E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ধর্মান্ধদের উন্মাদনায় ৭২এর সংবিধান আজ যেন পূর্ণিমার চাঁদের মত ঝলসানো রুটি

২০১৫ ডিসেম্বর ২২ ১২:৩২:১৩
ধর্মান্ধদের উন্মাদনায় ৭২এর সংবিধান আজ যেন পূর্ণিমার চাঁদের মত ঝলসানো রুটি

মাহবুব আরিফ

ময়ূর পুচ্ছ লাগালেই কাক যেমন ময়ূর হয়না, তদ্রূপ নামের পেছনে লীগ লাগালেই কোন দল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দল হতে পারেনা | এক্ষেত্রে আমরা অনেকেই ওলামা লীগকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দল হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারিনা আর ওলামা লীগকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোন অঙ্গসংগঠন হিসাবেও ধরে নেয়া যায় না |

ধর্মান্ধরা যেকোনো ভাবে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসাবে প্রমাণ করার জন্যে আজ বিভিন্নরূপে রাজনীতিতে আবির্ভাব হচ্ছে, তারই একটি প্রমাণ হচ্ছে এই ওয়ালাম লীগ | কিছুদিন যাবত এই ধর্মান্ধরা মিছিল সমাবেশ করে আওয়ামী লীগের আদর্শের নেতাকর্মীদের তথা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তদের আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের দাবি নিয়ে উঠে পরে লেগেছে |

বাংলাদেশের সংখ্যা লঘুদের উপর যেভাবে অত্যাচার নিপীড়ণ হচ্ছে তা দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে কিছুদিন পর হয়তো ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে “এদেশে একদিন হিন্দু ও উপজাতীয় বা আদিবাসীদের অবস্থান ছিল” |

একটি দেশের সংবিধানে সেই দেশে বা জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার আলোকেই তৈরি হওয়া উচিত আর সেই আলোকেই রচিত হয় ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধান | পাক ভারত উপদেশে বাঙালিরা হাজার বছর ধরে একটি অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করে আসার পরও ১৯৪৭ সালে ধর্মের উপর ভিত্তি করে পাক-ভারতকে বিভক্ত করা ছিল একটি বড় ধরনের ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আর যার খেসারত আমাদের দিতে হয়েছিল একাংশের বাঙ্গালীদের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা যা অসাম্প্রদায়িক বাঙ্গালীদের কৃষ্টি, ও সমাজ সংস্কৃতির সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক | ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার আলোকেই তৈরি হয়েছিল ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধান |

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে সভ্যতার আলোকে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান কতটা গণতান্ত্রিক ? আলোচনার দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখতে গেলে বলতে হয়, একটি জাতি বা দেশের সংবিধান তৈরি হয় সেই দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার আলোকেই, কাজেই আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ১৯৭২ সালের সংবিধানটি ছিল বাংলাদেশের জন্যে একটি সঠিক সংবিধান |



সরকার, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও মন্ত্রী পরিষদের অনেকেই বলে থাকেন বাংলাদেশে কোন জঙ্গি বা আইসিএস নেই, অথচ চট্টগ্রামের নৌবাহিনীর সুরক্ষিত এলাকায় যখন বোমা হামলা হয় তখন অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশের সামরিকবাহিনীও সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হামলা থেকে নিরাপদ নয় আর এর মূল কারণই ধর্মান্ধতা | ধর্মান্ধতার উপর ভিত্তি করেই ধর্মীয় জঙ্গিদের সৃষ্টি, আজ যদি আমরা ৭২এর সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সাজাতে পারতাম তবে আমাদের উপমহাদেশে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি মুক্ত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে গর্ব করতে পারতাম | আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এতটাই প্রখর ছিল যে তিনি অনেক আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সম্পূর্ণরূপেই বেমানান | ধর্ম নারী জাতিকে কতটুকু স্বাধীনতা দিয়েছে সেটা বিবেচনার দায়িত্ব পাঠকদের উপর ছেড়ে দিয়ে বলতে হয় ধর্ম থেকেই ধর্মান্ধতা সৃষ্টি হয় আর ধর্মীয় নীতিমালা দিয়ে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা বেমানান | যে ভুলটা আজ পাকিস্তান করেছে সেই ভুলের পথে বাংলাদেশকে হাটতে হলে ফিরে আসার পথ থাকবে না | পাকিস্তান রাষ্ট্র খুবই চতুরতার সাথে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক রেখেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার সাহস পাচ্ছে, আমরা যদি এখনও এই সহজ কথাটি উপলব্ধি করতে না পারি তাহলে ধর্মান্ধ অপশক্তি আজ হয়তো হিন্দুদের দেশ থকে বিতাড়িত হতে বাধ্য করছে, হিন্দুদের হয়তো পাশের দেশে ভারতে আশ্রয় পাবার সুযোগ আছে কিন্তু যেদিন এই ধর্মান্ধদের উৎপাতে মুসলমানদের দেশ ছেড়ে পালাতে হবে তখন মুসলমানদের যাওয়ার কোনই জায়গা থাকবে না, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কোনই বাঙালিই আজ বাংলাদেশে নিরাপদ নয় | কাজেই আমাদের এখনি বুঝতে হবে ধর্মান্ধদের রোধ করতে আমাদের ৭২এর সংবিধানে ফিরে আসার কোনই বিকল্প নাই | বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীর বুকে দাড় করাতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রমকে অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো আর তার দলকে একা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারেন না, দলের সহকর্মীদের উপর নির্ভর করেই প্রধানমন্ত্রীকে চলতে হয়, তাই দলের মাঝে স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল কর্মী থাকা প্রয়োজন |

প্রথম আলোতে প্রকাশিত গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির একটি গবেষণায় একটি দুঃখজনক তথ্য প্রকাশিত হয়, যেটাতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার প্রমাণ উল্লেখ্য করা হয়, তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে যে দুর্নীতির পরিমাণ বর্তমান সরকারের আমলে বিগত সরকারগুলোর আমলের চাইতে কোনও অংশেই কম নয় | হলপ করে কেউই বলতে পারবেনা যে বাংলাদেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে বর্তমান সরকার সফলতা অর্জন করেছে | জয় বাংলা শ্লোগানে স্লোগানে গলা ফাটিয়ে ফেলা যায় বটে কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করতে চাই কঠোর দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা | এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্থমন্ত্রী কি পদক্ষেপ নেবেন সেটাই এখন দেখাব বিষয়, চোর পালিয়ে যাবার পর বুদ্ধি বাড়লে দেশের কোনই উপকার হবে না, সময় থাকতেই এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, রাজস্ব আদায়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারলে ভবিষ্যতে টাকা পাচারের পথকে রোধ করা আরো দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে |

নিশ্চিত ভাবে এটি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে, বাস্তবতার সাথে মিল রেখেই রাজনীতির পটভূমি তৈরি করতে হয় | বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চার নীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে আমাদের সংবিধানে যে বিষয়গুলো তথা আইনগুলো মূল চার নীতির সাথে সাংঘর্ষিক যে আইনগুলোকে বিভিন্ন সময়ে কাটাছেড়ার মাধ্যমে পরিবর্তিত করে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়, ১৫তম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ও সংবিধান থেকে 'আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ বিশ্বাস এবং আস্থা' ও ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির অনুমতি প্রদান করা হয়, আদিবাসীদের স্বীকৃতি অস্বীকার করে, উপজাতি ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হইবে বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবে বলিয়া উল্লেখ্য করা হয় | ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল | সেই ধারাকে পরিবর্তন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে পুন-প্রতিষ্ঠিত করে আজ জামাত শিবিরকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলে আসার সুযোগ করে দেয়া হয়, জামাত শিবির সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সর্বাত্মক সহায়তা গ্রহণ করে, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে পাকিস্তান তাদের ক্ষতকে খুব সহজেই ভুলে যাবে না, ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে রাখার উৎকৃষ্ট মাধ্যম এই জামাত শিবির, কাজেই পাকিস্তান সেই সুযোগকে কোনো ভাবেই হাতছাড়া করছে না, জামাত শিবিরকে ব্যবহার করেই সুযোগ বুঝে আমাদের দেশকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজাকারদের বিচার বানচাল করতে ধর্মকে ব্যবহার করার অপবাদ দিয়ে সারা বিশ্বে অপপ্রচার চালাবার সুযোগ পায় | যে সরকারের বা দলের সাহায্যে রাজাকাররা বাংলাদেশের মাটিতে মন্ত্রিত্ব লাভ করে আজ সেই দলের প্রধান বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়ে প্রহসনের রাজনীতি করার সুযোগ গ্রহণ করছে | রাজনৈতিক ভাবে এই অপশক্তিকে প্রতিহত করতে আমাদের এ সমস্যার মূলে আসতে হবে, বাংলাদেশ থকে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতিকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ না করে জামাত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার মানেই জামাত শিবির ও তার অনুচরদের অন্য নাম রাজনীতি করার সুযোগ কে দেয়া | লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ইতিমধ্যে জামাত শিবিরের একটি বিশাল অংশের অনুচররা স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলগুলোর মধ্যে তাদের জায়গা করে নিচ্ছে | দুঃখজনক হলেও সত্যি যে স্বাধীনতার সপক্ষের দলের সদস্যরা অনেকেই এইসব অনুচরদের রজনীগন্ধা ফুলে দিয়ে দলের মাঝে বরণ করে নিচ্ছেন, এই সব দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ব্যক্তি-বর্গদের ঠেকাতে না পারলে একজন অক্লান্ত পরিশ্রমকারী প্রধানমন্ত্রীর সকল প্রচেষ্টাই বিফলে যাবে |

সাম্প্রদায়িকতার এই কালো থাবা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে এখনি সুষ্ঠ ও সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বাংলাদেশের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থেকেই যায় |

লেখক :সুইডেন প্রবাসী ।

(ওএস/এস/ডিসেম্বর২২,২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test