E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ছয়দফা এবং ম্যাগনাকার্টার সাদৃশ্য

২০১৬ জুন ০৭ ১৮:২৮:৪২
ছয়দফা এবং ম্যাগনাকার্টার সাদৃশ্য

শাহেদ খান : হরহামেশাই শুনে থাকি বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা হচ্ছে ছয়দফা। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না  কোথায়।

একটু লক্ষ করুন, আজ থেকে ৮০১ বছর আগে, ১২১৫ সালের লন্ডনে এক নদীর পারে একটি ঘটনা ঘটেছিলো, যা ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলসহ বিশ্বের ঘটনা প্রবাহকে পাল্টে দিয়েছিলো। রাজা নিজের খুশিমতো জোর করে নাগরিক সমাজের সম্পত্তি আত্মসাত্ বা করায়ত্ত করে নিতেন। এরই বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ একত্রিত হন। নদীর পারে রানীমেড নামক স্থানে জড়ো হয়ে সমবেত নাগরিক স্থির করেন যে, রাজার ক্ষমতার রাশ টেনে ধরতে হবে। এর ফল হচ্ছে ম্যাগনাকার্টা। এটি ৬৩টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত ৪ হাজার শব্দের এক সমৃদ্ধ দলিল। সত্যি বলতে, এই দলিলটি একটু পাঁচমিশালি। যেমন, টেমস নদীতে মাছ ধরার সব খাঁচা সরিয়ে নেয়া বা এককভাবে কোনো নারীর সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে কোন পুরুষকে গ্রেফতার বা আটক করার বিপক্ষে মত দিয়েছে এই চার্টার।

শতশত বছর ধরে ইংরেজ জাতি এবং বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ এই মূলনীতি অনুসরণ ও ব্যাখ্যা করেছে এবং স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বিল অব রাইট লেখা হয়েছে এর উপর ভিত্তি করে। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাতেও প্রতিফলিত হয়েছে এর ধারণাসমূহ। এমনকি আজকের দিনের রাজনৈতিক নেতারাও সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে রক্ষাকবচ হিসাবে উচ্চারণ করেন ম্যাগনা কার্টার কথা। সরকারের শাসনের রাশ টেনে ধরার ক্ষেত্রে একে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়। রাজতন্ত্র থেকে নাগরিক স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় এই দলিল হচ্ছে সূচনা পর্ব এবং এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র।

কিন্তু এই ম্যাগনাকার্টার ৭৫১ বছর পরেও বাঙালী জাতি তাদের স্বাধীনতার সাধ পায়নি। ঔ পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা একের পর এক অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়নে এবং নানা বৈষম্যের শিকার হয়েছে নিরীহ বাঙালীরা। তখন তাদের এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো দুরে থাক নিজেদের ন্যায্য দাবীর কথা বলার দুঃসাহস কেও দেখায় নি। তবে একজন ঠিকি ছিলেন যিনি শত বাধা ভয় ভীতি উপেক্ষা করে সেদিন হাজির হয়েছিলেন বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ নিয়ে।

সেই মহেন্দ্রক্ষনটি ছিল ১৯৬৬ সালে ৭ জুন তারিখে। আজ সেই দিন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস। এদিন বাঙালী জাতির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবিতে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ছয়দফা দাবি ছিল মুলত স্বাধিকারের দাবি, সেই স্বাধিকার আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে ১দফায় রূপান্তিরিত হয়েছিল।

ছয়দফার মাধ্যমে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন শোষন ও অথনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলেধরেছিলেন। সংগত কারণেই অতি অল্পসময়ে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ছয়দফার প্রতি জনসমর্থন বাড়তে থাকে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ত্বের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জনমর্থন বৃদ্ধিপেতে থাকে। আওয়ামীলীগের প্রতি মানুষের আস্থা ও জনসমর্থন বৃদ্ধিপায়।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা ও আওয়ামীলীগের প্রতি বাংলার মানুষের জনসমর্থন দেখে ষড়যন্ত্র শুরু করে । ১৯৬৮ সালের আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা( মামলার মুল নাম ছিল : ' রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং গং') মূলত ছয় দফারই ফসল। পূর্ব বাংলার মানুষ ষড়যন্ত্র মামলার রিরুদ্ধে তীব্র গন আন্দোলন সৃষ্টি করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর,তিনি আরও জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেন ।

বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম আন্দোলন ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যত সুস্পষ্ট নিজস্ব দিকনির্দশনা নিয়েই ছয়দফা দফা পেশ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাত্রে থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অতীত দিনের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল । বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে ঐতিহাসিক ৭ই জুন ছয়দফা দিবসের ইতিহাস তুলে ধরতে পারলে আগামীতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতীর অপচেষ্টা অনেকটা বন্ধ হয়ে আসবে । কারন ৬দফার ইতিহাস,বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিশেষ মাইল ফলক ।

একটু লক্ষ করুন ম্যাগনাকার্টা যেমন সে সময়ে নিপীড়িত উপেক্ষীত একটা জনগোষ্ঠীকে মুক্তির সাধ এনে দিয়েছিল তেমনি ছয়দফা এনেদিয়েছিলো বাঙালী জাতির মুক্তির সাধ, এনে দিয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র।

বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ত্বে বাংলাদেশে আজ সর্বক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাচ্ছে। সেই অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার লক্ষে, অতীতে যেভাবে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ত্বে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছয়দফাকে-১দফায় রূপান্তরিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল। ঠিক তেমনি ঐতিহাসিক ৭ জুন ছয়দফা দিবসের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এবং ঐক্যবদ্ধ থেকে দেশর প্রতি স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে।

এই হোক আজকের দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : ছাত্র, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

(ওএস/অ/জুন ০৭, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test