E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

গ্রন্থাগার বনাম জাতীয় উন্নয়ন

২০১৪ অক্টোবর ১৮ ১৪:৩৪:৫৬
গ্রন্থাগার বনাম জাতীয় উন্নয়ন

মো. আতিকুর রহমান : একটি দেশের তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারই পারে দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে। আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারক, গবেষক, জ্ঞানীদের কাছে উক্তটির যথাযথ সত্যতা থাকলেও গ্রন্থাগারের সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশে তাঁদের কোন পদক্ষেপ বা কর্মপ্রচেষ্টা আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু আমরা জানি, যে দেশের গ্রন্থাগার যত বেশি সমৃদ্ধ সেই দেশ তত বেশি উন্নত।

কিন্তু আমাদের দেশের গ্রন্থাগারগুলি সেবা তথা জনবল কাঠামো দেখলে সহজেই ফুটে ওঠে এর করুণ দশা। দেশের গ্রন্থাগার গুলির মানন্নোয়নে বছরে বিশেষ কিছু উল্লেখযোগ্য দিনে দুই একটি সেমিনারে ও সিম্পোজিয়ামে আমাদের নীতি-নির্ধারকদের কন্ঠে গ্রন্থাগার উন্নয়নের বড় বড় নীতিকথা বা উক্তি শুনলেও বাস্তবে এইসব নীতি কথার কোনটিই পরবর্তীতে বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু তারা অবশ্যই জানেন একটি তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার পারে জাতির ভাগ্য পরির্বতন করতে। কিন্তু আমাদের দেশে অবস্থিত অধিকাংশ গ্রন্থাগার গুলির সেবার মান দেখলে সত্যিই অবাক লাগে। যে গ্রন্থাগার পারে জাতির উন্নয়ন সাধন করতে সেই গ্রন্থাগারের সার্বিক সেবার মান ও গ্রন্থাগার গুলিকে তথ্য সমৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন করতে সরকার তথা নীতি-নির্ধারকদের অনিহা সত্যিই আমার কাছে বোধগম্য নয়।

আমাদের দেশের অধিকাংশ সরকারি কলেজ, ইনস্টিটিউট গুলির দিকে তাকালে দেখতে পাই অধিকাংশ সরকারি কলেজে লাইব্রেরীয়ান এর পোস্ট খালি, সেখানে সহকারী লাইব্রেরিয়ান দিয়ে আবার কোথাও অফিস সহকারী দিয়ে লাইব্রেরির তদারকির কাজ করানো হচ্ছে। এ বিষয়ে যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও এইসব প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগ করা হচ্ছে না এবং সেবার মান বাড়ানো হচ্ছে না। যেখানে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশের প্রাণ হচ্ছে লাইব্রেরি। সেই প্রাণকে জাগিয়ে তুলতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান তথা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেন এই অনিহা ? এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ে ডিপ্লোমা ও মাস্টাস কোর্স পরিচালিত হলেও দিন দিন এই বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা শূন্যের কোঠায় পরিণত হচ্ছে। কারণ সরকার তথা নীতি-নির্ধারকদের এই বিষয়ের প্রতি ধারণার অভাব এবং গ্রন্থাগার যে দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে পারে সেই বিষয়ে সচেতনতার অভাবে এই পেশার প্রতি দিনদিন শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

যদিও এ কথাও সত্য, বর্তমানে এত সব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গ্রন্থাগারগুলি দেশের অগ্রগতির লক্ষ্যে সীমিত শক্তি দিয়ে দেশ ও জাতির ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে যা কিছুটা হলে মনে আশার সঞ্চয় করে। কেননা গ্রন্থাগার একটি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারক ও বাহক। একটি জাতি প্রকৃতপক্ষে জাতি হিসেবে কত সভ্য কত উন্নত তা তাদের গ্রন্থাগার পর্যবেক্ষনের মাধ্যমেই ফুটে উঠে। উন্নত বিশ্বের জনগণ গ্রন্থাগারের উপর নির্ভরশীল ও জ্ঞান আহরণে অধিক সচেষ্ট বিধায় তাদের সর্বক্ষেত্রে উন্নতি সম্ভব হয়েছে। উন্নত দেশ গুলি যদি তাদের গ্রন্থাগার গুলিকে সমৃদ্ধি করে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে তবে আমরা কেন পারছি না। যদিও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জনগণের জন্য একমাত্র গ্রন্থাগারই পারে জাতীয় সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে। কিন্তু, দেশের গ্রন্থাগারগুলির সেবার মান ও সেগুলিকে তথ্য সমৃদ্ধ করতে সরকার তথা নীতি নির্ধারকদের গ্রন্থাগার বিষয় সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাঁদের অধিক উদাসিনতা ও বৈরিকতার কারণে জাতি তার সামগ্রিক উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয় তথ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন একজন গবেষক বঞ্চিত হচ্ছে তার গবেষণা বিষয় সম্পর্কিত সর্বশেষ তথ্য থেকে। কেননা একজন গবেষকের পক্ষে তার গবেষণার কাজ একা পরিচালনার করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই গ্রন্থাগারমুখি হতে হয় ও গ্রন্থাগার উপকরন মূলত: পাঠ্যপুস্তক ও বিভিন্ন রেফারেন্স সেবা গ্রহণ করতে হয়। বইপত্র ও তথ্য ছাড়া গবেষণা করা আর ঢাল তরবারী ছাড়া যুদ্ধ করা সমান কথা। দেশে বিভিন্ন প্রকার গবেষণার তথ্য সেবামূলক কাজকে ফলপ্রুসু ও তাদের সহযোগিতার জন্য হলেও দেশের গ্রন্থাগারগুলির সেবার মান উন্নয়ন করাকে জরুরী বলে মনে করি।

একজন গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীর কাছে তাদের জ্ঞান আহরণের প্রকৃষ্ট বাহক হচ্ছে বই। উদাহরণস্বরুপ বলতে পারি বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীগণ যেমন প্লেটো, এরিষ্টটল, রবীন্দ্রনাথ এর মতো মনীষীরাও গ্রন্থাগারের কাছে ঋণী। যুগে যুগে গ্রন্থাগার নবপ্রজন্মকে দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তৈরীতে বিশেষ ভ’মিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের মত একটি দারিদ্র দেশের শিক্ষার্থীদের যেখানে ক্লাসের প্রত্যেক বিষয়ের বই কিনে পড়ার মত আর্থিক অবস্থা নেই, একথা জানা সত্ত্বেও এদেশের গ্রন্থাগারগুলির সেবার মান উন্নয়নে এবং শিক্ষার্থীদের গ্রন্থাগারমুখি করতে উচ্চ পর্যায়ে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করাকেও জরুরী বলে মনে করি। আমরা আশা করি, আজকের শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও মনন দিয়ে সঠিক গ্রন্থাগার ও তথ্য সেবার মাধ্যমে একদিন দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং একটি উন্নত দেশ জাতিকে উপহার দিতে পারবে। অন্তত: তাদের কথা চিন্তা করে হলেও দেশে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারগুলি উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়া তেমনি প্রয়োজন বলে মনে করি।

আমাদের প্রায় সবারই জানা, একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে সেই দেশের অশিক্ষা। অর্থাৎ এই অশিক্ষাই একটি দেশের উন্নয়নকে বাঁধাগ্রস্ত করে পিছিয়ে দেয়। উন্নত বিশ্বের শিক্ষার হার যেখানে ৯০% -১০০% সেই জায়গায় বাংলাদেশে শিক্ষার হার ৬৬-৭১%। ফলে এদেশের জনগণ নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে পিছিয়ে পরছে। অশিক্ষার ফলে কুসংস্কারে আচ্ছাদিত তথ্য প্রযুক্তির এই আধুনিক ধারা থেকে পিছিয়ে পরছে। যদিও দেশের শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য সরকার ও গণগ্রন্থাগার বিশেষ কিছু ভুমিকা পালন করে আসছে, যেটুকুও করছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এদেশের প্রতিটি জনগণকে গ্রন্থাগার ব্যবহারের প্রতি উদ্ভুদ্ধ করতে বিশেষ প্রচার ব্যবস্থা হাতে নিতে হবে। দেশের অবস্থিত বিভিন্ন গ্রন্থাগারের রেফারেন্স শাখাকে তথ্যসমৃদ্ধ ও মানসম্পূর্ণ করতে হবে। যাতে গবেষক তার গবেষণা সম্পর্কিত শেষ তথ্যটি দ্রুত গ্রন্থাগার থেকে পেতে পারে। যদিও বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র সামাজিক এই দায়বদ্ধতা থেকে গ্রন্থাগার সেবা জনগণের দোড়গোড়ায় পৌছিয়ে দিকে উল্লেখযোগ্য বেশকিছু কার্যক্রম গ্রহণ করেছে যা আমাদের কিছু অপ্রাপ্তির মধ্যেও প্রাপ্তির সঞ্চার করে।

একটি জাতির উন্নতির জন্য তার সংহতি অনস্বীকার্য। জাতীয় সংহতির অভাব দেখা দিলে দেশ ও জাতির মধ্যে নৈরাজ্য বিরাজ করে। যদিও আমাদের দেশের গ্রন্থাগার গুলি সীমিত শক্তি দিয়ে জাতীয় সংহতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় সেইসব কার্যক্রমও দিন দিন বিলীন হচ্ছে। যদিও আর্থিক সীমিত শক্তি নিয়ে কিছু সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, চলচিত্র ও সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু আমাদের দেশের গ্রন্থাগারগুলির সীমিত বাজেট কোন কর্মপ্রচেষ্টা আমাদের তেমন চোখে পরে না। যদিও একটি গ্রন্থাগার পারে সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে অপসংস্কৃতি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে। কিন্তু সেইসব গ্রন্থাগারের মান উন্নয়নে নীতি-নির্ধারকরা এত উদাসিনতা গ্রন্থাগারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও সেবা থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। জেলা ভিত্তিক পাবলিক লাইব্রেরীগুলোতে আরো করুণ দশা বিরাজ করছে। উপযুক্ত বেতন কাঠামো ও দক্ষ জনবল না থাকার কারণে উক্ত গ্রন্থাগার গুলি ধ্বংসর দারপ্রান্তে উপনিত হচ্ছে। জাতীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এইসব গ্রন্থাগারগুলিকে বাঁচাতে সরকারের নীতি নির্ধারকদের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি।

দেশের প্রায় টিভি চ্যানেল গুলি খুললেই দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সচেতন ও সুশীল সমাজের নীতি-নির্ধারকরা উল্লেখিত বিষয় গুলি সুষ্ঠু সমাধানের দিক নিদের্শনা ও বেশ জোড়ালে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। কিন্তু জাতিতে তথ্য সমৃদ্ধ করে দেশের সার্বিক উন্নয়ন, শিক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধি ও জাতির সার্বিক জীবন জীবিকার মানন্নোয়নের ক্ষেত্রে যে একটি গ্রন্থাগার উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে সেই বিষয়ে টিভি চ্যানেলে এ সম্পর্কি কোন টক শো বা প্রচারণা আমাদের চোখে পরে না। তাই টিভি চ্যানেল গুলির প্রতি আমার জোড় অনুরোধ এদেশের জনগণকে অধিক জ্ঞান আহরণে গ্রন্থাগারমুখী করতে বিশেষ প্রচারণা ও অনুষ্ঠান মালা গ্রহণের পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন।

সর্বশেষে এই কথাই বলবো, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের একটি প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে গ্রন্থাগার। শিক্ষা প্রসার, গবেষণা, দৈনন্দিন জীবন যাপন, সমাজের মান উন্নয়ন, সমাজের মানুষকে প্রকৃত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে, সমাজ থেকে অশিক্ষা দূর করতে তথা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি গ্রন্থাগার যে, একটি জাতির প্রাণকেন্দ্র এই বোধ প্রতিটি জনগণের মাঝে জাগিয়ে তুলতে পারলেই একটি দেশ, সমাজ তথা একটি জাতির সত্যিকারের ভাগ্য উন্নয়ন ও সার্বিক সমৃদ্ধি সম্ভব হবে। তাই সকলকে গ্রন্থাগার উন্নয়নে একযোগে কাজ করার পাশাপাশি গ্রন্থাগারগুলি অধিক ব্যবহারের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারকগণ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করবেন জাতি এমনটিই প্রত্যাশা করেন।

লেখক : লাইব্রেরিয়ান ও কলাম লেখক

(এএস/অক্টোবর ১৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test