E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কোথায় হারিয়ে যায় আদিনাথ স্যারেরা!

২০১৭ মে ১৯ ১৭:০২:৩৫
কোথায় হারিয়ে যায় আদিনাথ স্যারেরা!

মো. আমির হোসেন


আমি যখন মসজিদের মক্তবে হিংসার পাঠ শিখছি, আলিফ, বা , তা , ছা মুখস্ত করার ফাঁকে ফাঁকে হুজুর অমুসলিমদের নিয়ে মজার মজার গল্প বলতেন। খুব মজা পেতাম সেগুলো শুনে। অনেক সময় সবাই একসাথে জোরে জোরে হেসে উঠতাম। গল্পগুলোতে কেবল হাসির খোরাকই ছিল না, আমাদের কাঁচা মস্তিষ্কে অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণার বীজও একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল। আমরা তখন মসজিদের মক্তবে হিংসার পাঠ শিখছি।

আমার বাবা তখন আদিনাথ দত্ত স্যার নামের একজন হিন্দু শিক্ষককে আমাদের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলেন। তিনি আমাদের প্রতিবেশীও ছিলেন। তাঁর বয়সী আমার বড় ভাইয়ের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। তখনই শুনেছি ঢাকা ফুটবল ডিভিশনেও তিনি চান্স পেয়েছিলেন। তরুণ, চঞ্চল, হাসিখুশি। তাঁর চেহারার বর্ণনা এখন হয়ত হুবহু দেওয়া সম্ভব নয়, ভুলে গেছি। তবে আবছা ভাবে মনে পড়ে, বোম্বের হিরো অনীল কাপুরের সাথে তাঁর চেহারার কিছুটা মিল ছিল হয়ত।

আমি প্রথম থেকেই তাকে পছন্দ করতাম না। কারণটা তিনি হিন্দু ছিলেন বলেই। তিনিও সেটা বুঝতে পারতেন, তাই সকল সময়ই আমার মন জয় করার চেষ্টা করতেন। তিনিও গল্প বলতেন, তবে সেই গল্প গুলোতে হিংসা ছিল না, বিদ্বেষ ছিল না, ছিল মানবতা আর মানুষকে ভালবাসার শিক্ষা। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম তিনি আমাদের নবীজীকে মহাত্মা মুহাম্মদ বলতেন। তাকে সম্মান করে কথা বলতেন। তিনি বলতেন, আল্লাহ একজনই। মানুষই সেই আল্লাহকে আলাদা আলাদা নামে ডাকে।

আমি তখন থেকেই পার্থক্য করতে শিখি হুজুরের সাথে আদিনাথ দত্ত স্যারকে। দুজনের মধ্যে কত পার্থক্য। একজন অন্য ধর্মের দেব-দেবীদের নিয়ে মজা করেন, তুচ্ছ করেন। আর একজন ভিন্ন ধর্মের হয়েও আমাদের নবীজীকে মহাত্মা বলছেন। ৯২তে বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে ভারতে গণ্ডগোল লেগে গেল। সেই গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল আমাদের দেশেও। আমার মনে পড়ে সেই গণ্ডগোলের রাতে আদিনাথ দত্ত স্যার ও তাঁর পুরো পরিবার (অন্য আরো দুইটি হিন্দু পরিবারসহ) আমাদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাবা তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন তাদের কোন ক্ষতি হবে না। কর্মচারীদের হুংকার দিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, বাড়ির ত্রি-সীমানায় যে আসবে তারই মাথা ফাটিয়ে দিবি। পরেরটা পরে দেখা যাবে। বাইরে মিছিল হয়েছে, কিন্তু আমাদের বাড়িতে ঢোকার সাহস কারো হয় নাই। যদিও তাঁরা জেনে গিয়েছিল, আমাদের বাসায় হিন্দু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আমি তখন স্যারের কোলে। স্যার বিড় বিড় করে বললেন, যারা মসজিদ ভেঙ্গেছে তাঁরা জানোয়ার, যারা অন্য দেশের হিংসা আমার দেশে দেখাচ্ছে তাঁরা আরো বড় জানোয়ার। (কথাগুলো হয়ত এমনই হবে, আমি সাজিয়ে নিয়েছি)

গণ্ডগোল থেমেছিল, দেশ শান্ত হয়েছিল। কিন্তু আদিনাথ দত্ত স্যারেরা টিকতে পারেনি বেশিদিন। তাদেরকে একদিন সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে চলে যেতে হয়েছে। দেশে থাকতে একবার, দুবার এসেছিল দেখা করতে। তারপর একেবারের জন্য একদিন হারিয়ে গেল। আর কখনো দেখা হয়নি স্যারের সাথে। কোথায় যেতে পারে? শুনেছি হিন্দুরা চলে গেলে ভারতেই যায়। স্যার কী এখন ভারতে আছে? এই অসভ্য দেশটাকে সভ্য করতে যে আদিনাথ দত্ত স্যারের মত আরো অনেক অনেকগুলো স্যারের প্রয়োজন ছিল।

লেখক : ফ্রি-লেন্সার।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test