E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

৭১-এর নিয়তি বালাদের নিয়তি ভিক্ষা !

২০১৬ জানুয়ারি ১৮ ১৩:৩৩:০৮
৭১-এর নিয়তি বালাদের নিয়তি ভিক্ষা !

সুব্রত ঘোষ

সকাল সাড়ে ৬ টা। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সবে মাত্র সূর্য পূর্ব আকাশে উঁকি মারলেও গাছের ডাল-পালা ভেদ করে তখনও পুরোপুরি মাটিতে আলো ছড়াতে পারেনি। ঠিক সে সময় দেখা গেল একদল মহিলা সাদা কাপড় পরে গ্রামের মেঠো পথ ধরে লাইন করে হেঁটে যাচ্ছে। কৌতুহল বশতঃ তাঁদের কাছে প্রশ্ন করে  জানা গেল তারা সবাই ভিক্ষা করার জন্য বের হয়েছেন। তবে রাতের বেলা এক সাথে এতগুলো মহিলা সাদা কাপড় পরে হেঁটে যাবার দৃশ্য দেখলে যে কারো ভড়কে যাবার কথা।

সাদা কাপড় পরিহিত মহিলাদের মধ্যে একজনের নাম নিয়তি বালা দাস।বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই। এই বয়সে ভিক্ষা করার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় তার স্বামী বিভারণ চন্দ্র প্রামাণিককে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে পাক-হানাদার বাহিনী। সে সময়ের দুঃসহ ঘটনার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন নিয়তি বালা। ভিক্ষা করতে যাবার কথা ভুলে গিয়ে মাটিতে বসে পড়েন। তার সাথে বসে পড়েন পঞ্চমী দাস (৭২), সুধাংশু দাস (৭০), সুশীলা বালা (৭১), নিয়তি বালা (৬৮), সুন্দরী দাস (৭০), তরু বালা (৭২), অনন্ত বালা (৬৯), প্রমীলা দেবী (৬৬) ও যমুনা বালা কর্মকার সহ প্রায় ২০ জন হিন্দু ধর্মালম্বী মহিলা।

নিয়তি বালা দাস ১৯৭১ সালের কথা বলতে না পারলেও বাংলা সালের হিসেবে ১৩৭৮ সালের সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর সে দিনের সে নির্মম হত্যাযজ্ঞের বর্ণণা দিয়ে বলেন, দিনটি ছিল রবিবার। দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে দু’টি গাড়িতে পাক বাহিনী ঢুকে পড়ে গ্রামে। পাক বাহিনীর গাড়িতে সেদিন ছিল বখতিয়ারপুর গ্রামের পিচ কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ সরকার। সেদিন আজিজ সরকারের নির্দেশে যুগীশো পালশা গ্রামে হিন্দু পল্লীর মানুষকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় একটি বাঁশ ঝাড়ের কাছে। সেদিন ৯ বছর বয়সী ছেলেকে রেখে যতীন্দ্র নাথ কিছুতেই যেতে চাচ্ছিলেন না। ছেলেটাও যতীনের লুঙ্গি টেনে ধরছিলেন পেছন থেকে। এ দৃশ্য দেখে পাক বাহিণীর কয়েকজন সদস্য রেগে গিয়ে ৯ বছর বয়সী যতীনের ছেলেকে গুলি করে যতীনকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যান। দুপুর সাড়ে ১২ টা থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত পুরো হিন্দু পল্লী থেকে ৪২ জন হিন্দু ধর্মালম্বীকে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন। তারপর সেই বাঁশ ঝাড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে মাটির দিকে মুখ করে শুইয়ে দিয়ে বুট আর বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে পাক বাহিনীর সদস্যরা। এরপর ব্রাস ফায়ার করে ৪২ জনকেই হত্যা করা হয়। হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে পাক বাহিনী চলে গেলেও বখতিয়ারপুর গ্রামের পিচ কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ সরকারের নেতৃত্বে সেদিন সমস্ত হিন্দু পল্লীতে আগুন ধরিয়ে লুটপাট চালানো হয়। সাথে কিছু চাল নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে হিন্দু পল্লীর সদস্যরা সেদিন রাতের আঁধারে ভারত চলে যায়। এরপর দেশ স্বাধীন হলে আবার দেশে ফিরে এসে দেখেন বাড়ি ঘর সব খোলা মাঠ হয়ে গেছে। হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল যা ছিলো সব লুটপাট করা হয়েছে। ফসলী জমি গুলো দখল হয়ে গেছে। তবু স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টায় ভিক্ষা করতে হচ্ছে আজও।

পঞ্চমী দাস অভিযোগ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের স্বামীদের এভাবে হত্যা করা হলেও মেলেনি শহীদের স্বীকৃতি। এমনকি যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন ধারনের জন্য দেয়া হয়নি সরকারি কোন অনুদান। তাই বাধ্য হয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে ও পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত তুলে দিতেই ভিক্ষা করছি। তবে এ শেষ বয়সে এসে আর ভিক্ষাবৃত্তি করতে চান না নিয়তি বালা কিংবা পঞ্চমী দাসরা। তাদের দাবি বর্তমান সরকার তাদের জন্য না হলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।

রাজশাহীর দুর্গাপুরের যুগীশো পলাশা গ্রামে একাত্তরে স্বামী হারা ৪৩ জন শহীদ জায়া বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টায় ভিক্ষা করে যাচ্ছেন আজও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের স্বামীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলেও মেলেনি শহীদের স্বীকৃতি। এমনকি যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন ধারনের জন্য দেয়া হয়নি সরকারি বা বেসরকারি কোন অনুদান। তাই বাধ্য হয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে ও পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত তুলে দিতেই প্রতিদিন ভিক্ষা করছেন তাঁরা। এ লজ্জা আমাদের!

নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে এই বীর মাতাদের পাশে দাাঁড়াতে তাঁদের হাতে ১ টি করে শাড়ী, ১ টি করে কম্বল, ১ মন করে চাউল, ২০ কেজি করে আলু ও ১০ কেজি করে ডাল সাথে সম্ভব হলে কিছু নগদ টাকা তাঁদের হাতে তুলে দিতে চাই আমরা। সাথে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং প্রয়োজন মতো ঔষধও দিতে চাই।

আপনার যে কোন প্রকার সাহায্য আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসকে অনুপ্রাণিত করবে।
আসুন আর একটি বার “জয় বাংলা” বলে গর্জে উঠি মা-মাটি-দেশ এর কল্যাণে।



লেখক : চিকিৎসক।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test