E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

আইনের ক্ষমতা নাকি ক্ষমতার আইন?

২০১৫ আগস্ট ২৯ ১১:৪৯:০৬
আইনের ক্ষমতা নাকি ক্ষমতার আইন?

শফিকুল ইসলাম খোকন : অবশেষে মনে তৃপ্তি পেলাম। স্বস্তিও পেলাম বটে; প্রবীরদাকে কারাগারে পাঠানো হলো। শুধু কারাগারেই নয় তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে শেষ পর্যন্ত জামিন। প্রথমে স্বস্তিটা থাকলেও জামিন হওয়ার পর অস্বস্তি হয়ে গেল। এ তৃপ্তি বা অস্বস্তি আমার নয়, এটি যারা চেয়েছেন প্রবীর দাদার এ অবস্থা হোক তাদের। অনেক কষ্টেই এ লেখাটি লিখতে হলো। একজন সিনিয়র সহকর্মীর এ অবস্থা হলে কষ্ট হবেই।

সাংবাদিকতার কল্যাণে প্রবীর দাদার সাথে দু'বার দেখা বা কথা বলার সুযোগ হয়েছিল ঢাকাতে। তাতে আমার মনে হয়েছিল প্রবীর দাদা একজন সৎ, নির্ভিক সাংবাদিক ও একজন স্বাধীনতা চেতনাকে লালন করার কারিগর। তখন আমি জানতাম না যে প্রবীর দাদা একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। দেশের জন্য এতো বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বাবার আদর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। এ লেখাটি যখন শুরু করেছি তখন প্রবীর দা মুক্তি পেয়েছেন। শঙ্কায় ছিলাম জামিন পাবেন কি পাবেন না। ঐ শরীরে কারাগারে কিভাবে দিন কাটাবেন। আবার জামিন পেলে কতোটুকু নিরাপদে থাকবে ইত্যাদি। ঠিক, আমার ভাবনাটা একেবারেই মিথ্যা হয়ে যায়নি। প্রবীর দা জামিন পেয়ে ঢাকায় গিয়ে গণমাধ্যমের সামনে তার নিরাপত্তাহীনতার ব্যপারটি আবারও বলেছেন। জামিন পেয়ে তিনি তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন না বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

প্রবীর সিকদার শহীদ পরিবারের সন্তান। এই পরিবারের ১৪ জন একাত্তরে দেশমাতৃকার জন্য জীবন দিয়েছেন। তার পিতার মরদেহও পাওয়া যায়নি। তার পিতার রক্তমাংস মিশে গেছে এই বাংলায়। পূর্বসূরীদের ধারাবাহিকতায় প্রবীর সিকদারও বয়ে চলেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অক্লান্ত যোদ্ধা প্রবীর সিকদার। আমাদের মতো প্রবীর দাদা মফস্বলেও সাংবাদিকতা করেছেন। তার সাংবাদিকতার শুরু ফরিদপুরে, সেখানে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে কাজ করেন দৈনিক সমকাল ও দৈনিক কালেরকণ্ঠে। দৈনিক কালেরকণ্ঠ বের হবার আগে পান্থপথে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেঙ্রে আন্ডারগ্রাউন্ডের অফিসে তার সাথে কথা হয় আমার। তিনি নিজেই এখন উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ একটি অনলাইন ও বাংলা ৭১ নামে একটি দৈনিক সম্পাদনা করেন। তার পরিচালনায় ঐ দুটি গণমাধ্যমেও তার ফেসবুকে স্টাটাসও দেন সংবাদকর্মী নিয়োগ করা হবে। আবেদনকারীদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়বার আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। গোটা ক্যারিয়ারেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে লেখালেখি করে গেছেন। জনকণ্ঠে 'তুই রাজাকার' শিরোনামে ধারাবাহিকে লেখার অপরাধে হামলার শিকার হন। মরেই যেতেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চেষ্টায় উন্নত চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে গেছেন। তবে হারিয়েছেন একটি পা, কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন এক হাতের। এখন শরীরে অসংখ্য বোমার প্লিন্টার বয়ে বেড়ান। তীব্র ব্যথা নিয়ে চলতে হয় তাকে। কিন্তু যুদ্ধে একটুও ছাড় দেননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লিখেই যাচ্ছেন।

মুসা বিন শমসেরের একাত্তরের ভূমিকার কথা লিখে একবার মরতে বসেছিলেন। বিধাতার মহিমায় তিনি এ পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে পেয়েছেন। তারপরেও তার লেখা থেমে যায়নি। আবারও লিখেছেন। আবারও হুমকি এসেছে। থানায় গিয়েছিলেন নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করতে। পুলিশ জিডি নেয়নি। লেখালেখির কারণেই বারবার হুমকির মুখে পড়েন প্রবীর শিকদার। থানায় জিডি করতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারস্থ হন তিনি। গত ১০ আগস্ট ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে তিনি তার জীবন সংশয়ের কথা লিখেছিলেন। তিনি তার মৃত্যুর জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ, মুসা বিন শমসের এবং ফাঁসির দ- পাওয়া পলাতক আসামি আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার এবং তার অনুসারীদের দায়ী করেন। এতেই কাল হয়েছে। নিজের জীবন সংশয়ের কথা প্রকাশ করার অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন। তাহলে মনে প্রশ্ন আসে যদি কেউ জীবনের নিরাপত্তার জন্য থানায় জিডি করেন সেও কি এভাবে গ্রেফতার হবেন? আর যদি থানায় জিডি করতে গিয়ে এন্ট্রি না করতে পেরে জীবনের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কার কথা নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে গ্রেফতার হয়ে জেল এবং শেষে রিমান্ডে যেতে হয় এটি কতোটুকু আইনসঙ্গত?

হ্যাঁ আমরা বিশ্বাস বা স্বীকার করি আইনের শাসন। আমরা বলে থাকি আইন সবার ঊধর্ে্ব। আইন চেনেনা কোনো গোষ্ঠী বা কোন ব্যক্তি। আইনের চোখ অন্ধ। কিন্তু যখন কোনো নির্দোষ ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট মামলা নেই তাকে যখন গ্রেফতার করা হয় এবং তার হাতে যখন হাতকড়া পরানো হয় তখন কি বুঝবো, আইন কি অন্ধ? না কোন গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তির? না এটি যেমন আইনের পরিপন্থি তেমনি মানবাধিকার লঙ্ঘন। একজন সাংবাদিককে ১২ ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখারও ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিক প্রবীর সিকদার বলেছেন, 'ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ে ভালো ব্যবহার করা হলেও ফরিদপুর নেয়ার পর আমার ওপর মানসিক নির্যাতন চালায় পুলিশ। টানা বারো ঘণ্টা আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। চোখ বেঁধে নানান ভয়ভীতি দেখানো হয়। বলা হয় সারাজীবন কারাগারে রাখা হবে, আমার এক পা ভাঙ্গা আছে আরেকটিও ভেঙ্গে দেয়া হবে।' (সূত্র : আমাদের সময়.কম : ১৯/০৮/২০১৫)।

প্রবীর দাদা জামিন পেয়েছেন ভালো কথা, কিন্তু যে অপরাধে তাকে গ্রেফতার বা রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল সেটা আদৌ যুক্তি সঙ্গত? যদি যুক্তিসঙ্গত নাই হয় তাহলে যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের কি হবে? প্রবীর শিকদারের এ অবস্থা থেকে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আসলে দেশে আইনের শাসন নেই, সুশাসন আজ কফিনের দরজায় লেখা বা কথা যদি কারো বিপক্ষে চলে যায় সেতো ক্ষিপ্ত হবেই...। আজ নিজের নিরাপত্তা চেয়ে প্রবীর দাদা থানায় জিডি করতে গেলেন, কিন্তু নিলেন না পুলিশ। অথচ প্রবীর দাদা তার দুঃখ, কষ্ট এবং নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দেয়া হয়েছে। যেখানে ফেসবুকে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। আর প্রবীর দা নিজের জীবনের নিরাপত্তা চাওয়া এবং নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি ফেসবুকে উল্লেখ করে নিজেই গ্রেফতার হলেন। হায়রে সুশাসন..., হায়রে আইনের শাসন। প্রবীর দা জামিন পাওয়ার পর গণমাধ্যমের কল্যাণে এও জেনেছি যে, প্রবীর দার জামিনের জন্য নাকি তার স্ত্রী মন্ত্রীকে ফোন করেছেন? যদি এটিই সত্যি হয় তাহলে আমরা কি বুঝতে পারি? এটি কি আইনের ক্ষমতা নাকি ক্ষমতার আইন? এ প্রশ্ন জাতির কাছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test