেশের অধিনায়ক মাঠে থাকে ,কষ্ট করে বল করে সেই দেশ,সেই জাতিকে পরাজিত করার শক্তি কারো নেই। অস্ট্রেলিয়া খাতা কলমে এখনো গ্রেটব্রিটেনের উপনিবেশ।আর সেই উপনিবেশেই লাল সবুজ পতাকায় ছুঁয়ে গেছে তাই। কোথাও লাল ক্রস নেই, বাঘের গর্জনে সাম্রাজ্যবাদীদের খুঁজে পাওয়া যাইনি।লাল সবুজ পতাকাবাহীরা আরো একবার বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে,বাংলাদেশী বাঙালি হারেনা, বাংলাদেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে-যুদ্ধ করেই ব্রিটিশদেও হারিয়েছে।

রুবেল হোসেন আরেকজন জাতীয় বীর। ম্যাচটি যখন হাতছাড়া হয়ে গেছে তখন সম্পূর্ণ একক নৈপুণ্যে এক বল অন্তর শেষ দুইটি উইকেট নিয়ে রুবেল হোসেন বিশ্ব ময়দানে লাল-সবুজ পতাকাকে উপরে তুলে ধরেন। তাঁর নামে জনৈকা দ্বিতীয় শ্রেণীর নায়িকার করা সকল মিথ্যা ও হয়রানীমূলক মামলা প্রত্যাহারের জোর দাবি জানাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ৩৬তম ব্যাচের ছাত্র মুশফিক ভাই চিরদিন শুধু দেশের জন্যই খেলে গেলেন, নিজের কথা ভাবলো না। বিনয়ী এই সাবেক অধিনায়ক চাইলেই এ ম্যাচে সেঞ্চুরী করতে পারতেন। দেশের কথা ভেবে সেদিকে নজর দেননি। তাসকিন ও সাব্বির এবং মাহমুদুল্লাহসহ সৌম্য সরকারকে অভিনন্দন। এবং এ গ্রহের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের প্রতি এক সহস্র পাতার আশা রাখলাম নিউজিল্যান্ডের ও ভারতের সঙ্গে ম্যাচে জ্বলে উঠার।

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল জাতীয় ঐক্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি। এই ক্রিকেটই ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও রাজনৈতিক মতাদশর্ককে পিছনে ফেলে সমগ্র বাংলাদেশকে একটি সূতায় গেঁথে ফেলে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম ডান, আস্তিক-নাস্তিক সবাই লাল আর সবুজের বিজয়ে প্রলয়োল্লাস করেছে একসাথে, পাশাপাশি থেকে। এই ক্রিকেটের জন্যই একসঙ্গে সকলেই গায় বাংলাদেশের গান। উন্মাদনায় নাচে, মাতে আর উচ্চস্বরে শ্লোগানে মুখরিত করে সবুজ ভূখণ্ড- বাংলদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ...অজস্রবার বাংলাদেশ বলে।

বাংলাদেশ চিরঞ্জীব, বাংলাদেশ অদ্বিতীয়, বাংলাদেশ আমাদের গর্ব, বাংলাদেশ আমাদের স্বর্গ ।

লেখক : মুক্ত সাংবাদিক

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test