E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চামড়া শিল্পে শীর্ষ নেতৃত্ব দিতে পারে বাংলাদেশ

২০১৬ নভেম্বর ১৬ ১২:৩৫:২৫
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চামড়া শিল্পে শীর্ষ নেতৃত্ব দিতে পারে বাংলাদেশ

মোস্তাফিজ আহমাদ :স্বাধীনতার পূর্ব এবং স্বাধীনতার অব্যবহিতপর শুরুতে বাংলাদেশের এককভাবে রফতানী পণ্য ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। আজকের বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান বাহন ছিল এটি। সে কারণে তখন বাংলাদেশের পরিচিত সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে।কিন্তু আজকের বাংলাদেশ বাইরে বিশ্বের অন্যতম কাঁচা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানীকারক দেশ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে।

কাঁচাচামড়ার পাশাপাশি চামড়াজাত পণ্য রফতানীতে জোর দেওয়া হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। এ খাতে সম্ভাবনাও বাড়ছে। আশা করা হচ্ছে বাংলাদেশের চামড়ার মান ভালো হওয়ায় চামড়াজাত পণ্য রফতানী করে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানীতে আয় হয়েছে ৩১ কোটি ৯০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, যা এই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ের রফতানী আয়ের তুলনায়ও ১৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে এ খাতে।

প্রক্রিয়াজাত চামড়ার চেয়ে চামড়াজাত পণ্যে রফতানী আয় তুলনামূলকভাবে বাড়ছেই। বিশেষ করে আমাদের দেশের জুতা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিখ্যাত সব ব্রান্ডের জুতা প্রস্তুতে সক্ষম। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরি চামড়াজাত পণ্য প্রধানত ফ্রান্স, পোলান্ড, নিউজিল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইতালি, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে রফতানী হচ্ছে। সস্তা শ্রম ও নিজস্ব চামড়ার কারণে দেশে তৈরি চামড়ার পণ্যও অল্প দিনেই বিদেশী ক্রেতাদের নজর কাড়ে।

বাংলাদেশী চামড়াপণ্যের মধ্যে ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান আছে জুতা পণ্য। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ব্র্যান্ডের জুতার শোরুমেও আছে বাংলাদেশের তৈরি জুতা। শুধু চামড়ারই নয়, রয়েছে সিনথেটিক জুতাও। দেশের কারখানাগুলোয় বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর জুতা তৈরি হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে রফতানী। রফতানীর শীর্ষ দশে আছে জুতা। বিশ্ব জুতাশিল্পে শিগগিরই নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানী খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আগামী দুই বছরের মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা রফতানীর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। চামড়া শিল্প শতভাগ দেশীয় কাঁচামালনির্ভর রফতানীমুখী শিল্পখাত। এ শিল্পের সঙ্গে ২২০টিরও বেশি ট্যানারি, সাড়ে ৩ হাজার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং ১১০ বৃহৎ শিল্প জড়িত। এসব কারখানায় বছরে ২৫ কোটি বর্গফুটেরও বেশি চামড়া উৎপাদিত হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পখাতে প্রায় ৭০ লাখ দক্ষ ও অদক্ষ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এ শিল্পে শতকরা ৯০ ভাগ মূল্য সংযোজনের সুযোগ রয়েছে।

বিশ্বের দরজায় বাংলাদেশ চামড়া শিল্পে সুনাম অর্জন করতে পারলেও এই শিল্প এখনো নানা সমস্যায় জর্জরিত। যার কারনে এই শিল্পের সম্ভাবনা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারছে না। বিভিন্ন সমস্যার কারণে রি-লোকেশন, অর্থসঙ্কট সবকিছু মিলে বৈশ্বিক-অর্থনৈতিক মন্দাসহ চামড়াশিল্পে একটা ধস নেমেছে। হ্যাজার্ডাস পরিবেশে চামড়া প্রস্তুত করা হচ্ছে। কাজেই কোনো ব্র্যান্ড বায়ার, বড় বায়ার তারা আমাদের এখানকার চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা কিনতে রাজি নয়, চামড়াও কিনতে রাজি না। এছাড়া প্রতিবছর দেশ থেকে চামড়া পাচার হয়ে যাওয়ার কারণে কাচামাল সঙ্কটে বিপর্যয়ের শিকার হতে হচ্ছে চামড়া শিল্পে।

এছাড়া নানামুখী ষড়যন্ত্রে চামড়া শিল্প বিপর্যস্ত। গত কুরবানী ঈদেও কুরবানী চামড়া সংগ্রহ করা নিয়ে বহুমুখী জটিলতা দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কমে গেছে বলে অপপ্রচার, গত বছরের চামড়া বিক্রির টাকা এখনো না পাওয়া, মাঠ পর্যায়ে বেশি দামে চামড়া কেনা, চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যাওয়া, ভারত থেকে নিম্নমানের লবণ আমদানি ইত্যাদি কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। চামড়ার আড়তদাররা ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ না পাওয়ায় তাদের চামড়া কিনতে ট্যানারি মালিকদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে।
অন্যদিকে চামড়ার দাম প্রতি বছর কমানো হচ্ছে।বারবারই দাম নির্ধারণের বিপক্ষে তাদের অবস্থান। তবে শেষ সময়ে এসে তাড়াহুড়ো করে তারা একটা দাম ধরে দেয়। প্রতিবছর কুরবানীর পশুর দাম বাড়লেও ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে বছরের পর বছর চামড়ার দাম কমিয়েই যাচ্ছে।

জানা যায়, ট্যানারির মালিকরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করায় প্রতি বছর চামড়া পাচার হয়ে যায়। এ সুযোগে সীমান্ত জেলাগুলোতে ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীরা বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে। একথা এখন বলতেই হচ্ছে, দেশের প্রধান রফতানীশিল্প গার্মেন্টস খাতের মতোই চামড়া খাতটিকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। চামড়া শিল্পকে বাহানায় ধ্বংস করে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তা না হলে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য স্থিতিশীল, সরকারি সহায়তাসহ সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূল থাকা সত্ত্বেও ট্যানারি মালিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানীকারকরা কেন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে চামড়ার মূল্য কমায়?
বলার অপেক্ষা রাখে না, অনতিবিলম্বে সরকারের উচিত- চামড়া শিল্পে এসব অরাজকতা দূর করা। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে চামড়াখাত থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা রফতানীর লক্ষ্য নিয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানীতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। চামড়ার ক্ষেত্রে রফতানীর লক্ষ্যমাত্রা ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি হতে পারে।
সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প ও চামড়াজাত পণ্যের মানোন্নয়নে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি, প্রয়োজনে এ খাতের রফতানীর উপর প্রণোদনা প্রদান এবং বিনাসুদে ব্যাংকগুলোর তরফে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মতো সুযোগ সুবিধাকে আরো প্রসারিত করতে হবে।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানী দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও বিগত অর্থবছরে নানা প্রতিকূলতার কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। তবে চীনের বাণিজ্যিক নীতিতে পরিবর্তন আসায় তারা বিশ্ব বাজারে জুতার মতো প্রয়োজনীয় খাত ছেড়ে দিচ্ছে। এখন সে দেশের ছেড়ে দেওয়া জুতার বাজারের পুরো অংশই দখল করতে পারেন। মূলত, চামড়াজাত পণ্যের দিকে দৃষ্টি দিলে তা বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি রফতানী পণ্য।






(এমএ/এস/নভেম্বর ১৬, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test