E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দেশে ভয়ঙ্করভাবে বাড়ছে অপরাধ, দেখার যেন কেউ নেই!

২০১৫ আগস্ট ০৭ ১৭:১২:২৯
দেশে ভয়ঙ্করভাবে বাড়ছে অপরাধ, দেখার যেন কেউ নেই!

মো. আলী আশরাফ খান : অপ্রিয় হলেও অতি সত্য যে, দেশ দিনে দিনে এক ভয়াবহ অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মহাকালো ছায়ার আবর্তে যেন সমাজ আটকে যাচ্ছে দিনকেদিন। এখন ভাল কথা যেমন কেউ শুনতে চায় না তেমনি ভাল কাজ যারা করছেন তাদেরকেও পছন্দ করছে না সমাজের কথিত নেতাদের মত অনেকেই। আজকাল সিংহভাগ নেতাদের ভাবসাব এমন যে, তাদের ছাড়া অন্য কেউ ভাল কথা এবং ভাল কাজ করতে পারে না-পারার কথাই না! অথচ এখন দেশজুড়ে চলছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবজি, মাদকবাণিজ্য, ইভটিজিং, পরকীয়া ও মিথ্যার বেসাতিসহ গুরুতর সব অপরাধ।
 

শুনতে খারাপ শোনা গেলেও বলতে হচ্ছে যে, দেশে নামে আছে নেতা শতশত দেখার যেন নেই কেউ এসব ভয়াবহতা! বরং অনেক সময় নেতাদের যোগসাজসেই হৃদয়ে শিহরণ জাগানোর মত গুরুতর এসব অপরাধ একেরপর এক সমাজে ঘটেই চলছে; অথচ এসব দেখার যেন কেউ নেই, নেই কেউ রোখার! আশাহত জাতি এখন এর লাগাম টানার মত কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন তারা এসব ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর ধামাচাপা দেয়ার জন্য ওঠে পড়ে লেগে যায় এবং এর পাশাপাশি পুলিশ যেমন ঘুষবাণিজ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে তেমনি সরকারি দলের নেত-কর্মীরাও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ওইসব অপরাধ মাটিচাপা দিতে যারপরনাই চেষ্টা চালিয়ে যায়।

আমরা জানি, পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হলো মায়ের গর্ভ। অথচ, সেই নিরাপদ স্থানেও রক্ষা পায়নি একটি হতভাগ্য শিশু। গুলিবিদ্ধ হয়ে সে হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত। শুধু কি তাই, অতি সাধারণ ছুতো ধরে দেশে অমানষিক, নিষ্ঠুর-নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে শিশুদের। কোথায় বাস করছি আমরা! সিলেটে রাজন, খুলনার রাকিব, চট্টগ্রামের পিকন দে ও বরগুনার রবিউলের মতো কিশোরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এমন কি ছিল তাদের অপরাধ? যেসব অপরাধের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আনা হয় তা ছিল খুবই নগন্য ও তুচ্ছ।

সব শেষ আশংকা প্রকাশের চার দিনের মাথায় ৭ আগস্ট খুন হলেন ব্লগার নিলয় নীল। রাজধানীর গোড়ানে বাসায় ঢুকে নীলয় নীল নামে এক ব্লগারকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। খিলগাঁও থানার ওসি মুস্তাাফিজুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে এ খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার বেলা পৌনে ২টার দিকে গোরানের একটি পাঁচতলা ভবনের এক বাসায় এ হত্যাকা- ঘটে। নিহত নিলয় চৌধুরী (৪০), স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওই বাসায় থাকতেন। অনলাইনে তিনি লেখাপড়া করতেন নিলয় নীল নামে। এছাড়া সম্প্রতি ৩ রা আগস্ট নিজের ফেসবুক পোস্টে হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। জুমার নামাজের পর বাসা দেখার নাম করে হত্যাকারীরা বাসায় ঢোকে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। এতেই প্রতিয়মাণ হয় যে সমাজ এক চরম অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং সরকারও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ।

আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরাও এখন জড়িয়ে পড়ছে খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি পরকীয়া, মাদক ব্যবসাসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধে। হঠাৎ করে দেশের এই করুণ অবস্থা হওয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে দেশবাসী। জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও দেখা দিয়েছে চরমভাবে। এখন অনেকেই মনে করছে, দেশে সরকারের দুর্বলতা, যথাযথ আইনের শাসন ও পুলিশের ভূমিকা না থাকার ফলেই অসব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। আমরা দেখছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষসহ অপরাধীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। যা একটি দেশ-জাতির জন্য বড় রকমের অশনিসংকেতই বলা যায়। মানুষ মনে করছে, অপরাধের শাস্তির নিশ্চয়তা নেই এ দেশে। যার কারণে অনেকেই আইনকে হাতে তুলে নিচ্ছে। আর অপরাধীরাও নির্ভয়ে আরো গুরুতর অপরাধ করতে সাহস পাচ্ছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত সূত্র থেকে জানা যায়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার তথ্য যাচাই করে দেখা যায় যে, এ সময়ে গুরুতর অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক। এর পাশাপাশি আইনশৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে বাড়ি থেকে তুলে নেয়ার পর গুম অথবা ঝোঁপঝাড়ে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে অহরহ। সাম্প্রতিক সময়ে গুরুতর অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় নাগরিক জীবনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত কয়েকদিনে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, পরকীয়া ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা খুবই আশঙ্কাজনক।

ডিবি পরিচয়ে ঢাকা ও গাজীপুরে আটকের পর ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার সূত্র জানা যায়, গত জুন মাসে ৩৫৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আর মে মাসে ঘটেছে ৪২০টি হত্যাকাণ্ড। জুন মাসে ছিনতাই ৬৫০, দস্যুতা ১০৩টি, ডাকাতি ৪৪টি, অপহরণ ৭৪টি ৫৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। জুলাই মাসের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি আরো গুরুতর। চলতি মাসের ৪দিনে আরো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে শুরু হয়েছে’।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানায়, ‘জুলাই মাসে বিনা বিচারে আইন শৃংখলা বাহিনী ৭ জনকে হত্যা করেছে। গুম করা হয়েছে ৪০ জনকে। তারমধ্যে লাশ পাওয়া গেছে ৯ জনের আর ২১ জনকে গুমের পর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের আজো কোন খবর নেই। ৫৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ৭ মাসে ধর্ষিত ৩৬৬ জন নারী ও কিশোরী। চলতি মাসের গত কয়েকদিনের অপরাধ পর্যালোচনা করেই দেখা যায়, দেশের আইন শৃংখলা এখন ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে আরো জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের নার্সিং কলেজের পাশ থেকে একটি ফেলে রাখা লাগেজের ভেতর থেকে ৪ আগস্ট মঙ্গলবার এলাকার মানুষের খবরের ভিত্তিতে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। কালো লাগেজের ভেতর আট-নয় বছরের একটি ছেলে শিশুর লাশ পাওয়া যায়। লাশের শরীরে আয়রনের সেঁকা দেয়ার চিহ্ন দেখেছে পুলিশ। পুলিশ অনুমান করছে, শিশুটি কোনো বাসায় কাজ করত। গুরুতর মারধর করা হয় শিশুটিকে। হয়তো তাকে মৃত ভেবে লাশ গুম করার উদ্দেশে লাগেজে ভরে ফেলে যাওয়া হয়েছে। শিশুটির পরণে শুধু একটা হাফ প্যান্ট ছিল। তার লাশ উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন শাহবাগ থাানার ওসি।

সিলেটে শিশু রাজন হত্যার পরপরই আমরা জানতে পারি, চট্টগ্রামের পিকন দে’কে মায়ের কাছে যেতে চাওয়ার অপরাধে তার মামা নির্মমভাকে তাকে খুন করে। এরপর খুলনায় শিশু রাকিবের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে জাতি হতবাক হলেও পরদিনই বরগুনায় তালতলায় আরো নিষ্ঠুর ও নির্মম কায়দায় খুন করা হয় ১১ বছরের শিশু রবিউলকে। এরপরই রাজধানীর পাশে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মহাসড়কের ফতুল্লা এলাকায় চলন্ত যাত্রীবাহী বাসে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। সোমবার রাত ১০টার দিকে ঢাকা থেকে একটি যাত্রীবাহী বাস নারায়ণগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। বাসটি ফতুল্লা থানার মাহমুদ নগর এলাকায় পৌঁছলে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা বাসটি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে। এতে অজ্ঞাতনামা এক যাত্রী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনার হোতাদের এখনো আটক করতে পারেনি পুলিশ। গত ২৩ জুলাই মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়ে যুবলীগের দু গ্রুপের সংঘর্ষে মোমিন ভূঁইয়া নামে একজন মারা যান। ওই সংঘর্ষে মা নাজমা খাতুন (৩০) ও শিশুও গুলিবিদ্ধ হয়। যা বিশ্বব্যাপি নিন্দার ঝড় তুলে। বুলেটবিদ্ধ শিশু ও মা এখনও ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্ছা লড়ছে।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে দুলাল গাজী (৫০) নামে একজনকে গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তিনি ঈদগাহ মসজিদের খাদেম বলে জানা গেছে। ৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলায়। রাজধানীর মুগদা এলাকায় ৪ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল বাসিত খানের কার্যালয়ের সমানে গুলিবিদ্ধ হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল ইসলাম সর্দার (৫০)। তিনি শফিকুল ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলে জানা যায়।

রাজধানীর মিরপুর ব্যবসায়ী ওমর ফারুক মিথ্যা মামলা ও জীবনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। একটি প্রতারক চক্র তাকে প্রাণ নাশের হুমকি দিচ্ছেন বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় চাঁদার দাবিতে সন্ত্রাসীদের হামলায় মোজ্জাফর হোসেন (৫৪) নামের এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জানা গেছে, মোজ্জাফর হোসেন যাত্রাবাড়ী থানাধীন আর কে চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের সদস্য। তার কাছে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিল। ২ আগস্ট রোবরবার সন্ধ্যায় তিনি সায়েদাবাদ এলাকার বায়তুল মামুর জামে মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলেন। এ সময় স্থানীয় সন্ত্রাসী সালাম, জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন তার ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত জখম করে।

ধর্ষণ সন্ত্রাসে তো এখনও রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ! রাজধানীতে প্রতিদিনই শিশু ও কর্মজীবী নারী ধর্ষিত হচ্ছে। গণধর্ষণের ঘটনা যেন বেড়েই চলছে দিনেদিনে। যা খুব কমই প্রকাশ পাচ্ছে। রাজধানীর হাজারীবাগের রায়েরবাজারে সাত বছর বয়সী একটি মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যায়। রাজধানীর উত্তরায় একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের অভ্যর্থনা কর্মীকে তিন দুর্বৃত্ত গণধর্ষণ করে। চিকিৎসকরা বলছেন যে, ‘দলবেঁধে ধর্ষণের প্রাথমিক আলামত পাওয়া গেছে।’ এর আগে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় চলন্ত গাড়িতে তুলে এক বিক্রয় কর্মীকে ধর্ষণ কর হয়। জুলাই মাসে সারাদেশে মোট ৩৬৮ জন নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৮৩টি। ৪ আগস্ট মঙ্গলবার পরিষদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, ‘ওই মাসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫ জন। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে নয় জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৯ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ১০ জন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন একজন’। সংস্থাটির লিগ্যাল এইড উপপরিষদে সংরতি ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ‘জুলাই মাসে ৬২ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪১ জন নারী। তাদের মধ্যে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে। এসিডদগ্ধ হয়েছেন চারজন। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ছয়টি। পাচার হয়েছে চারজন নারী ও শিশু। এর মধ্যে যৌনপল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে দু’জনকে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন চারজন। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে দুজনকে’। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘ওই সময়ের মধ্যে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ২৪ জনকে। এর মধ্যে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন একজন। ফতোয়ার শিকার হয়েছেন সাতজন’।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘শুধু দায়ী বা আসামির সাজা দিলেই হবে না; এসব মামলার তদন্তে পুলিশ প্রশাসন কিংবা সরকারের অপর কোনো বাহিনীর গাফিলতি আছে কিনা সেটাও খুঁজে বের করতে হবে। রাজন, রাকিবসহ যে কোনো শিশু হত্যার ঘটনায় কোনো পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্য দায়ী থাকলে তাদের বিরুদ্ধ ফৌজদারি আইনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্লোজ বা সাময়িক বরখাস্ত নয়, বিচারের আওতায় এনে দায়ীদের শাস্তি দিতে হবে’। শিশু হত্যার জন্য দায়ীদের প্রচলিত আইনে কঠোর শাস্তি দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

শিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়া প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ‘শিশু নির্যাতনের জন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকাও পরোক্ষভাবে দায়ী। এসব ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তলক শাস্তি না হওয়ায়ই বারবার শিশু নির্যাতনের নৃশংস ঘটনা ঘটছে। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোরও কোনো ধরনের ভূমিকা দেখা যায়নি’। তাই এসব নৃশংসতা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান তিনি।

এ ক্ষেত্রে অন্যান্যদের আমরাও মনে করি, ‘নৃশংস শিশু নির্যাতনের ঘটনার পর থানায় মামলা দায়েরে গড়িমসি, ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত ও তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা, দুর্বল চার্জশীট, বিচারে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, বিচারে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে থাকে। ফলে স্থানীয়ভাবে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না। এ সুযোগে অপরাধী গা ঢাকা দেয়। শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে দেখা গেছে, ‘গত সাড়ে তিন বছরে ৭৭৭ শিশু নির্যাতনে মারা গেছে। এর মধ্যে চলতি বছরের সাত মাসে ১৯১ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। একই সময় হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে আরও ১১ জনকে। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৫০, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯। শিশু অধিকার ফোরামের রেকর্ডে আরও দেখা গেছে, মোট ৬১টি ক্যাটাগরিতে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে মোট ২ হাজার ৮০১ শিশু নানামুখী নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে ৬ মাসে মোট ১৭৫ শিশু ও তরুণ। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ৫আগস্ট বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ২০১ জন শিশু হত্যা ও ৭০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশু নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধির এই প্রবণতা ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে, যা সমাজের জন্য আশঙ্কাজনক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক এবং পুলিশের নির্লিপ্ততা এই ধরনের সহিংস ঘটনা পুনরাবৃত্তির পথকে পরোক্ষভাবে সুগম করছে বলে সংগঠনটি মনে করছে’।

শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ইউনিসেফ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি নির্যাতন করে শিশুদের হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ। ৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার ইউনিসেফের প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বিগবেন্ডারের প থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে উদ্বেগের কথা জানানো হয়। এ ধরনের ঘটনা সম্পূর্ণভাবে শিশু অধিকারের নীতিবিরোধী বলে সংস্থাটি বিবৃতিতে উল্লেখ করে বলেছে, ‘শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো সারাদেশকে নাড়া দিয়েছে’। একই সঙ্গে এ ধরনের অপরাধকে জনসম্মুখে তুলে ধরার ক্ষেত্রে দেশের প্রিন্ট, ব্রডকাস্ট এবং সামাজিক মিডিয়ার দায়িত্বশীল ভূমিকার প্রশংসা করেছে সংস্থাটি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউনিসেফ মনে করে, শিশুদের বিশেষ করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ’।

বিবৃতিতে ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেগবেদার বলেন, ‘ইউনিসেফ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, বাংলাদেশ সরকার এই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আইন ও বিচারের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে। যাতে এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এডওয়ার্ড বেগবেদার বলেন, ‘শিশু নির্যাতন, প্রহার এবং হত্যাকান্ড এই দেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু শিশু অধিকার বিষয়ে ব্যাপক এবং স্বতঃস্ফূর্ত সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে এই ধরনের ঘটনা সবার নজরে আসছে। ইউনিসেফ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতের কাজ করছে।

তবে যে যাই বলুক আমাদের কথা হলো, আমাদের সমস্যা আমাদেরকেই সমাধান করতে হবে। সরকারকেই আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এসব ভয়াবহ সমস্যা সমাধানে। সরকার যদি মনে করে, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে তাহলে এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকার ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে যেন অনৈতিকতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়-এটাই এখন সময়ের দাবি। সরকারের নেতা-কর্মীরা যেন আর অপরাধ কর্মকাণ্ডে না জড়ায় তা সরকারকেই ভাবতে হবে। পুলিশ প্রশাসন পরিশুদ্ধ না হলে দেশে অপরাধ আরো বাড়বে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সরকার পুলিশকে তাদের দল কিংবা সংগঠনের কাজে ব্যাবাহার না করে যদি প্রকৃতই দেশের জন্য কাজ করার নির্দেশ দেন তাহলে দেশ রাতারাতি বদলে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

পরিশেষে আমরা একটি কথাই বলতে চাই, আমরা দেশে শান্তি চাই। আমরা চাই, আর একটি শিশুও যেন হত্যাকাণ্ডের শিকার না হয়। আমরা চাই, আর কোন শিশু-নারী যেন ধর্ষণের শিকার না হয়। আমরা চাই, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাক আমাদের এই সোনার বাংলা। আমরা চাই, নিরাপদ শান্তিময় একটি বাংলাদেশ। আর এটাই হোক শোকের মাসে আমাদের প্রত্যয়।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সংগঠক

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test