E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু সান্নিধ্যে ধন্য একজন পীযূষ কান্তির গল্প

২০১৬ ডিসেম্বর ০৩ ১৫:৫১:২৭
বঙ্গবন্ধু সান্নিধ্যে ধন্য একজন পীযূষ কান্তির গল্প

মোতাহার হোসেন, মণিরামপুর : যশোরের মণিরামপুর উপজেলার অজপাড়াগাঁ পাড়ালা গ্রামের যুবক পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসে হয়েছিলেন অতি  স্নেহভাজন ও অতি ঘনিষ্ঠ সহচর। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে আ’লীগের মনোনয়ন কিনে হয়েছিলেন এমপি। ৭৫’সালের পটপরিবর্তনের পর খন্দকার মোস্তাকের লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে নির্যাতন আর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘদিন ছিলেন আত্মগোপনে।

বঙ্গবন্ধু সরকারের এমপি হয়েও সততার সাথে জীবন-যাপন করেছেন তিনি। যশোর জজ কোর্টে এখনো আইন পেশায় চলে তার সংসার খরচ। ভাড়া বাসায় স্ত্রী মণিকা ভট্টাচার্য্যকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। দুর্নীতির এতটুকু কালিমা তাকে ছুঁতে পারেনি। জীবন চলার পথে কোন লোভ-লালসা তাকে টলাতে পারেনি তার আদর্শ থেকে। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে কখনো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হতে বিচ্যুত হননি কেন্দ্রীয় আ’লীগের নব-গঠিত কমিটির সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য। অবিচল থেকেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও তার হাতে গড়া সংগঠন আ’লীগের প্রতি।

তার সাথে একান্ত অলাপচারিতায় এ প্রতিবেদকের কাছে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আবেগে-আপ্লুত হয়ে বিভিন্ন কথা বলেছেন।

এক পর্যায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যলাভ এবং কেন্দ্রীয় আ’লীগের নীতি নির্ধারক সভাপতি মন্ডলীর সদস্য পদে আসীন হওয়ার অজানা নানা গল্প। ১৯৬৬ সালে বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ বঙ্গবন্ধুর দেয়া ছয় দফায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি আ’লীগে যোগদান করেন। পরে শ্বশুর বাড়ির সহযোগিতায় ও স্ত্রী মনিকা ভট্টাচার্য্যরে অনুপ্রেরণায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এম এ পড়তে। অর্থনীতিতে এম এ পাস করার পর মণিরামপুরের ডা. মহিউদ্দীন আহম্মেদ তাকে মণিরামপুর ডিগ্রি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব নিতে বলেন। তিনি ডিগ্রি কলেজের চাকুরিরত অবস্থায় থানা আ’লীগের সাংগঠনিক কাজ শুরু করেন। এরমধ্যে ৭০ সালের নির্বাচন চলে আসে। এ নির্বাচনে মণিরামপুর হাই স্কুল মাঠে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কন্ঠ ভালো থাকার কারণে ওই জনসভা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্যের ওপর। সন্ধ্যা ৬ টার সময় ওই মাঠে বঙ্গবন্ধুর আসার কথা থাকলেও তিনি আসেন রাত ১১ টার দিকে। বঙ্গবন্ধু আসলে রাত হওয়ার কারণে মাঠে লোকসমাগম কমে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আসার খবর পাওয়া মাত্রই চারিদিক থেকে মানুষের জনস্রোতে মুহূর্তের মধ্যে মাঠ ভরে যায়।

যথারীতি সভা পরিচালনা করেন পীযুষ কান্তি। এসময় তার ইনোসেন্ট মুখ আর দরাজ কন্ঠে মুগ্ধ হন মঞ্চে উপবিষ্ট বাঙ্গালী জাতির পথ প্রদর্শক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সভা পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে বঙ্গবন্ধু কথা বলতে থাকেন পীযুষের সাথে। বঙ্গবন্ধু তাকে আপনি দিয়ে শুরু করেন। জিজ্ঞাসা করেন ‘আপনার বাড়ি কোথায়? এখান থেকে কতদূর আপনার বাড়ি। তারপর বঙ্গবন্ধু পীযুষকে বলেন, ‘তোমারে সবাই চিনে? প্রতি উত্তরে পীযুষ বলেন, এখান থেকে ৪ মাইল দূরে। নুরুল ইসলাম ও সুবোধ মিত্রের নির্বাচনের কারণে তাকে সবাই মোটামুটি চিনেন বলে বঙ্গবন্ধুকে জানান পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য। বঙ্গবন্ধু জনসভা শেষে চলে যাবার সময় পীযুষ কান্তিকে বলে যান-‘আমি যাচ্ছি, তোর সাথে আবার আমার দেখা হবে। এরই মাঝে দেড় বছর কেটে গেল। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ গ্রেফতার হলেন বঙ্গবন্ধু। দেশ স্বাধীনের পর ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এলেন তিনি। ৭৩’এ জাতীয় নির্বাচন শুরু হবে। পীযুষ কান্তি যশোর দড়াটানা আ’লীগ অফিসে মিটিং করছেন-এমন সময় লম্বা জামা-মাথায় টুপি পরিহিত অচেনা এক ব্যক্তি এসে পীযুষ কান্তিকে খুঁজছিলেন। পীযুষ অফিস থেকে বের হয়ে আসলে অচেনা ওই ব্যক্তিটি তাকে বলেন, শেখ সাহেব বলেছেন আপনাকে নমিনেশন দিবেন। আপনাকে মনোনয়নের জন্য আবেদন করতে বলেছেন-এই কথা বলে অচেনা ওই লোকটি চলে গেলেন। দ্বিধায় পড়ে যান তিনি।

চলে এলো ৭৩’র সালের নির্বাচন। তখন মনোনয়ন নিয়ে নূরুল ইসলাম ও সুবোধ মিত্রের মধ্যে চলছে ঠান্ডা লড়াই। নুরুল ইসলাম নিজের মনোনয়নের জন্য সাথে করে ঢাকায় নিয়ে গেলেন পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্যকে। একজনের সাথে এসেছেন মনোনয়নের জন্য। আবার নিজে মনোনয়ন কিনবেন- এ নিয়ে পীযুষ কান্তি দ্বিধায় পড়ে যান। এরমধ্যে নুরুল ইসলাম, সুবোধ মিত্রের সাথে পিযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য তাজউদ্দীন আহম্মেদের জন্মদিনে তার বাসায় যান। বঙ্গবন্ধুকে পা ছুঁইয়ে সালাম করে যাবার সময় বঙ্গবন্ধুর পাশেই বসা তাজউদ্দীন আহম্মেদ পীযুষ কান্তির পাঞ্জাবির কোনা টেনে ধরেন। তাজউদ্দীন আহম্মেদ আস্তে আস্তে পীযূষ কান্তিকে ধমকের সুরে বলেন, আপনি ওদের সাথে কেন? আপনিই তো মনোনয়ন পাবেন! এরপর নানা নাটকীয় ঘটনার পর পীযূষের জন্য মনোনয়ন কিনে আনেন নূরুল ইসলাম।

এমনকি পীযুষের মনোনয়ন (আবেদন ফরম) পূরণ করে দেন নুরুল ইসলাম নিজেই। পরে মনোনয়ন বোর্ডে হাজির হন পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য। মনোনয়ন বোর্ডে গিয়ে দেখেন বঙ্গবন্ধুর ডান পাশে বসে আছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং বাম পাশে তাজউদ্দীন আহম্মেদ। এছাড়া ফণিভূষণ মজুমদার, খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদসহ জাতীয় নেতারা রয়েছেন। মনোনয়ন বোর্ডে হঠাৎ তাজউদ্দীন আহম্মেদ তাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলেন, যাদের জন্য মনোনয়ন নিতে এসেছেন- কেন তাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন কিনলেন? সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমারো একই প্রশ্ন। এমন প্রশ্নে ক্ষণিকের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য্য। মুহূর্তেই সামলে নিয়ে তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী ২৫ বছর বয়সী মানসিকভাবে সুস্থ যে কোন নাগরিক ভোটে দাঁড়াতে পারেন-এ কারণে তিনি মনোনয়ন কিনেছেন। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ইয়েস।

মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য মণিরামপুর চলে আসেন। তিনি তখন থাকতেন চাচাতো ভাই তপন ভট্টাচার্য্যরে বাড়িতে। যে দিন মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল- সেদিন তিনি বাসায় বসে রেডিও শুনছিলেন। তার নাম ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যে আ’লীগ নেতা এমএম নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক লোকজন তাকে তপনের বাড়ি থেকে নিয়ে বাজারে মিছিল করা হয়। এরপর ভোটে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৩ সালে নভেম্বর মাসে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্য হয়ে ২৬ দিন রাশিয়ায় যান পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য। ১৯৭৫ সালে নভেম্বরে ডেপুটি স্পিকার বাইতুল্লাহ, আব্দুর রহমান ও পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্যকে কমনওয়েলথ পার্টির সদস্য হয়ে ভারতে যাবার কথা ছিল। ১৫ আগস্ট নির্মম ঘটনার পর খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদ তাকে ডেকে পাঠান। খন্দকার মোস্তাক তাকে বলেন, শেখ সাহেব আগে থেকেই আপনাদের ভারতে যাবার জন্য ঠিক করে রেখেছেন-আপনারা যান।

এসময় তার হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে খন্দকার মোস্তাক তাকে বলেন, ‘ইন্দিরা গান্ধীকে বলবেন, ‘শেখ সাহেবের মৃত্যুর ব্যাপারে তিনি দায়ী নন। সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাবগাক্সক্ষা পোষণকারী অফিসার শেখ সাহেবসহ তার পরিবারকে হত্যা করেছে। তার (ইন্দিরা গান্ধি) সাথে মুজিবের যে চুক্তি আছে-তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। কিন্তু মোস্তাকের প্রস্তাব পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেও বাকি বাইতুল্লাহ ও আব্দুর রহমান ভারতে চলে যান মোস্তাকের নির্দেশে। পরে আইনশৃংখলা বাহিনীর অত্যাচারে ও মানসিক যন্ত্রণায় আত্মগোপনে চলে যান পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য। ১৯৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করলেও দলীয় কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নির্বাচনে পরাজিত হন। এরপর জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেলেও তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কখনো অবস্থান নেননি।

সর্বশেষ যশোর জেলা আ’লীগের কমিটি গঠনের সময় তিনি সভাপতি পদের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ নিতে গেলে-জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে একটা কথা বলেন, ‘এর চেয়ে নিচের কোন পদ নেই? সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় আ’লীগের জাতীয় সম্মেলনের ২য় দিন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে যখন তার নাম সভানেত্রী ঘোষণা করেন-তখন তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জননেত্রী তাকে যে সম্মান দিয়েছেন তাতে তিনি কৃতজ্ঞ। আগামী নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন চাইবেন কি-না-এমন প্রশ্নের উত্তরে পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য বলেন, তিনি জননেত্রীকে মনোনয়নের কথা বলতে পারবেন না-তবে জননেত্রী তাকে যদি মনোনয়ন দেন তিনি জীবনের শেষ বেলায় নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছেন।

সৌজন্য : সমাজের কথা

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test