E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্মৃতির হাতবাক্সে আমাদের বাংলা সিনেমা

২০১৭ মার্চ ১৭ ১৫:৫৩:১৫
স্মৃতির হাতবাক্সে আমাদের বাংলা সিনেমা

মাসুম বিল্লাহ


বাদশা আমার সিনেমা পাগল বন্ধু। ভালো ভালো সিনেমা দেখা এবং বাংলা চলচ্চিত্রের খোঁজ-খবর ভালোই জানা তার। অনেক সময় কোন সিনেমা সাংবাদিক যে তথ্য বলতে হিমশিম খাবে, সে তথ্য বাদশা বলতে পারবে। সেদিন স্টার হোটেলে বসে ওকে বললাম, চলো বন্ধু একটা সিনেমা দেখে আসি। বন্ধু আমার দিকে যে চোখে তাকাল, তা আর না বলি। শেষে বলল, তোমার কি মাথা নষ্ট হয়েছে, নাকি আমার সঙ্গে মজা করছো? বলি, না দোস্ত, মজা না, সত্যি বলেছি। কতদিন হয় সিনেমা দেখি না। আমাদের সিগারেটের নেশা ছিল না, কিন্তু সিনেমা দেখার নেশা ছিল। বন্ধু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, হুম। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে সত্যি খুব খারাপ লাগে। আমরা তো সিনেমা দেখা বাদ দিতে চাইনি, আমাদের জোর করে বাধ্য করেছে, যাতে আমরা সিনেমা না দেখি। দুই বন্ধুর আলোচনা সেদিন আরো সামনের দিকে গড়ালেও এখানে সঙ্গত কারণেই তা উল্লেখ করছি না।

কিছুদিন পর বাদশা আমাকে ফোন দিয়ে বলল, দোস্ত আমাদের প্রিয় নায়কের নতুন ছবি মুক্তি পাচ্ছে। অমুক সিনেমা হলে চলবে এই শুক্রবার থেকে। ঈদের খুশি নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে ছবি দেখতে গেলাম। ছবির পরিচালক খ্যাতিমান। কিন্তু ছবির আধ ঘণ্টার মধ্যে বাদশা হলের মধ্যে বসেই মেজাজ হারাতে লাগল। কি পরিচালক কি ছবি বানাইছে? বাদশার কথায় সামনের সিটের দর্শক বিরক্ত। অগ্যতা বাদশাকে চুপ করতে হলো। কিন্তু বাদশা চুপ করেনি। রাগে গজগজ করেই চলেছে। জোর করে দুই বন্ধু সিনেমাটি দেখলাম। হলের গেট থেকে বের হয়ে কান ধরে বাদশা বলল, আর ছবি দেখবো না। প্রিয় নায়কের ছবি হলেও না। কে বলেছে এই ছবি করতে? এই ছবি না করলেই কী চলত না? এখানে প্রশ্ন আসতে পারে- পুরনো দর্শকের রুচি বদলেছে, নাকি ছবির মান কমেছে, না বেড়েছে? আমি বলবো, আমাদের রুচিটা ঠিকই আছে, কিন্তু এখন ছবির মান আগের চেয়ে কারিগরির দিক দিয়ে উন্নত হলেও ছবির নির্মাণ দর্শকের মন ভরছে না। প্রথমত ছবির গল্প শক্তিশালী না হলে দর্শক ছবি দেখবে কেন? এরপর ছবির পাত্র-পাত্রীর অভিনয়শৈলী দর্শদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারছে বলেও মনে হয় না। অভিনয়ে প্রাণ নেই।

অতীতে ফিরে যেতে পারি, তখনকার সময়ে নায়কের রূপদর্শনের চেয়ে দর্শক তার অভিনয় ক্ষমতাকেই বড় করে দেখতো। সেকারণেই বুঝি আমরা শুনতাম- পর্দা কাঁপানো নায়ক। নায়কের মাথায় চুল কম থাক, নায়কের পেট ভারী হোক তাতে দর্শকের কিছু আসত যেত না। দর্শক আবিষ্ট হয়ে সবার অভিনয় দেখত। শুধু দেখত না, ছবির সঙ্গে মিশে যেত। এই প্রসঙ্গে আমার নিজের কয়েকটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। ছোটবেলায় মায়ের কোলে বসে আমার সিনেমা দেখা শুরু। আগেরকার সিনেমায় কোনো দুঃখের দৃশ্য থাকলে শুধু মহিলা দর্শকই নয়, শতকরা ৯০ ভাগ দর্শকের কেঁদে ফেলত। তারপর সে কান্না ভেজা কণ্ঠে ভিলেনকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যেত- লোকটা কত খারাপ। এরপর নায়ক যখন ভিলেনকে মারত, তখনও দর্শক চিৎকার করে বলছে, মার শুয়োরের বাচ্চাকে মার, মারতে মারতে শেষ করে ফেল। সেই সঙ্গে দর্শকের তুমুল হাততালি। সিনেমা দেখে তখনকার দর্শকের চোখ ভিজত না, এমনটি খুব কমই হয়েছে।

আপনি যখন জীবনের কথা বললেন, তখন মানুষ তাতে মিশে যাবে। চোখ ভিজে উঠবে। এখনও কী জীবনের কথা নিয়ে ছবি হচ্ছে না? নিয়মিতই হচ্ছে, কারণ জীবনের বাইরে কিছুই নয়। তবে আবেগের জায়গাটায় গিয়ে এখনকার সিনেমা নাড়া দিতে পারছে বলে মনে হয় না। এর আরো একটি কারণ বলা যায়, আমরা দিনে দিনে আধুনিক হচ্ছি। ছবি দেখার সময় বুঝে গেছি, এটা বাস্তব নয়, সিনেমা। এটাকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। বরং এখন সিনেমা দেখে চোখ ভেজালে লোকে তাকে খ্যাত বা অন্য কিছু ভাববে। তখন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কাছে সিনেমা দেখা ছিল নিয়মিত রুটিনের মতো। প্রতি সপ্তাহে নতুন ছবি পরিবারের সবাই দল বেধে ছুটত সিনেমা হলে। সেদিন দুপুর থেকেই চলত সাজগোছের আয়োজন। সবার মাঝে উৎসবের আমেজ বইত। রাস্তায় রিকশাঅলারাও মানুষ দেখলে চিনতে পারত কারা সিনেমা দেখতে বেড়িয়েছে। সেকারণে বুঝেশুনেই সিনেমা হলের নাম নিয়ে যাত্রীকে ডাক দিত। টার্গেট খুব কমই মিস হতো রিকশাঅলাদের। টিকিট কাটার জন্য লাইনে দাঁড়ানোর মধ্যেও এক ধরণের উত্তেজনা, আনন্দ ছিল। তারপর চলতি শো শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার সময়টুকুও যেন ফুরাতে চাইত না। বার বার ঘড়ি দেখত কখন শো ভাঙবে। তারপর যখন চলতি শো শেষ হলে দর্শকরা লাইন ধরে বের হয়ে আসত তখন অপেক্ষায় থাকা দর্শকরা তাদের থামিয়ে জানতে চাইত, ভাই ছবিটা কেমন? জবাবে সে দর্শকরাও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে যেতে যেতে বলল, দারুণ ছবি। অনেকে আবার আরেক ধাপ এগিয়ে বলত, রাতে আরেক শো মারবানি। আমি তো এমনও দেখেছি, কোন কোন দর্শক এক ছবি টানা কয়েক শো দেখেছে, টানা তিন দিনও দেখেছে।

আমার ছোট মামা পরিচালক শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘ভেজা চোখ’ [২৫/০৩/১৯৮৮] ছবিটি টানা সতের বার দেখেছে। তারপর বাসায় এসে আমাকে সে ছবির গল্প বলে। আমিও তখন দেখার কথা বললে বলে, টানা তিন মাস চলেছে। এখন নতুন ছবি চলছে। হতাশ হয়েছিলাম আমি। ইশ এই ছবি আমি দেখতে পারবো না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দাঁড়াও আমি বড় হয়ে নিই, তারপর আমি একটা সিনেমা হল বানাবো, তারপর আমি একটা সিনেমা হল বানাবো, তারপর ঐ ছবি একা একাই দেখবো। না আমাকে সিনেমা হল বানাতে হয়নি। ১৯৯৯ সালে আমি খুলনা রূপসার রূপসাগর সিনেমা হলে ‘ভেজাচোখ’ ছবিটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সত্যিই ‘ভেজা চোখ’ দর্শকের চোখ ভিজিয়েছিলো। বর্তমানে এই ছবিটির কোন খোঁজ আমার অন্তত জানা নেই। প্রযোজক ইকবাল সাহেব প্রয়াত হয়েছেন। হয়ত এই প্রজন্ম ছবিটি দেখার সুযোগ পাবে না। একটা ছবি কেন একজন দর্শক টানা সতেরবার দেখে? এই রহস্য যতদিন না ছবির কারিগররা বুঝতে পারবেন ততদিন হয়ত আমরা আর ভালো সিনেমা দেখতে পাবো না।

আমি বলছি না, পূর্বের ছবির আদলে এখনো চলচ্চিত্র নির্মাণ হোক। বর্তমান চাহিদার কথা মাথায় রেখেও চলচ্চিত্র নিমার্ণ হতে পারে। বাংলা ছবির দর্শক আর ইংরেজি ছবির দর্শক এক নয়। আমাদের দেশের মানুষ বিনোদনধর্মী ছবি পছন্দ করে। ছবিতে ৫টি গান না থাকলে দর্শকের মন ভরে না। দর্শক ছবি দেখা শেষ করে ছবির কানে বাজতে থাকা গানটির প্রথম দুটি লাইন গাইতে গাইতে সিনেমা হল থেকে বের হবে। এখন কেন সিনেমার গানগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে না? আগে একটি একটি গানের জন্য সিনেমা কাহিনিকার, পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পীরা টিমওয়ার্ক করতেন। তাদের পরিশ্রমের ফলেই আমরা জনপ্রিয় গানগুলো শুনতে পেরেছিলাম। এইটুকু আমাদের বাংলা ছবির দর্শকের চাওয়া। অন্যধারার ছবিও নির্মাণ হবে, সে ছবিরও কিছু দর্শক আছে। আমাদেরও মনে রাখতে হবে, ঢাকা শহর, বসুন্ধারা সিনেপ্লেক্স এর দর্শক আর পুরো বাংলাদেশের দর্শক এক নয়।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ খেটে খাওয়া মানুষ, সপ্তাহে একদিন তারা বিনোদনের খোঁজে সিনেমা হলে আসে। তখন যদি তাদের আমরা ভারিগল্পের সিনেমা দেখাই, তাহলে তার ভালো লাগবে কেন? তবে আমরা আমাদের মধ্যবিত্ত দর্শকদের আমাদের দোষেই হারিয়েছি। আমরাই আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংস করেছি। ২০০০ সাল থেকেই আমাদের চলচ্চিত্রের ধ্বংসের শুরু। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমি নিয়মিত সিনেমা দেখেছি। শুধু আমি একা না। মহিলা দর্শকও নিয়মিত সিনেমা হলগুলোতে ভিড় জমাত। তখনই শুরু হলো কিছু অসাধু চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীর কারসাজি। তারা মনে করলেন, এখন আর সিনেমা চলছে না। সিনেমার ব্যবসা বাড়াতে হলে সিনেমা অশ্লীলতা ঢোকাতে হবে। তারা সিনেমার সঙ্গে আলাদা ভাবে শুটিংকৃত কাটপিস ঢুকিয়ে দিতে লাগলেন। তারপর থেকে লজ্জিত, অপমানিত মহিলা দর্শক সিনেমার মাঝপথেই আসন ছেড়ে সেই যে বেরিয়ে গেলেন, তারা আর ফিরে এলেন না। এটা আমার চোখে দেখা। একটা ঘটনার কথা বলতে পারি, সৈয়দ হারুন পরিচালিত ‘অচল পয়সা’ [২৭/০২/১৯৯৮] সিনেমাটিও আমার খুব প্রিয়। কিন্তু ছবির বিরতির আগে অথবা পড়ে ভিলেনদের নিয়ে একটা বাড়তি দৃষ্টিকটু গান দেখানো হয়। যা দেখে দর্শক বিব্রত হয়েছিল। পরে ইলিয়াস কাঞ্চনের মুখে শুনেছিলাম, বিষয়টির কথা পরিচালকও জানতেন না। কারণ তাকে বললে তো এই গানের শুটিং তিনি কিছুতেই করবেন না। তাই প্রযোজক নিজেরাই ব্যবস্থা করলেন। ইলিয়াস কাঞ্চন তার ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছবিটি দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওই গানের দৃশ্য হঠাৎ পর্দায় এলে তিনি তার ছেলে-মেয়ের চোখ চেপে ধরেছিলেন। তারপর থেকেই শুরু সামাজিক, পারিবারিক আবহের ছবিগুলো তৈরি বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হলো সস্তা বাণিজ্যিক ছবির যুগ। যেখানে অযথা মারামারি, গালাগালি ছড়াছড়ি। আর ছবিরগুলোর নায়ক-নায়িকাদের আমরা রুচিশীল দর্শকরা ভালো করেই চিনি। এইসব ছবির দর্শকরা হলো নিম্নশ্রেণীর এবং কিছু স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা। সেকারণেই এইসব ছবিগুলো মধ্যবিত্ত দর্শক টানতে পারল না, পারার কথাও নয়। পারিবারিক ছবির নির্মাতারাও বেকার হয়ে পড়লেন। কেউ কেউ পৃথিবী থেকেই বিদায় নিতে নিলেন। প্রখ্যাত, দর্শকনন্দিত প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও সিনেমা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখলেন। কেউ অভিমানে, কেউ প্রতিবাদ জানাতে। বর্তমানে ছবি নির্মাণের সংখ্যা কমে গেছে। যাও নিমার্ণ হচ্ছে, তাও দর্শক টানতে পারছে না। আমাদের চিরাচরিত গল্পের কাহিনি থেকে এখনো বের হতে পারছে না। আবার এই শিল্পে নায়ক-নায়িকার সংকট। একজন নায়ক পুরো চলচ্চিত্র শিল্পকে টেনে নিতে পারছেন না। পাশাপাশি কিছু ভিন্নধারা ছবি নির্মিত হচ্ছে, তাও দর্শক টানতে পারছে না। তবুও আমরা আশা করে আছি, বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী যুগ ফিরে আসবে।

(এমবি/এএস/মার্চ ১৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test