E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিশুকে আমরা কিছু দিতে পারছি কি ?

২০১৫ ডিসেম্বর ২৩ ১২:৩২:২৫
শিশুকে আমরা কিছু দিতে পারছি কি ?

মাহবুব আরিফ

ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে একটি দেশকে উদ্ধার করতে হলে, একটি শিশুকে প্রকৃত মানুষ হিসাবে তৈরি করতে হলে, যোগ্য নাগরিক হিসাবে দেশে প্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে আমাদের কি কিছুই করণীয় নাই ?  সামান্য একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো প্রতিটি অভিভাবক তার সন্তানদের প্রকৃত মানুষ হিসাবে তৈরি করতে কি পরিমান অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন কিন্তু হায় কতজন অভিভাবক জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই স্বপ্নকে সার্থক করতে পেরেছেন ?

প্রশ্ন আসতে পারে এ ক্ষেত্রে কার ভূমিকা কতটুকু, সরকারের করণীয় কি ? নাগরিক দায়িত্ব কতটুকু ? ধর্ম এ বিষয়ে কি বলছে ? এত সব চিন্তা করতে গেলে সত্যি আমাদের সবারই যখনই পাগল হয়ে যাবার উপক্রম হয় ঠিক তখনই আমাদের সেই চিন্তার শূন্যস্থান পূরণ করতে খুবই নীরবে ধর্ম তার জায়গা করে নেয় | আসলেই কি ধর্ম এই সব জটিল সমস্যার সমাধান দিতে পারে ? ধর্ম কি অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা এনে দিতে পারে ? সন্তান মানুষ করতে গেলে যে অক্লান্ত পরিশ্রম, শিক্ষা, আর জ্ঞানের প্রয়োজন হয় বাস্তবতার দৃষ্টিতে ধর্ম কি তার সমাধান দিতে পারে ? তার একমাত্র সমাধান হচ্ছে নাগরিক ও সমাজ ব্যবস্থার যৌথ সমন্বয়ে এটি সুন্দর ও সঠিক পথকে বেছে নেয়া আর এক্ষেত্রে আমাদের ও সরকারের যৌথ পরিকল্পনা নিয়ে একত্রে এগিয়ে আসতে হবে | একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই সুন্দর সমাজ আর সুস্থ ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ |

আমরা কেউই চাইনা আমাদের সন্তানরা কখনোই মিথ্যা বলবে, মিথ্যাকে কে বিশ্বাস করবে, আমার চাই আমাদের সন্তানেরা সুন্দর চিন্তা করবে, আত্মসম্মানবোধ ও মানবতা বোধ থাকেবে | আমাদের দেশের শিক্ষা নীতিমালায় ধর্মীয় শিক্ষা হচ্ছে একটি ধারা, কেউ কি কখনো প্রশ্ন করেছি সেই শিক্ষা ব্যবস্থা কি ভাবে চলছে ? কতটুকু বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও মানবতা সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত ? ধর্ম শিক্ষাকে কোন ভাবেই ছোট না করে এই শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে কওমী ও আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে অন্যান ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে একই ধারাতে নিয়ে এনে একে আধুনিকায়ন না করলে নানাবিধ সমস্যা থেকে জাতিকে উত্তরণের পথে এগিয়ে নেয়া যাবে না | বিগতদিনে আমরা মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্রদের ধর্মের নামে ধর্মীয় কুসংস্কার শিক্ষা দেবার অনেক প্রমান পেয়েছি, অনেক মাদ্রাসায় জঙ্গি মনোভাবে তৈরি হওয়া ছাত্র দেশের ভেতরে অনেক অপকর্মে লিপ্ত হতেও দেখেছি, মাদ্রাসার অন্ধকার শিক্ষা জগতে অনেক সামাজিক অপকর্মেরও সন্ধান পাওয়া গেছে, এ সব থেকে উত্তরণের উপায় শুধু একটাই, সেটা হচ্ছে এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও মানবতার শিক্ষার আলোকে আধুনিক করা প্রয়োজন | আর সেটা করতে গেলে ধর্মের কোনই অবমাননা হবে না বরং ধর্মকে আরো ভালো দিকগুলো শিশুদের মনে যুক্তির মাধ্যমে অনুধাবন করার সুযোগ পাবে | ধর্মকে মানুষের বিশ্বাসের জায়গায় রেখে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্তা থেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নিতে হবে, আমাদের বুঝতে ও বোঝাতে হবে মানুষের ধর্ম থাকতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকেনা আর রাষ্ট্রের সংবিধানে কোন ধর্মীয় অনুভূতি থাকার প্রয়োজন পরে না | হাজার বছর ধরে গঙ্গা ও ব্র্হম্মপুত্র অববাহিকায় যে অসাম্প্রদায়িক সমাজ বসবাস করেছে তাদের নাম বাঙ্গালী জাতি আর এই বাঙালি জাতিতে কখনোই ধর্মীয় সংঘাত থাকার কথা ছিল না | ১৯৪৭ সালে ধর্মের উপর একটি উপমহাদেশকে বিভক্তি করণ ছিল একটি রাজনৈতিক অপসিদ্ধান্ত, যার খেসারত আমরা আজও দিয়ে যাচ্ছি | অসাম্প্রদায়িক বাঙ্গালীদের ধর্মের ভয় দেখি সাম্রাজ্যবাদীরা বসে আনার চেষট করেও সফল হয়নি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশর স্বাধীনতাই তার প্রমান |

আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার জীবন থেকে একটি ঘটনা আপনাদের আজ বলে শোনাই, আমার বয়েস তখন বড়জোর ৮ কি ৯, প্রতিদিন ভোরে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণে আমাকে মসজিদে বড় হুজুরের কাছে পাঠানো হতো আর সেখানে আমাকে প্রায় প্রতিদিনই ধর্মীয় শিক্ষার ফাকে ফাকে দোজখের বীভৎস বর্ণনা শোনানো হতো আর আমি ঘরে এসে সারাটাদিন একটা আতঙ্কের মাঝেই দিন কাটাতাম, রাতের বেলা ঘুমাতে গেলেই মনে হতো আমার দুই কাঁধে কারা যেন বসে বসে আঁকিবুঁকি করছে, নানান চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারতাম না, চোখের সামনে সাপ আর আগুনের বীভৎস সব কল্পনা চিত্র ভেসে বেড়াতো, আমার ভেতরে দিন দিন একটা অপরাধ বোধ জায়গা করে নিলো, এখানে আমি আজ কার দোষ খুঁজে বেড়াবো ? এর জন্যে আমি কাকে দায়ী করবো ? আমার পিতা মাতাকে নাকি আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে | জ্ঞান বুদ্ধি হবার পর এই দুর্গতি থকে মুক্তি পেতে আমাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে | একটি পাঁচ বছরের শিশুকে হঠাৎ করেই বিশালাকৃতির কালী মূর্তির সামনে দাড়া করিয়ে দিলে সেই শিশুটির মানসিক অবস্থা কি হতে পারে একটু চিন্তা করে দেখুন, আমার অবস্থাও হয়েছিল ঠিক তাই |
মন দিয়ে একটু চিন্তা করে দেখুন তো মানুষ হত্যা, শিশু হত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক হত্যা, ব্লগার হত্যা, গুম করে হত্যা, দলীয় স্বার্থ সিদ্ধিতে নির্দেশনা দিয়ে বাসে, গাড়ীতে আগুন দিয়ে, পেট্রল বোমা মেরে শত শত মানুষ হত্যা সেই সাথে আত্মহত্যা | নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, শিক্ষক দ্বারা ছাত্র ছাত্রী ধর্ষণ, পশু ধর্ষণের মত জঘন্য রকমের মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড আজ বাংলাদেশে এক সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে, ধর্ম কি আমাদের এসব ব্যাধি থকে মুক্ত করতে পেরেছে ? যদিও প্রতিটি ধর্মেই মানবতার আবেদন পরিপূর্ণ কিন্তু আমরা সার্থক হয়েছি কতটুকু ? আমাদের সন্তানরা আজ কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, কি পরিমাণ মানবতার শিক্ষা পাচ্ছে ? শুধু নিজের সন্তানের কথা ভাবলেই হবে না, একটু ভেবে দেখুন তো বর্তমানে পৃথিবীতে কত শিশু প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ? আসলে আমাদের যেটা প্রয়োজন সেটা অনেকেই অন্তর থকে অনুধাবন করলেও বাস্তবে সেই কথাটি জোর গলায় বলতে সাহস পাই না, কথাটা হচ্ছে আমাদের সন্তানদের জন্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবতা নামে একটি নতুন বিষয় সংযুক্ত করা, আমার তা পারবো কি? আমাদের উপমহাদেশে ধর্মীয় উন্মাদনার অন্তরালে আমার আজ ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছি, এত কিছু ভাববার সময় কোথায় | রাজনীতির মাঠে ধর্ম একটি প্রধান ট্রাম্প কার্ড, আর এটার উপর নির্ভর করেই পৃথিবীতে চলছে অসুস্থ রাজনীতি | অসুস্থ রাজনীতি অসুস্থ সমাজ তৈরি করে সেই অসুস্থ সমাজে মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধ হ্রাস পেতে থাকে আমাদের মনের অজান্তেই দিনে দিনে একটি জাতী তার মানবিক চেতনা বোধ কে হারিয়ে ফেলে, তখন মানুষই মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলাটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে ধরে নেয়, সামাজিক অবক্ষয় থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হলে, একটু সুন্দর সমাজ তৈরি করতে এখনি পদক্ষেপ না নিলে অনেক দেরি হয়ে যাবে |

লেখক :সুইডেন প্রবাসী

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test