E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নিক্সন চৌধুরী, আরেকজন ছক্কা ছয়ফুর !

২০১৬ সেপ্টেম্বর ৩০ ২১:০৫:২৫
নিক্সন চৌধুরী, আরেকজন ছক্কা ছয়ফুর !

হুমায়ুন মিয়া


'কেমন করে গল্প হয়'- এই নামে বিখ্যাত লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একটি বই আছে। লেখক তার লেখায় কেমন করে সমাজের অবহেলায় বেড়ে ওঠা সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলির এক একজন গল্প হয়ে ওঠেন তার বর্ণনা করেছেন ওই বইয়ে। এই বইয়ে মার্কোস এক জায়গায় বলেছেন, একটা ভোজ সভার জন্য একটা গরু নিয়ে আসতে হবে। গরুটাকে কিভাবে নিয়ে যাওয়া হবে? মার্কোস বলেছেন,সবচেয়ে ভালো হবে,যদি গরুটাকে একটা হেলিকপ্টারের সাথে ঝুলিয়ে আনা হয়। গরুটাকে হাটিয়ে আনলে তো গল্প হয় না। গরুটাকে হেলিকপ্টারে ঝুলিয়ে আনলে গল্প হয়।

১৯৮৪ সাল, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলের মাঝামাঝি সময়, দেশে প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। সিলেট সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জনাব বাবরুল হোসেন চৌধুরী বাবলা।জনাব বাবলা বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত, ধনাঢ্য ব্যক্তি। তার দাদা ছিলেন ওই এলাকার জাদরেল জমিদার।জনাব বাবলা রাসভারী মানুষ, মানুষের সাথে কম মেলামেশা করেন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে তিনি এড়িয়ে চলেন।মানুষকে মর্যাদা দিতে তিনি কুন্ঠাবোধ করেন। সমাজের এমনএকজন বিত্তশালী লোকের বিরুদ্ধে সিলেটে বহুল পরিচিত কেউ প্রার্থী হতে সাহসী হলেন না।

একজন ছক্কা ছয়ফুর; অত্যন্ত গরীব, সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। লেখাপড়া নাজানা অশিক্ষিত ছক্কা ছয়ফুরের একমাত্র পুজি ছিল ৬টি রিক্সা।এলাকার কিছু লোকের উৎসাহে ছক্কা ছয়ফুর জনাব বাবলার বিরূদ্ধে নির্বাচন করতে সাহসী হলেন।কিন্ত নির্বাচনে অর্থের অভাবে ছক্কা ছয়ফুরের পক্ষে কোন পোষ্টার পড়লো না,কর্মীরা মাঠে কাজ করলো না,কোন এজেন্ট পাওয়া গেলো না। কেবল মুখে মুখে মানুষ জেনে গেলো জমিদার বাবলার বিরূদ্ধে প্রার্থী ছক্কা ছয়ফুর, এতটুকুই।

নির্ধারিত সময় নির্বাচন হলো,মানুষ দলে দলে ভোট কেন্দ্র উপস্থিত হলো, মানুষের ধারণা ছিল বাবরুল হোসেন চৌধুরী বাবলাই জিতবেন। কিন্ত ফলাফল যখন প্রকাশ হলো, তখন দেখা গেলো ক্ষমতাবান, জমিদার সন্তান, ঢনাঢ্য,শিক্ষিত বাবরুল হোসেন বাবলা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, একজন ছক্কা ছয়ফুরের কাছে বিপুল ভোটে হেরে গেছেন।এমন করেই একজন ছক্কা ছয়ফুর সিলেটের ইতিহাসে গল্প হয়ে গেলেন।

ফরিদপুরের ৪টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ফরিদপুর-৪ (ভূতপূর্ব ফরিদপুর -৫) নির্বাচনী এলাকা আওয়ামী লীগের নিশ্চিত আসন হিসেবে বিবেচনা করা হতো।'৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এই এলাকায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে তারা দল ত্যাগ করেনি; বিএনপি, বা জাতীয় পার্টি, বা জাকের পার্টিতে যোগ দেয়নি।অথচ এখন যাদের হাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তাদের অনেকেই '৭৫ পরবর্তী সময়ে বিএনপি, জাতীয় পার্টির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো। এমন অবস্থায় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সৈয়দ হায়দার হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ডাঃকাজী আবু ইউসুফের কাছে হেরে যান।অতঃপর ডঃকাজী আবু ইউসুফ আওয়ামী লীগে যোগ দিলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীদের কাছ থেকে "কাজী" পরিবারে চলে যায়।

বিষয়টি কেবল তাই নয়, ২০০১ সালের মধ্যে এই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী প্রথম সারির প্রায় সকলে মারা গেলে কাজী পরিবারের কারো কারো মনে হয়তো এই ধারনা জন্মেত, ফরিদপুর- ৪ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন করার মত 'কাজী' পরিবার ছাড়া আর কেউ নেই। মানুষের প্রতি কারো কারো অবজ্ঞা, দম্ভ, অহমিকার বদলা নিতে এলাকার মানুষ নতুন গল্পের অপেক্ষায় রইলেন। অতঃপর মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামের ৩৯ বছর বয়সী একজন নিক্সন চৌধুরী ফরিদপুর-৪ নির্বাচনী এলাকায় এলেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মান্যবর কাজী জাফর উল্লাহ'র বিরূদ্ধে নির্বাচন করলেন,অবহেলায় অযত্নে থাকা সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর ভোট পেয়ে জয়ী হলেন এবং ছক্কা ছয়ফুরের মত 'একটি নুতন গল্প ' হয়ে গেলেন।

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা।

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test