E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কবি মৌ মধুবন্তীর ‘বাতাসে বৃক্ষপ্রেম': নান্দনিক দৃষ্টিতে

২০১৫ সেপ্টেম্বর ২৮ ১৪:০৫:৩৮
কবি মৌ মধুবন্তীর ‘বাতাসে বৃক্ষপ্রেম': নান্দনিক দৃষ্টিতে






 



কবিতা ব্যক্তি প্রতিভার আবেগসৃষ্ট। যদিও মানবেতিহাসে আদি কবিতার উদ্ভব—গোষ্ঠিমানসের জমাটবদ্ধ আবাগের ফসল। গোত্র বা গোষ্ঠীর দলবদ্ধ উৎসবগীতেই কবিতার জন্মবীজ সুপ্তাবস্থায় ছিল। জন্মলগ্নে কবিতা ছিল একান্তই ধ্বণি বা ছন্দময়। চেতনার সংবদ্ধতা ও প্রকাশভঙ্গির বলিষ্ঠতা,ভাষাগত সুষমা ও প্রাঞ্জলতা এবং আবেগ জারিত আকাঙ্ক্ষার দরুন তা হয়ে ওঠে ললিত ও গীতল। কবিতা তথা শিল্পবস্ত মাত্রই আনন্দদায়ক, নান্দনিক সৌন্দর্য্যের প্রকাশ করে। শৈল্পিক আনন্দ একান্তই আত্মোলব্ধিজাত। দুঃখ, আনন্দ, ভয়, প্রেম, বিরহ, বেদনার সকরুণ সুর যদি কবিতায় থাকে তবে তা পাঠকের আত্মোলব্ধিতে চাঞ্চল্য, বেদনার্ত হয়ে ওঠে। তাই পাঠক সুনির্মল আনন্দ উপভোগ করে কিংবা দুঃখবোধে জারিত হয়ে মনকে স্পষ্ট করে তোলে। এতেই মানুষের আনন্দ, নান্দনিকতা বোধ :
হিরন্ময় এই পথ চলায়
হীরা-পান্নার গতি হোক
শ্লথ;ক্রমশ:জেগে উঠুক
স্বপ্ন কবি—-
এক আঁজলা
কবিতা পান করে—-
অবিরাম দৃষ্টিদানে।
(হিরন্ময়)
মৌ মধুবন্তী তার ‘বাতাসে বৃক্ষপ্রেম’ কাব্যগ্রন্থে এভাবেই নির্ভেজাল নান্দনিকতার প্রকাশ ঘটিয়ছেন; যা পাঠক চিত্তকে গভীরতম অনুভূতিত টেনে নিয়ে গিয়েছে।

হানিমুন প্রকাশ গতকাল বাড়ি এসে বললো,
চলো,এক্ষুনি বেড়িয়ে পড়ি।
ট্রেনটা মিস করলে আর কোনদিন
হানিমুনে যাওয়া হবে না।
কেন?কেন?
কেন আর কোনদিন যাওয়া হবে না?
কারণ,আজ রাতেই তারা
মৌচাকটা ভাংতে আসবে।
(হানিমুন প্রকাশ)

কবিতা শুধুমাত্র একান্ত আবেগানুভূতির ফসল নয়। এ বাস্তব, স্বেদাক্ত প্রাত্যাহিকতায় সৃষ্ট, মেধা, মন ও মননে অবচেতন স্মৃতির অনুবর্তন।মৌ মধুবন্তীর কবিতায় নন্দনতত্ত্বের ভাব-প্রবাহগুলো প্রেম, প্রকৃতিত ও ঐতিহ্য নিয়ে ফিরে এসেছে।আর এসব নন্দন্তত্ত্বের সূত্রকে তিনি তার কবিতায় আবেগের গ্রন্থিতে গ্রন্থন করে বিনির্মাণ করেছেন এভাবে :
কৃপন বিলাসে পড়ে সবুজ পুঁথি
অবিনাশী স্বপ্ন জমিন,মেঘের লাঙ্গলে চষে
দূরবীণ ফসল,ভাবের জগতে নিয়ে বলে,
এ আমার মাতৃমাতুল,এর নাম কবিতা।
জেনে রাখা ভালো।
(সবুজ পুঁথি)

কিছু কিছু মানুষ জন্মান শ্রমজীবী, সর্বহারা মানুষের প্রতি দুর্নিবার ও প্রগাঢ় ভালোবাসা নিয়ে। নিঃসন্দেহে এঁদের সংখ্যা অতি অল্প,নগন্য পরিমাণে। অস্থির, টালমাটাল চলমান এ সময়ে ভালোবাসাহীনতাই মেদ-মাংশে স্ফীত হওয়ার একমাত্র উপাদান। এই স্বল্প সংখ্যক মানুষেরা এখানে কোন স্বস্তিবোধ করেন না। তাঁদের অনুভবে গভীরভাবে ধরা পড়ে অন্ধকার এক অরণ্যের ভয়ংকর, স্বার্থান্ধ, শুভবুদ্ধিহীন হিংস্রতা।মৌ মধুবন্তীর ‘জঙনাম’ কবিতার সুস্পষ্ট বক্তব্য, বাচনভঙ্গি ও শ্রেয়শের বোধ তা নিশ্চয়ই চলমান এ সময়ের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ, স্পর্ধিত ধারা। তার এ কবিতা পাঠকের অভিজ্ঞতার জগৎকে প্রসারতার প্রগাঢ় মানবিক রসের অভিসিঞ্চনে পাঠকের হৃদয়ে অভিভূত হয়ঃ
…….দুর্বৃত সময়ের দুর্ব্যেধ্য চেহারার
সমিল বন্ধন খুলে বেরিয়ে আসুক
পাথুরে পথের কঠিন সংগ্রাম।
তারপর মানুষের গান লিখে লিখে
মুছে নিয়ে বুকের রক্ত,খুন-লাল;
লিখা হবে নতুন জঙনাম ।
(জঙনাম’)

কিংবা

মানুষ কখনো অসহায় নয়
দুর্যোগে সব হারিয়ে পথে
বসে;পায় নাকো ভয়
আবার আশায় বুক বেঁধে
পথে নামে
পথের উপরেই নতুন করে
ঘর বাঁধে
(পথ বাঁধে)

মৌ মধুবন্তী। বাস্তব থেকে এক অসীম পরাবাস্তব জগতে প্রবেশ করে তার মিথ ভাবনা; আধুনিক শিল্প ভাবনা, ইতিহাস ও মিথের সংশ্লেষণতার গভীর এক চেতনার জন্ম দেয় তার কবিতা। নান্দনিক ভাষার প্রত্যক্ষ প্রদর্শন ঘটিয়ে সযত্নে কবিতা বিনির্মাণ করেন করেন কবিতা; যা নূতন চিন্তা-পূরণো ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে পূরণোকে পরাস্ত করে নূতন এক চেতনার সৃষ্টি করে এবং প্রচলিত একরৈখিকতার বর্গকে গুঁড়িয়ে বহুরৈখিকতাকে আশ্র্য় করেছেন তার ‘বেহুলা বহুব্রীহি’কবিতায়; যাতে একক ব্যক্তির কথা নেই, আছে সামষ্টিক সমস্ত নারী তথা মানুষের উপস্থিতির কথা আর শ্রেণী যেখানে সমষ্টি বা জোটবদ্ধ; সেখানে নৈরাশ্যে উপেক্ষিত। জীবনে ব্যর্থতার পাশাপাশি প্রবল আশাবাদও অস্ত্বত্মান। তবে শুধু আশাবাদকে আঁকড়ে থাকলে জীবনে শূণ্যগর্ভতা অনুভব করে আবার শূণ্যতাই একমাত্র তত্ত্ব —-মেনে নিলে উভয়েই ব্যররথ। প্রবল শূণ্যতা ও আশাবাদ—এ দু’ইয়ের স্বার্থক মিলন দেখি কবির অভিজ্ঞান, দার্শনিক চেতনা, আত্মরতিমূলকভাবে একটি অপরুপ নান্দিনিক দৃষ্টিভঙ্গিতেঃ
বিকেলটা গড়াতে গড়াতে
সময়ের কলস থেকে
সব জল উপুড় করে ঢেলে
দিল অন্ধকারের নদীতে
বেহুলা এবার প্রস্তুত হও
কল্পণার ভেলা নিয়ে…।
(বেহুলা বহুব্রীহি)

মৌ মধুবন্তী জীবনের পরিচর্যা করেন জীবনের অস্থির সময়, ক্ষয়িষ্ণু রুপ, ক্লেদ আর গ্লানিকে দৃশ্যমান করার মানসে। যুগ মানসের যন্ত্রণা, নৈঃসংঙ্গ, একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতার সূত্রের প্রয়োগ করে স্বার্থকভাবেই তার কবিতায় নন্দনচেতনাকে দার্শনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন এভাবেঃ
আমি আলতা পরা পা দিলাম তোমাকে
তুমি আগুনে ঝলসে দিলে….
মেহেদী রাঙা হাত দিলাম তোমাকে
তুমি বৈধব্যের কামড় বসিয়ে দিলে
আমি উত্তপ্ত দুপুর দিলাম;
এক ফোঁটা জল দিতে পারো নাই,
আগুনও না
তুমি একটা নুব্জ্য প্রকৃতি,
….আদতেই তুমি নিঃস্ব।
(আদতেই তুমি নিঃস্ব)

কবিতাই পারে আমাদের হৃদয়ের গভীরে আত্ম-প্রতিফলন ঘটাতে। নান্দনিক ভাষার প্রত্যক্ষ প্রদর্শনে নিজেই হয়ে উঠতে পারে আরেক ভাষা। আর এ ভাষা নিজের নির্দিষ্ট অর্থের ভেতর বিশেষ অনুভব ফুটিয়ে তোলে, তখন বানানো অর্থের সঙ্গেস্পষ্ট বিরোধ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে আর তখনই মানুষের মাঝে আত্ম-প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মৌ মধুবন্তী মূলতঃ আবেগের সুক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে চষে বেড়ান কবিতার লাঙ্গল।স্পর্শ করার ক্ষমতা একান্ত নিজস্ব। মৌ মধুবন্তী শব্দ দিয়ে কবিতা এমনভাবে নির্মাণ করেন যাতে পাঠক চেতনার মর্মমূলে প্রবাহিত থাকে পাহাড়ী ঢলের মতোন; এখানেই তার কবিতার নান্দনিকতা পরিস্ফুট হয়ে ওঠেঃ
এইটুকু প্রেম বৃক্ষের!
এইটুকু প্রেম বেদের জমিন
খুঁটিয়ে খেয়ে নাও পালক বিহীন
‘প্রেম’ লোকপাদ্যে লিখা কথা
শেকড়ে গুঁজে দিলাম
নিষুপ্ত ব্যথা,
(বৃক্ষপ্রেম)

বাতাসে বৃক্ষপ্রেম
(কাব্যগ্রন্থ)মৌ মধুবন্তী

প্র্রকাশক:নন্দিতা
আলোচক:রবিউল মানিক

৯(আরএম/বিএইচ২৮সেপ্টেম্বর২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test