E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রতিবেশী নদীর মতো কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে/বদরুল হায়দার

২০১৫ নভেম্বর ১০ ১৬:০২:২১
প্রতিবেশী নদীর মতো কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে/বদরুল হায়দার






 

আন্তঃনগরের প্রতিবেশীর সন্ধানী
বদরুল হায়দার

সাদাফ হাসনাইন মানজুর হচ্ছে-স্বনির্মিত কবি সত্ত্বা। স্বভাবজাত কবি প্রতিভা তাকে করেছে নিভৃতচারী নির্মোহ মানুষ। জাগতিক জীবনের সকল বাস্তবতাকে জয় করে তিনি সার্বক্ষণিকই কবি সত্ত্বা লালন করেন। কবি ও কবিতার প্রতি দরদ তার আজন্ম সঙ্গী। ফলে বহুমাত্রিক জীবনাচারের বাইরে অন্তর বাক্যে যিনি কবি থাকেন স্বাভাবিক ভাবে। ফলে তার কবিতা হয়ে ওঠে পাঠক প্রিয় । অভিজ্ঞতার ফুলকি ফুটতে থাকে তার কবিতায়। প্রজ্ঞা জ্ঞান শ্লেষ, অবজ্ঞার অভ্যন্তরে তিনি লালন করেন প্রেম মানবতা। সাদাফ হাসনাইন মানজুর “প্রতিবেশী নদীর মতো” কাব্যগ্রন্থ দিয়ে কাব্য প্রকাশনায় যাত্রা করলেও আশির দশক থেকে কবি ও কবিতার সাথে সম্পৃক্ত।

“মানুষ কেবলি বাঁক বদলায় প্রতিবেশী নদীর মতো”

আক্ষেপ আকুতি হৃদয়ের অনুভূতি সব মিশিয়ে তার কবিতা হয়ে ওঠে স্বপ্ন বাস্তবতার সেতুবন্ধন। যেখানে আবেগের সাথে মানবতা প্রেম, সততা পরম সহিষ্ণুতা সব মিলিয়ে কবি বলতে চায় পরম সত্যকে। প্রকাশ করতে চায় আন্তঃসাময়িক বিবেকের স্বপ্ন রথে চড়ে-

“একাকী কদম তুমি শুনেছো ঠিকই
ঘুরে দাঁড়িয়েছি, ফিরে তাকাবো না বলে”

আশির কাব্য জগতের একান্ত যাত্রী হয়েও প্রায় তিন দশক পর "প্রতিবেশী নদীর মতো" কাব্যগ্রন্থটি সুন্দর ও প্রবহমান শিরোনাম নিয়ে প্রকাশিত হয়। স্বপ্ন বাস্তবতা তাকে নানা ভাবে নাড়া দেয়। যা উৎস সন্ধানে আবেগের পরিণতি ধারণ করে সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়-

“জীবনের ভিড়ে খুঁজি আরেক জীবন
এ কোন জীবন আমি বয়ে যাই
জীবনের পিঠে।”

সাদাফ হাসনাইন মানজুর এর “প্রতিবেশী নদীর মতো" গ্রন্থে ভদ্রবেশী প্রতিবাদীতা রয়েছে চেতনায়। নানা দ্বন্দ্ব সংঘাত দ্রোহ-প্রতিবাদ প্রেম ও সুন্দর সব মিলিয়ে সুপাঠ্য একটি কবিতার গ্রন্থ। মুক্ত ছন্দের আদলে দৃশ্য সদৃশ্য বিশ্ব ও রহস্য সবটুকু কবিতায় প্রকাশ করার প্রয়াসী হয়েছেন-

“মানুষ তার নির্মাণ পথেই হাঁটে সারাক্ষণ”

মানুষই তার আরাধনা। মানুষকে ভালোবাসার আশা নিরাশা বৈপরীত্য ও একাত্বতা সবটুকুই প্রতিবেশী নদীর মতো প্রবহমান রাখার জন্য কবিতাকে করেছেন জীবনের সঙ্গী।

“তুমি কোমল হবে না জেনেও
আমি বারুদ ও ফুলের
যৌথ খামার করেছি মানবিক চাষ”

ছোট কাগজের সাথে সম্পৃক্ততা ও শুদ্ধ কবিতার চর্চা দিয়ে সাদাফ হাসনাইন মানজুর আশির দশকের লিটল ম্যাজাগিন আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন- চর্যাপদ ছোট কাগজের সহকারী সম্পাদক ও পরে প্রকাশক হিসেবে। কবিতার সাথে চির মিত্রতার সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছেন শুরু থেকেই। কবিতাও কবির প্রতি আবেগময় প্রেমও মানবতা তার কবিতায় উজ্জ্বল পঙ্ক্তিতে পরিণত হয়। যা হয়ে ওঠে পাঠক প্রিয়। প্রতিবেশী নদীর মতো গ্রন্থে বাঁক বদলের সত্যকে জাগ্রত করেছেন মানুষ হয়ে মানুষের বিবর্তন-

“শুভঙ্করের ফাঁকে সরল ছৈয়াল ঠকে
ঠকে যায় ম্যাক্রো হিসাব”

নগর জীবনের ক্লেদ গ্লানি আশা আকাক্সক্ষা যেভাবে এসেছে তেমনি ভাবে এসেছে গ্রাম সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ প্রসঙ্গ। বেদনা আনন্দ হতাশা অসারতা ও ব্যর্থতার স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে সাদাফ হাসনাইন মানজুর সত্য ও সুন্দরকে অবলোকন করেছেন সচেতন ভাবেÑ

যতবার হেরে গেছি, ততবার জিতেছি দ্বিগুণ,
একজন চলে গেছে, বহুজন দাঁড়িয়েছে পাশে”

প্রতিবেশী নদীর মতো কাব্যগ্রন্থে কবি দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করেন নি। বহুজাতিক মানুষের জীবনাচার প্রেম বিরহ স্বপ্ন আকাক্সক্ষা সব মিলিয়ে তিনি সকল মানুষের প্রতি প্রেম মানবতাকে প্রকাশের চেষ্টা করেছেন-

“মানুষের মতো পাখীরাও বড় বেশি বিস্মৃতিপ্রিয়
বৃক্ষ হতো উঁচুতেই থাকনা কেনো
শেকড়, তার নিজ প্রয়োজনে খুঁজে নেবেই নিশ্চিত মাটি”

দৃষ্টি ও সৃষ্টির মধ্যে আন্তঃনগর সংযোগ রয়েছে আজন্ম কাল থেকে। জ্ঞানী দার্শনিক কবি বৈজ্ঞানিক সাধক দূরদৃষ্টি দিয়ে আগামীকে সনাক্ত করেন। কবি সত্যদ্রষ্টা ফলে কবিতায় সত্যটুকুই ফুটে ওঠে।
সাদাফের কবিতায় রয়েছে অবাধ দেশ প্রেমের প্রেরণা। নদী মাতৃকতায় বেড়ে উঠবার কারণে তার কবিতা নগর ও গ্রামের চরম অনুভূতি গুলি দিয়ে মালা গাঁথেন স্বপ্নে । সাদাফ হাসনাইন মানজুর দেরি করে দীর্ঘ সময় নিয়ে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন। ফলে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও পরিপক্কতার আভাস পাওয়া যায় টোকাই ও রাতের পরী- কবিতায়-

“ভাতের মাড়ের মতো ঘন মেঘে ছাওয়া আকাশ
অঝরে ঝরছে প্রায় একশত বত্রিশ ঘণ্টা
নগরী কোমর জলে দাঁড়িয়ে সটান।
সব গাড়ী নৌকার মতো নিরানন্দ
পার হয় বাহান্ন খালের শহর”

জীবনের উজ্জীবিত উচ্ছ্বাসিত আবেগের প্রতিফলন থাকলেও কবির আন্তরিক অনুসন্ধানের চিত্র নানা মাত্রিকতায় ফুটে ওঠে-

“পূর্ণিমা বিবাগী হলে স্বদেশ ঘুমায় অমাবস্যার কোলে”

দেশ প্রেম সমাজ স্বজাতির প্রতি দরদের ইঙ্গিত রয়েছে তার কবিতায়। মমতাময়ী নামের আড়ালে কঠিন বাস্তবতাকে কবিতায় তুলে আনতে চেয়েছেন নিজের মতো করে। আবেগ বিবেক স্বচ্ছতা দৃঢ়তা তার কবিতাকে দিয়েছে নিজস্ব সত্তা-


“তুমি কি ঈশ্বর? ভাঙবে গড়বে প্রাণের ধরণ
কসাই স্বভাবে কেটে তিস্তার জীবন
গোপন বৈঠায় ভেঙ্গে পালের অহম
কার গাঙ বেয়ে গাও ভাটিয়ালি গান?”

প্রেমে প্রণয়ে বিচ্ছেদে সবটুকুকে তিনি খুঁড়ে দেখতে চান কখনো চির প্রেমিক হয়ে আবার হৃদয়হীন পাষাণের কঠিনতর উপেক্ষায় । দুটিকেই এক বৃন্তে প্রেমে ও অভিমানে কবিতায় বলতে চান অবদমিত বেদনার রথে চড়ে-

“শান্তি নাই প্রেম নাই, বাড়ন্ত ঘরে সবই উধাও
আমারে দিয়া দ্বিধার জীবন, পরাণ পাখি কই যাও”

ভ্রমণ পিপাসু এ কবি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতাকে কবিতায় নানা অনুষঙ্গ ও প্রসঙ্গে গভীর মমতা দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন।

“তোমাকে পড়িনি কোন কালে, পড়িনি তো সত্য
প্রকৃতি পড়েছি শুধু, প্রকৃতিই প্রকৃত সাহিত্য”

জীবন পাঠের নাট্যকার হয়েও তিনি প্রতি মুহূর্তেই কবিতার সাথে থাকার আকুতি-উৎপেক্ষা স্বভাবজাত নিজস্ব ব্যাখ্যার অন্তরালে বিশ্বাসকে স্থাপন করেন সচেতন ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে-

“দারুণ তোমার চাওয়া পাওয়া
এইতো আছো এইতো হাওয়া
চোখের জলে ভূগোলটাকে কিনতে চাওয়া”

উচ্চবিলাসী স্বপ্নের হৃদয়ে জীবনের সমূদ্বয় চাওয়া-পাওয়া, উত্থান-পতন, জয়-পরাজয় আবেগ-নিরাবেগের ঘূর্নীপ্রেমে সত্যকে সুন্দর মুখরোচক করে বলার কৌশল “প্রতিবেশী নদীর মতো” গ্রন্থে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।
কবিতাকে প্রাণ প্রধান হৃদয়গ্রাহী করে তোলার ক্ষেত্রে আরো যতœশীল হলে তার কবিতা উজ্জ¦ল স্বাক্ষর রাখবে আশাতীত ভাবে।

“ফ্রেমে বাঁধা, হাসি মুখ দেখো বলে
ভেবো না সূর্য পিছলে হলো সোনার মহর”

সাদাফ হাসনাইন মানজুরকে ,প্রকৃতপক্ষে কবিতাকে উপলব্ধিতার আবরণে নতুনভাবে নিজের মত করে বলার আগ্রহী হতে দেখা যায়-

“আমি সেই সব মৃত প্রেমিকের কবন্ধ পাঠে
শিখে নিই তোমাকে অবজ্ঞার কৌশল”

সময় অসীমতা, শব্দে সাহসীকতা তার কবিতার শরীরে প্রথিত। নিষ্ঠা ও ক্ষরণ কবিতাকে দিয়েছে অংলকার। উপমা উৎপ্রেক্ষো সত্যতা ও ব্যথতা সবটুকুই কবিতাকে করছে সমৃদ্ধ-

“আজো বোঝোনি তুমি
আমিও পারিনি বোঝাতে...
কোমলে কঠিনে কতটা ফারাক!”

প্রতিবেশী নদীর মতো কাব্যগ্রন্থে আশা ও ভালোবাসার আ্রজন্ম অনুভূতিকে গোপন ভাবে প্রকাশের চেষ্টা রয়েছে। তার চেতনাবোধ মানুষের সাধুবাদে মনোযোগী হতে দেখা যায় আন্তরিকভাবে।
সাদাফ হাসনাইন মানজুর প্রকৃত কবিতার সাথে আত্মীয়তা ও পথচলায় সচল থাকবেন এটাই প্রত্যাশা। প্রতিবেশী নদীর মতো কাব্যগ্রন্থটি সুপাঠ্য ও সংগ্রহের মতো।

প্রতিবেশী নদীর মতো
সাদাফ হাসনাইন মানজুর
প্রকাশকাল :একুশে বই মেলা২০১৫
প্রচ্ছদ :উত্তম সেন

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test