E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

২০১৫ আগস্ট ১৪ ১৬:০৭:৫৭
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

মো. মুজিবুর রহমান : বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম। একটি যুগান্তকারী নাম। তিনি বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙালি ।

বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির এই প্রাণপুরুষ ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বৃটিশ-ভারতের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা সাহেরা খাতুন। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন ভারত বর্ষে স্বাধীনতা আদায়ের দাবি আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিনিয়ত প্রবল হতে শুরু করে। স্কুল পড়ুয়া ছাত্র শেখ মুজিব একটি সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানের জের ধরে কংগ্রেস ও অন্যান্য পার্টির নেতাদের রোষাণলের শিকার হয়ে কারাবরণ করেন। সেই থেকে কারাবরণ শুরু।

রাজনৈতিক জীবনের ২৩ বছরের মধ্যে ১২ বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন নির্যাতিত ও নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের নেতা। যারা নির্যাতিত , নিপীড়িত ও মুক্তি চেয়েছেন তাদের মনের আশার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে তিনি চি্িহ্নত হয়েছিলেন। স্কুলে পড়াকালেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও প্রতিবাদী। পাশাপাশি ছিল মানুষের জন্য মমত্ববোধ। প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করার পর কলকাতায় পড়াশুনা করেছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আদর্শের সাথে সমন্বিত করে ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। চলার পথ যতই বন্ধুর হোক না কেন বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গেছেন। সকল বাধা- প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে সামনের দিকে।

ইতিহাসের মহাসড়কের পথ ধরে বঙ্গবন্ধু নিজস্ব পথ তৈরি করে এগিয়ে গেছেন। ত্াঁর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শুরু মুসলিম লীগের রাজনীতি দিয়ে । তা সত্বেও ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক বাহক। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের সামন্ত মানসিকতা ও শ্রেণি চরিত্র প্রত্যক্ষ করে অনেকের মতো তিনিও অনুধাবন করেন যে পাকিস্তান বাঙালি স্বপ্নপূরণে সমর্থ হবে না। আর যে মুসলিম লীগের পতাকাতলে তিনি নিজেও পাকিস্তান সুষ্টির আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাই হয়তো বেশিদিন সম্ভবপর হবে না বলে তিনি মনে করেন।

এ স্বাধীনতা প্রকৃত স্বাধীনতা নয় তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ১৯৫৪ সালে বাঙালির রাজনীতির রূপরেখা সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পেরেছিলেন। তিনি মাটি ও মানুষের কাছ থেকে এবং ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে পাঠ নিতেন বলেই গণমানুষের কাছের লোক হতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে
অধিকার, স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল এদেশের মানুষের কল্যাণ সাধন এবং স্বাধীন ও মুক্তির লক্ষ্যে তাদের চালিত করা। পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মনে সূর্যের আলোর প্রদীপ্ত শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছেন, জাতিকে করেছেন আত্মসচেতন, জাগিয়েছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বোধশক্তি, দিয়েছেন শ্লোগান : ‘জয়বাংলা’। ‘জয় বাংলা’ দিয়ে বাঙালি জাতিকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন। সেই সাথে বাঙালি জাতিকে একটি চেতনায়, একটি ভাবধারায় ও একটি আকাক্সক্ষায় তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছেন। পাকিস্তানী জান্তার আগরতলা মামলাসহ সব রকমের ষড়যন্ত্র বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু এ দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রাণের মানুষে পরিণত হন। বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা হয়ে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের দাবি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায় সেটাই প্রমাণ করে।

বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা কেউ ঠেকাতে পারবে না এবং কোন পশুশক্তি ও পরাশক্তির কাছে পরাজিত হবে না এ জাতি, তা বঙ্গবন্ধু একাত্তরের উত্তাল মার্চে বুঝতে পেরেছিলেন । এ জন্য মুক্তি ও স্বাধীনতার ডাক দিলেন সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে : “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তিনি বাঙালি জাতির শত বছরের বঞ্চনাকে মুছে দেবার জন্য স্বাধীনতার মর্মবাণী শুনিয়েছেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম প্রহরে। বাঙালি ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণে সক্ষম হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক হিসেবে বাঙালিকে উপহার দিলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’- এ জাতীয় সঙ্গীত।

ভাষাভিত্তিক ও জাতীয়তাবোধভিত্তিক রাষ্ট্র - বাংলাদেশকে একটি দেশের আত্মশক্তির প্রতীক করে তিনি বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরেছিলেন। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলায় তিনি জাতিসংঘে ভাষণও দিয়েছেন। জাতিসংঘের সাধারণ সভায় মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি শুধু বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেননি, ভাষা শহীদদের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের পরিব্যাপ্তি ছিল বাঙালি জাতিসত্তায় । বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে ভীষণ ভালবাসতেন বলেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন দিনে দেশের মাটিতে পা রেখেই সেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ছুটে যান লক্ষ লক্ষ অপেক্ষমাণ মানুষের সমাবেশে। ভাষণ দিতে গিয়ে উচ্চারণ করলেন : “... আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান , একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলেম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাব। ... তোমাদের কাছে ক্ষমা চ্ইাব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। ... আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। আমার ভাইদের কাছে, আমার মা’দের কাছে। আমার বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন। বাংলার মানুষ আজ আমার স্বাধীন। ১২ জানুয়ারি ‘৭২ বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে শুরু করলেন নতুন অভিযাত্রাা। পাশাপাশি তখন ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের এক জটিল প্রেক্ষাপট। এ অবস্থায় তিনি হাল ছাড়েননি। সে সময় তাঁকে ভাবতে হয়েছিল অনেক কথাÑ বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া ১ কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, প্রশাসন গড়ে তোলা, আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযোদ্ধা নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বাসন, অন্যান্য বাহিনী নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলা, সড়ক-সেতু ও রেললাইন পুনঃস্থাপন, দালালদের বিচার করা, আন্ডারগ্রাউন্ড দলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা, পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালি সরকারি-বেসরকারি জনগণকে ফিরিয়ে আনা, পরিত্যক্ত সম্পত্তির নিষ্পত্তি ইত্যাদি। দেশ পরিচালনার জন্য শাসনতন্ত্র দরকার , সেই নিরিখে চমৎকার একটি সংবিধান দিলেন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদিত হয়। চারটি মূল স্তম্ভের ওপর এই সংবিধান রচিত হয়েছে। এই চার মূলনীতি হচ্ছে- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর শাসনতন্ত্র বা সংবিধান পাস করার দিনে প্রদত্ত ভাষণে এই চারনীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন : “ জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ- সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। ...ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সাথে একটা জিনিষ রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না। জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না।...

জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে, এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আমি বাঙালি, আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ।” রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে অসাম্প্রদায়িকতাই গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপের সন্ধান দেয়, সেই পরম সত্যের সন্ধানটি বঙ্গবন্ধুই দিতে পেরেছিলেন এবং এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশের সংবিধানে। অসাম্প্রদায়িকতার একজন সত্যদ্রষ্টা রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের জন্য কাজ করেছেন।

সেদিন গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিপ্লবের পর ৯ মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র দেয়া, মানুষের মৌলিক অধিকার দেয়ার অর্থ হলো আমরা জনগণের উপর বিশ্বাস রাখি। ’ তিনি শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তার স্বপ্নের সোনার বাংলা। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার।

এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ধ্বংসস্ত ূপের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন সোনার বাংলা গড়ার। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু রাত-দিন পরিশ্রম করেছেন। তিনি পুঁজিবাদী শোষণের বাধা অতিক্রম করে জনসাধারণের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন করার লক্ষ্যে এদেশের জন্য কাঙিক্ষত সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন এদেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় ধর্ম কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করবে না, ধর্ম হবে জনগণের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কাজ করেছেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য । সম্পদেও সামাজিকীকরণের লক্ষ্যে জাতিকে উপদেন দেন প্রথম পঞ্চমবাষিকী পরিকল্পনা। নিরন্তর চেষ্টা করেছেন দুঃখী মানুষের মুখের হাসি ফোটানোর জন্য। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ঘিরে রয়েছে মেহনতি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার চিত্রপট। কৃষক-শ্রমিকদের কাজ-কর্মকে খুবই শ্রদ্ধার সাথে দেখতেন।

গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেন : “করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুররা করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ।” বিভিন্ন স্থানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণে প্রমাণ মেলে তিনি এদেশের কৃষকÑশ্রমিকসহ মেহনতি মানুষকে, স্বদেশকে কতোটাই-না ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর এই দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ, কথা ও কাজের মধ্যে মিল, সত্যনিষ্ঠা, আপোসহীন মনোভাব তাঁকে করে তুলেছিল অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে এবং বিশ্বরাজনীতিতে একজন প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অর্জন করেছিলেন সম্মানজনক অবস্থান। তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিটি মুহ ূর্ত নিবেদন করে গেছেন আমাদের জন্য। স্বদেশকে তাঁর জীবনের চেয়ে বেশী মূল্যবান মনে করতেন বলেই তিনি হতে পেরেছেন বাঙালির প্রাণপুরুণ ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ভালোবেসেছিলেন। তাই তো তিনি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছেন । বন্দুকের নল ধরেও ক্ষমতারোহণ করেননি। তিনি গড়েছিলেন এক রক্তাক্ত আদর্শের পতাকা। ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহে ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে প্রথমবারের মতো অঙ্কিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাই ইতিহাসের পাতায় তার নাম ভাস্বর থাকবে চিরকাল।

বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় অবদান স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে নিয়ে ভেবেছেন। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে ও কর্মে কৈশোর থেকেই স্থান করে নিয়েছিল, এ কারণেই তাঁকে প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি (১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি) এদেশের মানুষের ভালবাসার প্রতিদান হিসেবে সার্থক হয়ে উঠেছে।

যখন বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলদেশের শাসন ভার গ্রহণ করেন তখন দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ লোক কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। তাদের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু একটি পুর্ণাঙ্গ কৃষি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন “বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না” কৃষিকাজে বাংলার কৃষকদের ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদান কম নয়। তিনি জানতেন কৃষকরা যদি সঠিকভাবে উৎপাদন করে তাহলে দেশের খাদ্যসমস্যা দ্রুত নিরসন হবে যা জাতীয় আয়কে আরও প্রশস্ত হবে। কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ প্রদানের বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার দানের কথা ঘোষণা করেন।

অন্যদিকে কৃষি গবেষণা ছাড়া যে কৃষি উন্নতি সম্ভব নয় তাও বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ১৯৭৩ সালে গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সবসময় বলতেন কৃষকদের ফসলের ন্যাষ্যমূল্য দিতে হবে। তিনি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) চালু করেন, কসকর দোকান খোলেন, সংশোধিত রেশন কর্মসূচি চালু করেন। বঙ্গবন্ধু গরিবদের ন্যাষ্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিতে চেয়েছেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট ব্রিটিশ তেল কোম্পানী শেল অয়েল - এর নিকট হতে দেশের ৫টি গ্যাসক্ষেত্র যথা - তিতাস , হবিগঞ্জ , বাখরাবাদ, রশিদপুর এবং কৈলাসটিলা ক্রয় কেে রাষ্ট্রীয় মালিকানাভুক্ত করেন। তাঁর এ দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক দৃঢ় অভিযাত্রার সূচনা করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন সাধনাই ছিল বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি। এজন্য জেল, জুলুম, হুলিয়া, ফাঁসির কাষ্ঠ পেরিয়ে প্রাণও দিলেন সপরিবারেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে । বাঙালি জাতির ট্র্যাজেডির মহানায়কও তিনি। বীরের জাতির পিতা বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছেন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এমন আরেকজন মহান নেতার আর্বিভাব ঘটেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের বঙ্গবন্ধু যখন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির নবতর কর্মসূচী সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সেসময় পরাজিত ও ঘৃন্য অপশক্তি তাঁর ওপর চরম আঘাত হানে, তাঁকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে এখন থেকে স্থানাচ্যুত করার অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে ১৯৭৫ সালের রাজীনতিক পরিবর্তনের পর। এজন্য নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়েছিল। সময়ের ব্যাপ্তিতে বঙ্গবন্ধুর ঔজ্জ্বল্য স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। পাশাপাশি

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে তার নাম মুছে ফেলার যে চেষ্টা চালিয়েছিল তা কেবল অপচেষ্টায়ই পর্যবসিত হয়েছে। পরাজিত ও ঘৃন্য অপশক্তি স্বাধীন দেশের ইতিহাস, দেশের অগ্রযাত্রা ও বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় কীর্তিকে ব্যাহত করতে চেয়েছিল পরিকল্পিত ভাবে। যতদিন যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর মহিমান্বিত কীর্তি ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এবং উঠবে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের জন্য, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য কাজ করছেন। আর সোনার বাংলার মানুষের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণেরবেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩১৪ ডলার। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ জাতি গড়ার পথে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা তাকে হত্যা করে তার নাম মুছে ফেলার যে চেষ্টা চালিয়েছিল তা কেবল অপচেষ্টায়ই পর্যবসিত হয়েছে। কোটি কোটি বাঙালির মনে তিনি চিরভাস্বর, বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ, জাতির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির জীবনের অংশ তিনি। বাংলাদেশ ছিল তাঁর স্বপ্নের দেশ, ইচ্ছা পূরণের দেশ। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্ন ও ইচ্ছা পরিপূর্ণভাবে পূরণ করে যেতে পারেন নি। দেখে যেতে পারেননি দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি । বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে চায় আজকের প্রজন্ম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে নতুন প্রজন্ম অঙ্গীকারবদ্ধ হতে চায় যা দিয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করা যায়। স্বদেশি উন্নয়নধারায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধুর গণহিতৈষী চেতনাকে আজকের প্রজন্ম ধারণ করে এগিয়ে নিয়ে যেতে যায় বহুদুর। আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কামনা বঙ্গবন্ধুর চেতনা চিরকাল যেন জাগরূক থাকে।

তাই আজকের প্রজন্ম ও ভবিয্যত প্রজন্মের কাছে তাঁকে সঠিকভাবে তুলে ধরা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও আত্মত্যাগের ইতিহাস থেকে আজকের প্রজন্ম নিজেকে দীক্ষিত করতে পারবে এবং দেশের উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারবে। যেমনটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষা, মাতৃভূমি এবং জাতির স্বাধীনতার জন্য। নিহত হওয়ার পূর্বক্ষণটিতেও তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা অন্তর দিয়ে ভেবেছেন।
বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিরল ভূমিকা আমদের অনিঃশেষ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে চিরকাল। বঙ্গবন্ধুর পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং আর্কাইভস ৭১- এর প্রতিষ্ঠাতা

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test