E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সবুজ মাঠ পেরিয়ে অথবা একটি শীষ আংটির গল্প

২০১৬ মে ১৯ ১৬:২৬:২৪
সবুজ মাঠ পেরিয়ে অথবা একটি শীষ আংটির গল্প

সিলভিয়া পারভিন লেনি : একদিন ফ্ল্যাটের এক ভাবী দাওয়াত দিল। ইসলামী বৈঠক হবে। সেদিন ছিল শুক্রবার। তাই ভাবলাম যাই। একটু ধর্মীয় কথা শোনা যাবে। তার আগে বলে নেই যে আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় গোঁড়া না, তবে নিজের বোধ, বুদ্ধি ও যুক্তিতে যতটুকু মানা যায় ততটুকু পালন করি।

সে যাই হোক, আশেপাশের অনেক ভাবী, বুয়া, খালাম্মা যারা অনেক বেশি ধর্মপ্রাণ, তারা অনেকেই আসলেন ধর্মীয় কথা শোনার জন্য। একজন খুব সাধারণ মানের ডাক্তার ভদ্রমহিলা আসলেন। এত সাধারণ তার কথা, আধুনিক এবং যুক্তিসঙ্গত। তার কথায় কোন গোঁড়ামী ছিলনা। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি ডাইনিং টেবিলের কাছে বসেছিলাম। নামায পড়া উচিত, গরীবকে দান করা এইসব সমাজসেবামূলক কাজের উদাহরণ দিলেন তিনি। সেইসাথে আমাদের নবী রাসূলদের উদাহরণ দিলেন। গল্প সবার মুখে শুনতে ভাল লাগেনা। ওই মহিলা এত সুন্দরভাবে বলছিলেন যে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি।

শুধু আমি না ওখানে যারা উপস্থিত ছিলেন সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। এরপর শুরু হলো মোনাজাত। মোনাজাতে “দেশ ও মানুষের মঙ্গল কামনা, পরিবার পরিজনের জন্য দোয়া... এরপর হঠাৎ করে শুরু হলো-

“এই পৃথিবীতে যেমন নবী ও রাসূল যেভাবে ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে অনেক অত্যাচার, নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে, তেমনি যুগে যুগে কালে কালে ধর্মপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে নানা রকম অন্যায় অত্যাচার হবে। এই যে আমাদের মহান নেতা গোলাম আযম, সাঈদীসহ সকল নেতাদের উপরে যে অত্যাচার করা হচ্ছে তা থেকে আমাদের নেতাদের মুক্তি দেন হে আল্লাহ। হে আল্লাহ আমাদের এই জালিম সরকারের হাত থেকে মুক্তি দেন।”

এই কথা শোনা মাত্রই আমি হাত নামিয়ে প্রতিবাদ করলাম। বললাম আপনারা তাহলে জামায়াত ইসলামের লোক? আর হাদিয়ার নামে যে ১০০/২০০/৩০০ টাকা নেন যে অমুক কে দান করবেন, এইসব টাকা যায় জামায়াত ফান্ডে? ঐখানে যারা ছিল তারা হতবুদ্ধির মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি চিৎকার চেঁচামেচি করে এবং বিরক্তি নিয়ে বের হয়ে চলে এসেছিলাম। সেই ভাবির সাথে আর কখনো কোন ধরনের সম্পর্ক রাখিনি।

কুখ্যাত রাজাকার ও আল বদর কমান্ডার নিজামীর ফাঁসির রায় ঘোষণা, ফাঁসি হওয়া পর্যন্ত এবং হওয়ার পর সমস্ত বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষের এতদিনের চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সবই সামাজিক, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ভেসে আসছে। ফেসবুকে মানুষের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখছিলাম সেই সাথে মনে ভেসে উঠছিল যেসব রাজাকারদের ফাঁসি হয়েছে তাদের দাম্ভিকতার ছবি। তাদের সন্তানদের ছবি। যার কারণে মনের অজান্তে একটা ভয়ও কাজ করছিল, যা এখন বর্তমান। সেই কারণটা পরে উল্লেখ করব।

কেন আওয়ামীলীগ সরকার এবং বঙ্গবন্ধুর কণ্যার কাছে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে স্বাধীনতাকামী মানুষ ঋণী হবে না? কিছু মানুষ দেখি আধুনিক, রুচিশীল অথচ সুশীল এবং সুবিধাভোগী, তারা আওয়ামীলীগের বদনাম করতে ছাড়ে না এবং আওয়ামীলীগ সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিতেও ছাড়ে না! একটা সংসার চালাতে যেমন সংসারের প্রধান কর্তাব্যক্তিকে অনেক কিছু করতে হয়, সংসারের সবাইকে খুশি করতে হিমশিম খেতে হয়। তেমনি শেখ হাসিনাকেও ১৬ কোটি মানুষ, তার দল এবং বিদেশের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতে হয়। এই চলার পথে কত বাধা-বিপত্তি এসেছে, কত হুমকি, জীবনের অনিশ্চয়তা, তারপরও একমাত্র তাঁর কারণেই, আমি আবার বলছি শুধু তাঁর কারণেই, এই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করা হয়েছে।

যারা কোন ইস্যু পান না, তাদেরকে বলি, “বলুন তো সরকার আঁতাত করছে? ফাঁসি দিবে না ইত্যাদি এত যে কথা বলছিলেন তার ভিত্তি কি ছিল? আছে কোন উত্তর আপনাদের কাছে?” এইযে “গণজাগরণ মঞ্চ” হলো তা কি এত সহজেই হয়েছে। এই সরকারের সাহায্যে এবং আওয়ামীলীগ এর অঙ্গসংগঠন ছাড়া কি সম্ভব হতো সব মানুষের দাবিকে, একটা দাবিতে রূপান্তর করাতে? কিন্তু হায় তার জন্য শেখ হাসিনাকে কয়জন ধন্যবাদ আমরা দিয়েছি? জিজ্ঞাসা করুন নিজেকে।

নিজামীর ফাঁসি হলো, আর হয়তো কয়েকজন বাকি, তারপর কি? আমার ক্ষুদ্র মতে, তারপর হয়তো আরও ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে। ৭১ এর ভূমিকার পর তাদের এতদিনের কর্মকাণ্ড, তাদের লিংক, পাকিস্তানের দুঃসাহস, তুরস্কের প্রত্যাহার কিসের আলামত বহন করে? ভাবছেন বিচার শেষ হলেই সবশেষ, দাবি আদায় হলো? আমার তো মনে হয় ঘটনা সবে শুরু হলো। কারণ তাদের আদর্শভিত্তিক দল, সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সাধারণের চাইতে অনেক বেশি সচেতন। তাদের ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন সেক্টরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কিন্তু পরিষ্কার। তার সাথে আছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র।

মোসাদ এবং বিভিন্ন ধর্মের লোকজনের উপর অত্যাচার, হত্যা, বহিঃবিশ্বের কমবেশি তৎপরতা, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে মিটিং, এইগুলো কিসের আলামত। তারা মরন কামড় দিবেই। তাদের প্রতিশোধ তারা নিবেই। নিজামীর ফাঁসির পর প্রশাসনে একটু ঢিলেমিভাব দেখা গেছে। যা অন্য কোন আসামির বেলায় যায়নি।

শিবির এর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এত ছবি, এত লোকজন এর সমাগম। বায়তুল মোকারমে গায়েবানা জানাজা, প্রায় সব জেলায় গায়েবানা জানাজা করার ভুয়া ফটোশপ করা ছবি আজ ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে গেছে। অথচ আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ এর প্রবক্তা হয়ে এই পেজগুলো বন্ধ করতে পারিনি। বাংলায় একটা কথা আছে “প্রচারেই প্রসার”।

তার প্রমাণ আমরা দেখেছি। সাঈদিকে চাঁদে দেখা যাবে বলে যে প্রচারণা হয়েছিল তা এদেশের অনেক সহজ সরল মানুষ বিশ্বাস করেছিল। এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষও ঐদিন রাতে একবার হলেও আকাশে তাকিয়েছিল। এর ফলস্বরূপ হয়েছিল ভয়াবহ জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন, হামলা। ঠিক এমনিভাবে নিজামীর ফাঁসির পর তার জানাজার ছবি। তাদের অপপ্রচারের ছবি, তাদের প্রোপাগাণ্ডা চারিদিকে ছড়িয়েছে। যা দিয়ে গ্রামের, মফস্বলের মানুষকে বোকা বানাতে সক্ষম এরা এবং ধর্মপ্রাণ মানুষ তা বিশ্বাসও করে। তাই নিজেরা সচেতন না হলে এখনকার এই ছদ্মবেশী ছোট হায়েনাগুলো যে এক সময় ভয়ঙ্কর হয়ে আঘাত দিবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নাই।

এই লেখার প্রথম ঘটনার মতো জামায়াত এর মহিলারা গ্রামের মহিলাদের ঘরে ঘরে ইসলামিক বৈঠক এর নামে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। গ্রামের সাধারণ মানুষদের ভুল বুঝাচ্ছে। একটু চোখ কান খোলা রাখলেই বুঝতে পারবেন আশা করি। তার উপর এলাকার এমপিদের চাকরি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যতে যে কত জামায়াত বিএনপি ঢুকছে তা মিডিয়াতেও এসেছে। এসবের প্রতিকার কে করবে? দলের মহিলা যে সংগঠনগুলো আছে প্রতিটা থানা, জেলা গ্রাম, ইউনিয়নে তাদের কাজ কি? তারাও তো অনেক কাজ করতে পারে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে। কিন্তু সব কিছুই এখন দিবস আর ফেসবুক নির্ভর।

এইদিকে আওয়ামীলীগের এক শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকে বিশ্বাস হয় না। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন যে, আওয়ামীলীগের সব নেতাকে কেনা যাবে, কিন্তু শেখ হাসিনাকে কেনা যাবে না। তার মানে কি? তিনি জানেন কে কেমন।

দলের নেতারা তৃণমূলকে পাত্তা না দিয়ে দলে গণহারে বিএনপি, জামায়াতকে দলে টানছে। এতে করে প্রত্যেক জায়গায় বিদ্রোহ, বিভেদের সৃষ্টি হচ্ছে। আওয়ামীলীগের কি এত দৈন্যতা এসেছে যে দলে অন্য দলের লোক ভিড়াতে হবে? এই কথাটাও শেখ হাসিনার। তারপরও নেত্রীর কথা অমান্য করে এইসব করা হচ্ছে। এর জবাব কে দিবে? দলের ক্ষতির দায়ভার কি শেখ হাসিনার একার? না অবশ্যই না। তাই সময় থাকতে এর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় সব অর্জন, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিসর্জন যাবে।

পরিশেষে “সবুজ মাঠ পেরিয়ে” লেখক- শেখ হাসিনা। তার লেখা বইয়ে তিনি একটি আংটির কথা উল্লেখ করেছেন। তার নাম “শীষ আংটি”। যার হাতে যায় তার হাতে শোভা পায়। আওয়ামীলীগ যেন সেই “শীষ আংটি” না হয়।

লেখক : পরিচালক, রেডিও ঢোল ৯৪.০ এফএম

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test