E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

সেই বিভাজন রেখা

২০১৬ আগস্ট ১৪ ১৯:২৫:৫৪
সেই বিভাজন রেখা

সঙ্গীতা ইমাম :


এই ভূখন্ড অবিবেচকের মতো ভাগ করার দিন আজ। ভাই, বন্ধু, আত্মারজন,পড়শি থেকে একটা বিভাজনের দাগ টেনে বিভক্ত করার দিন আজ। মসনদে বসার আশায় ব্যতিব্যস্ত কর্ণধাররা, একবার সরজমিনে দেখার প্রয়োজন বোধ না করেই, প্রকৃত অর্থে কানে ধরেই দূর করলেন আপদ।তাতে কার ভিটা দুই ভাগ হয়ে রান্নাঘর ভারতে চলে গেল কিংবা গোয়ালঘর পূর্ব পাকিস্তানে, খবরই রাখলেন না তারা।সেই স্বজন বিচ্ছেদের ও বাস্তু উচ্ছেদের বেদনা দুপাড়ের মানুষ আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন।

দেশ ভাগ হলো কার প্রয়োজনে বা লাভটা কার হলো? স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতা বেশি হয়ে যায়। মসনদের আসীন হবেন কিভাবে? তাই সিংহাসন যত বেশি হবে ততই নেতাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি হবে। তাই ভাষা সংস্কৃতির সাদৃশ্যের কথা না ভেবেই ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে দেয়া হলো প্রতিবেশী পরিজন আপনার জনদের। এদের বেদনা অশ্রু, কান্না পৌঁছায় না দিল্লি পর্যন্ত।

ভিটে মাটি আত্মীয় পরিজন ছেড়ে হিন্দুরা গেছেন ভারতবর্ষে। মুসলমানরা কেউ এসেছেন পাকিস্তানে। এমন ও আছে পরিবারের সবাই ভিটে ছাড়লেও বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বা নারী যেতে চান না ,কোন কোন ক্ষেত্রে থেকেই যান। তবে এ অঞ্চল থেকে ভারতে যাওয়াদের আর ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের এ অংশে আসা মানুষদের দুই পক্ষের মধ্যে একটা মৌলিক তফাৎ দেখি আমি। যেসব মুসলমানেরা ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন তারা পিতৃপুরুষের ভিটের পরিচয় দিতে কুন্ঠা বোধ করেন। এপারের কোন জায়গার নাম বলে ঢাকতে চেষ্টা করেন পূর্ব পরিচয়। বহুদিন ধরে এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করি। তাতে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কখনোই এসব শরণার্থীদের স্বজন বলে গ্রহণ কনেন না। ধর্মে তাদের মিল থাকুক। আজও ঘটি বলে নানা তাচ্ছিল্য করা হয়।

কোলকাতার গড়িয়া ও আশে পাশের অঞ্চলে আজও সকালের চায়ের দোকানে পাড়ার বড়দের কথায় বিক্রমপুর, বরিশাল ময়মনসিংহের ভাষার টান শোনা যায়। বাড়িতে প্রজন্মান্তরে পূর্ব পুরুষের ভাষা তারা সযত্নে লালন করেন। গড়িয়াহাটের অধিকাংশ ব্যবসায়ী আজও যদি শোনেন আপনি তার দেশি তবে মন উজাড় করা গল্প বেড়িয়ে আসে, অদেখা স্বদেশের। এক মাকে আমি জানি যিনি বৈধব্যের পরে দীর্ঘ ৩০/৩৫ বছর মাছ খাননি। ডাক্তারের পরামর্শে তাকে মাছ খাওয়ানো জরুরি হলে তিনি শর্ত দেন বাংলাদেশের মাছ হলে তিনি খেতে পারেন। শেষে তাই করা হয়।মাতৃভূমি সকল সংস্কার ও ধর্মেরও উপরে।

গত এপ্রিলে আমি আসামের শিলচর যাই তাদের ভাষা শহিদ দিবসে।সেখানে গিয়ে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবসাকে আমি নতুন রূপে চিনেছি। এ অঞ্চলের অধিকাংশই সিলেট থেকে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া মানুষ।যারা আজও নিজেদের সিলেটি পরিচয় দেন আর সিলেটি ভাষাতেই কথা বলেন। শিলচরে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া মানুষের তৃতীয় প্রজন্ম যে সারাজীবনে সিলেট চোখেও দেখেনি সেও সিলেটে পূর্ব পুরুষের ভিটার ঠিকানা গ্রাম মৌজা সহ বলতে পারে। অতি যত্নে সে লালন করে তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে।বাংলাদেশের কেউ গেলে তাকে ছুঁয়ে পবিত্র জন্মভূমির স্পর্শ নেন যেন। এক বন্ধুকে কারণ জানতে চাইলে বলেন, আমাদের বাড়িতে গুরুজনেরা বেড়াতে যাওয়া মানেই সিলেটের গল্প। তাই শুনে শুনে আর বড়দের আবেগকে ধারন করেই আমরা আজও সে ঐতিহ্য বহন করি।

দেশ ভাগ কতটা দূরত্ব বাড়াতে পেরেছে বাঙালিদের মধ্যে! কাশ্মিরীদের মধ্যে? আমি তো দেখি আজও কাশ্মীরিরা স্বাধীন কাশ্মীর প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে। আর আমরা সাহিত্যে শিল্পে সংস্কৃতিতে একই রয়েছি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বা সলিল চৌধুরির গানও আমাদের প্রাণের গান। উত্তম কুমার বা সুচিত্রা,সুপ্রিয়া আজও আমাদের নায়ক নায়িকা। সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটককে আজও আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতারা গুরু জানেন।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, মাইকেল, শামসুর রাহমান,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোন পাড়ে বাঁধা থাকেন না। তাছাড়া সামাজিক মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আদান প্রদানে আরো কাছাকাছি হচ্ছি,নতুন বন্ধু খুঁজে পাচ্ছি। আনন্দে আড্ডা চলছে। কিন্তু হৃদয়ের ঠিক কোলটি ঘেঁষে বয়ে চলেছে বেদনার ক্ষীনধারা।

হাতুড়ে ভূমিকর্তা রেড ক্লিফের আঁকাবাঁকা দাগ অন্তত বাঙালিকে বিভাজিত করতে পারেনি, এ কথা সগর্বে সজোরে বলতে পারি নিশ্চয়ই।

লেখক : শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test