E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কবির জরায়ু থেকে উৎসারিত : নিকাশের দায় রেখে

২০১৫ নভেম্বর ১০ ২০:২৭:২০
কবির জরায়ু থেকে উৎসারিত : নিকাশের দায় রেখে

রণজিৎ সরকার : হানিফ রাশেদীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নিকাশের দায় রেখে’। এর সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়ে ‘জরায়ু’ শব্দটিই প্রথম মনে আসে। মনে আসে যৌনতার স্বাদ নেওয়া বা দেওয়ার জন্য নয়, জরায়ুর সেই বিশেষ দায়িত্বটি স্মরণ করা যা সন্তান ধারণ ও প্রসবের জন্য বহুকাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে সযত্ন ও অবহেলায়। এই দায়িত্বটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বা অগুরুত্বপূর্ণ তা মাথায় না রেখেও যদি জন্মদান প্রক্রিয়ায় এর দীর্ঘসময়কালীন বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রটি খেয়াল করি তাহলে যে সকল কবির কবিতার জন্মদানের প্রক্রিয়ার সাথে এর তুলনা চলে হানিফ রাশেদীন তাঁদের অন্যতম।

চল্লিশটি কবিতা এখানে স্থান পেয়েছে, এর জন্মদান প্রক্রিয়ায় রাশেদীন ব্যয় করেছেন প্রায় দশ বছর। কোনো কোনো কবিতা নিয়ে তিনি ভেবেছেন মাসের পর মাস; কোনো কোনো শব্দে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন অনেক সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত আর কবিতার বিষয়বস্তুগুলোর জন্য হয়ত ব্যয় করেছেন তাঁর সমস্ত কাব্যজীবনও- যার পরিধি হানিফ রাশেদীনের প্রথম অনুভব থেকে তাঁর ত্রিশ ছোঁয়া ব্যক্তিজীবন পর্যন্ত বিস্তৃত!

এই কাব্যজীবনে হানিফ কী দেখেছেন কবি হিসেবে, কী দেখতে চেয়েছেন, কী বুঝেছেন, কী পেয়েছেন, ব্যথায় কেমন হয়েছেন কাতর, প্রতিহিংসায় কতটা বিচলিত হয়েছেন, ভণ্ডামো দেখেছেন কোথায় কোথায়, কার অন্তসারশূন্যতা তাঁকে ব্যথিত করেছে, কতটুকু হটকারিতায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন তার সবই ধারণ করে হানিফের এক একটি কবিতা। কবিতাই যে কবির আত্মজীবনী হতে পারে এ কথা হানিফ রাশেদীনের কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায়। এখানে কোথাও নেই হানিফ রাশেদীন নামক কবির জন্ম থেকে বিকাশ, তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা, স্মরণীয়, বরণীয় মূহুর্ত। তাঁর কোথায় স্কুল, কোথায় পড়াশুনা, কোথায় তাঁর দৌড়, কোথায় তাঁকে দেখা যায়, কোথায় যায় না- এইসব কিছু না থেকেও কবির জীবনী কবিতায় ধারণ করা সম্ভব তার প্রমাণ হানিফের এই কাব্যগ্রন্থ।

মোটামুটি সাত রকমের কবিতাবলয়ে মোট চল্লিশটি কবিতা নিয়ে হানিফ রাশেদীনের এই কাব্যগ্রন্থ। এর মধ্যে যেমন একই সাথে সৌন্দর্যের জন্য শোকগাথা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সৌন্দর্যের রূপ বিনির্মাণ, আত্মোপলব্ধি যেমন, তেমন চারপাশের মানুষের বিদ্যমান যন্ত্রণা, হতাশা, ক্ষোভ, অসহায়ত্বরও উপলব্ধি আছে; আবার তার কারণ যেমন স্বল্পপরিসরে চিহ্নিত হয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রচন্ড আশাবাদের অভিব্যক্তি, সহযোদ্ধা হয়ে মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার স্পষ্ট উচ্চারণ; এখানে একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে কবির সরল অভিব্যক্তিতে বহুল শ্রদ্ধেয় ঈশ্বরের অন্তসারশূন্যতার আবার তেমনি কবির করুণার স্পর্শ পেয়েছেন অপ্রকৃত ঈশ্বর! আবার আবেগের পরিমিত পরিচলনে ব্যক্ত হয়েছে নিখাদ প্রেম- নর-নারীর দেহবিভক্ত প্রেম, আর মনপুষ্টকামনা; রয়েছে প্রচলিত সময়ের তির্যক সমালোচনা ও একটি কৃতজ্ঞতা।

বলছিলাম হানিফের কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে মোটামুটি সাত ধরনের কবিতাবলয় দেখতে পাওয়া যায়, আলোচনার সুবিধার জন্য প্রথমে বেছে নিলাম তাঁর সৌন্দর্য ও অসৌন্দর্যবিষয়ক কবিতাগুলো। ১০টি কবিতা হানিফের সৌন্দর্য ও অসৌন্দর্যবিষয়ক; এর মধ্যে একাধিক শিরোনামেই সরাসরি উল্লেখিত হয়েছে সুন্দর ও অসুন্দরের কথা, আর যেগুলোতে হয়নি তার নামগুলো, আরও বিশেষভাবে দৃষ্টি দিলে কবিতাগুলোর শরীরে তার অস্তিত্বের ছাপ রয়েছে। শিরোনাম হলো : গোলাপ; প্রতিচ্ছবি; বৃত্তের বাইরে; কবিতার স্তাবকতা; সুন্দরের জন্য শোকগাথা; প্রেম ও সৌন্দর্যে; অন্ধকারের উৎসব; অন্ধকারের গান; সুন্দরতম, তোমার জন্য; পৃথিবীর পথে। এবং আরো আশার কথা যে, চারপাশে যে সৌন্দর্য তিনি লক্ষ করেছেন, যা বাস্তবে থাকুক বা না থাকুক, কোনো কোনো কবি যেমনটি সমূহ সৌন্দর্য দেখতে পারেন সর্বত্র, হানিফের কবিতায় তেমন অন্ধের হস্তি দর্শনের মত কোনো সৌন্দর্য অবলোকন করা হয়নি! কবি খুব সচেতনভাবে করেছেন বলে মনে হয় না, কিন্তু একটি সুচাতুর্যের প্রমাণ দেয় এই কবিতাগুলো যে, আমাদের ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইলে কবির আকাক্সক্ষাকে পূর্ণ করতে পারে এমন সৌন্দর্য নেই!

দুর্বিষহ লজ্জায় ঘিনঘিন করে চোখ-
সর্বত্র দেখি নয়ছয়-রঙের প্রতিচ্ছবি।

প্রেমের গলিপথে ঘুরে বেড়াই আমি
যদি শুনতে পাই সুন্দরের প্রতিধ্বনি।
[সুন্দরের জন্য শোকগাথা]

কথাটা বিশেষ মনযোগের দাবি রাখে; হানিফকে বলতে হচ্ছে ‘যদি শুনতে পাই সুন্দরের প্রতিধ্বনি’, তার মানে বর্তমানে সৌন্দর্যের যথেষ্ট অভাব! কেবল কি বর্তমানেই, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে যখন জীবনানন্দকে লিখতে হয়েছে অদ্ভুত আঁধার এক, যখন বলতে হয়েছে ‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই/পৃথিবী অচল তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’ তখন কি জীবনানন্দ সৌন্দর্য লক্ষ করেছিলেন?
হানিফ যখন শোক করেনও না সৌন্দর্যের জন্য, যখন তিনি ‘গোলাপ’ নিয়ে কবিতা লিখেন, তখনও লক্ষ করা যায় যে, তিনি পুষ্পদ্যানে গোলাপ খুঁজে পান না :

এসেছি
গোলাপের খোঁজে
খুঁজে নিরন্তর
পুষ্পোদ্যান, অনিন্দ বিতান,
নন্দন কানন...
পেরিয়ে জোয়ারভাটা।

পাই নি একটি শোভন গোলাপ
আশাজাগা চোখে
এই পড়ন্ত বেলা
তোমার কাছে;

তবে না পেলেও এই সৌন্দর্য-অনুসন্ধান যে হানিফ ত্যাগ করেননি, এটি এই একবিংশ শতকের শূন্য দশকের বিশেষ এই কবির বৈশিষ্ট্য। সৌন্দর্যের স্বপ্নচারী এমন কবি যিনি বাস্তবে জেগে দেখুন না কেন যতো অন্ধকার, ‘ঘুম ঘুম চোখে’ ‘জানালার দিকে হেঁটে’ চলে দেখতে পান ‘অলৌকিক বাতাস’ তাঁকে ‘ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে’ :

রেলিং ধরে দাঁড়াতেই সীমাহীন বিস্ময়ে অভিভূত আমি
যতদূর চোখ যায় দেখি রঙবেরঙা ফুল বাগানে পরিণত ভূমন্ডল
আমি দেখতে পাই ভূমন্ডলের কোথাও নেই একটিও হায়েনা।
[অন্ধকারের গান]

এই সমস্ত কবিতার পরতে পরতে বাসা বেঁধে আছে সুন্দর, সুন্দর, সৌন্দর্য- সৌন্দর্যের জন্য এত হাহাকার এই সময়ে আর কোনো কবিকে করতে দেখা যায় না। এখন এই প্রশ্নটি নিশ্চয়ই গাঢ় হয়ে উঠেছে যে, এত সুন্দর সুন্দর, সৌন্দর্য সৌন্দর্য করছেন যে কবি, তিনি সৌন্দর্য বলতে আসলে কী বুঝেন তার কিছু কি তিনি তাঁর কবিতায় বলেছেন আমাদের? হানিফ রাশেদীনই বোধহয় সেসব স্বল্প কবিদের মধ্যে অন্যতম যিনি দাঁড় করিয়েছেন খুব স্পষ্ট করে তাঁর সৌন্দর্যের সংজ্ঞা; এবং কেবল একটি কবিতায় নয়, নয় কেবল সৌন্দর্য ও অসৌন্দর্যবিষয়ক কবিতায়, বরং সমস্ত কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রত্যেকটি কবিতায় ধরা দিয়েছে তাঁর কাক্সিক্ষত সৌন্দর্যবোধ। রোমান্টিকদের মতো তিনি কেবল অস্থির নন তার বর্তমান নিয়ে, বেদনায় দুলতে দুলতে, আবেগের দৌরাত্মে হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি বলেন না ‘কোথায় নিয়ে যাও মোরে হে সুন্দরী’, অথবা ‘এবার ফিরাও মোরে’, বরং তিনি ভালো করে জানেন তাঁর বর্তমানে সৌন্দর্যগুলো কেনো দূরবর্তী। ‘বৃত্তের বাইরে’ কবিতাটিতে দেখা যায় :

সূর্যকিরণের অন্তরালে ওঁৎ পেতে নেই কোনো অন্ধকার,
‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ বলে শ্লোগান নেই, বাতাসে
বারুদের গন্ধ কিংবা লাশের গন্ধ নেই, মৃত্যুকুপ নেই,
ভয় কিংবা প্রলোভনে আকৃষ্ট নয় আকাশ,...

কিংবা যদি আরো একটি কবিতাবলয়ের আলোচনায় অগ্রসর হই, যেখানে হানিফ ব্যক্ত করেছেন গণমুক্তির আকাক্সক্ষা : আমরা দেখব; কমরেড, সঙ্গে আছি; পথের গান; মানুষের ইতিহাস; ভেতর-বাহির; দেবদূতগণ; ওহে ভদ্র মহোদয়গণ; স্বপ্ন মাথা নোয়াতে জানে না এবং তাকাল সে এই ৯টি কবিতায়, সেখানে আরো স্পষ্ট হবে কবির সুন্দর-উপলব্ধির সংজ্ঞা। ‘আমরা দেখব’ কবিতায় :

আমরা দেখব, একদিন নিশ্চই দেখব
তুলোর মতো উড়ে যাবে শোষণের কারখানা

অথবা ‘কমরেড, সঙ্গে আছি’ কবিতায় :

দেখব, আমরা দেখব, অন্ধ ও বধির হয়ে যাবে না অনুভূতি;
মানুষের দৃষ্টি, কমরেড, নেকড়ে-দৃষ্টি ভেবে আর বিভ্রান্ত হবো না।

অথবা, ‘স্বপ্ন মাথা নোয়াতে জানে না’ কবিতায় :

এই সভ্যতা আমাদের উপহার দিয়েছে
শোষণের কারখানা, ক্ষুধা ও শীতে ধুকে ধুকে
নির্মম মৃত্যু, আমাদেরই বুক বিদ্ধ করার
মারণাস্ত্র দিয়েছে আমাদের;
কিন্তু না, পৃথিবীতে কোনো শোষণ থাকবে না,
নির্মম মৃত্যু থাকবে না, মারণাস্ত্র থাকবে না।

সুতরাং বোঝা যায় কবির সৌন্দর্য সেটিই যেখানে পুঁজির লুট নেই, শোষণ নেই, লাশের গন্ধ নেই, মৃত্যুকূপ নেই, ভয় নেই পীড়নের- এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো যেখানে সম্পদের সুষম বন্টন রয়েছে, নেকড়ে বা হায়েনারা বিভ্রান্ত করে না নানা অবৈজ্ঞানিক চিন্তায়।

‘মানুষের ইতিহাস’ কবিতায় হানিফ রাশেদীনের সৌন্দর্যবোধ আরো স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে আমাদের সামনে, যখন আমরা তুলনামূলক দুটো দৃশ্যকল্প অবলোকন করি। যেখানে ‘আমাদের প্রতিদিনকার গল্পে’ শিশুদের ঘুম না আসলে ভূতপেত্নির ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ান হয়, এর বিপরীতে তিনি দেখান ‘আমাদের না-দেখা দিনের গল্পে’ শিশুদের যখন ঘুম আসে না তখন তাদের ‘সুন্দরী ঝর্ণার’ গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ান হয়। একদিকে ‘ফুল ফোটান শেখাতে’ শিশুদের যত্নবান করানো হয় অন্যদিকে অভ্যস্ত করানো হয় সবকিছুতে ‘প্রথম হয়ে ওঠার ষোলকলা’ শিখতে।

অসামান্যভাবে, নিতান্তই ছোট পরিসরে, এমন তির্যকভাবে মানুষের বিকাশের করুণ ইতিহাস দেখিয়েছেন হানিফ রাশেদীন, যেটি পড়ার পর আমরা নিশ্চই বুঝতে পারি কবি কী প্রত্যাশা করেন, এবং শিশুর ক্ষেত্রে সুন্দর বলতে তিনি কী বুঝেন।

এই প্রসঙ্গে আরো একটি কবিতাবলয়ে প্রবেশ করা যেতে পারে, যার ৬টি কবিতা ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব বিষয়ক; কবিতাগুলো হলো : চাওয়া-পাওয়া; বৈষম্য; ঈশ্বরের মৃত্যু; ক্ষতচিহ্ন; ঈশ্বরের স্বর্গবাস এবং ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি।

এই কবিতাগুলো পড়ে আমাদের শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, সৌন্দর্যের জন্য কল্পিত ঈশ্বরও ভয়ানক প্রতিবন্ধক। কবিতাগুলোতে, অসামান্যভবে, বেচারা ঈশ্বরের উপর পরিহাস ধরা পড়ে। ধরা যাক ঈশ্বরের মৃত্যু কবিতাটি। এর মূল বক্তব্য হলো, আপেল খাওয়ার অপরাধে ঈশ্বর যখন আদম-হাওয়াকে স্বর্গোদ্যান থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেন পৃথিবীতে, অত্যন্ত মনযোগের সাথে ঈশ্বর দেখতে পান যে, তারই সৃষ্টি মানুষ সৃষ্টি করছে আগুন তার সাহায্য ছাড়াই, এবং একে একে জন্মাদন থেকে শুরু করে আরো নানা ‘সৃষ্টির আবেশে’ মজতে মজতে ঈশ্বকে চতুর্থ শ্রেণির স্রষ্টায় রূপান্তরিত করে ফেলছে, তা দেখে :

ঈশ্বরের মুখখানা অদ্ভুত রকমের কালো হয়ে এল, করুণ চোখে তিনি
একবার তাকালেন নিজের আসনের দিকে, একবার পৃথিবীর দিকে!

কী অসাধারণ পরিহাস ব্যক্ত হলো কেবল ৮টি মাত্র পঙক্তির এ কবিতায়, এবং বড় কথা হলো এখানে ঈশ্বরও কিছুটা করুণাও লাভ করলেন কবি হানিফ রাশেদীনের কাছ থেকে! যখন আমরা পড়ি যে, ঈশ্বরের মুখ কালো হয়ে পড়লো, এবং তার চোখ হয়ে পড়লো করুণ, তিনি নিজের আসনের দিকে সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন এবং আরেকবার তাকাচ্ছেন পৃথিবীর দিকে তখন আসলে বেচারা ঈশ্বরের প্রতি নিরীশ্বর আমরাও করুণা বোধ করতে থাকি!

শুধু এই কবিতায় নয়, ঈশ্বরের প্রতি করুণা ও তার অবস্থার প্রতি সমবেদনা আরো একটি কবিতায় ঈশ্বরের স্বর্গবাস-এ প্রচন্ডভাবে ব্যক্ত হয়েছে, ঈশ্বরের ট্রেজিক পরিণতি এত মমতায় বোধহয় খুব বেশি দেখানো হয় নি কোথায়ও। এর আখ্যানটি হচ্ছে যে, একবার ঈশ্বর স্বর্গ ও নরক দেখবেন বলে স্থির করেছেন, তিনি দেখতে চান পৃথিবীতে তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যারা স্বর্গে এসেছেন তাদের কেমন অবস্থা এবং যারা তা করেননি তাদেরই-বা অবস্থা কী। ঈশ্বর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গসহ অর্থাৎ জিব্রাইলসহ প্রথমে স্বর্গে যান এবং-

প্রবেশমাত্র নাক চেপে ধরলেন প্রভু- ‘কী ব্যাপার! কোথা এলে?’
‘কেন!- বললেন জিব্রাইল- আমরা তো স্বর্গেই এসেছি...’
‘দেখ, ভুল কর নি তো!’- বিস্ময়ভরা কণ্ঠে ঈশ্বর!

তারপর জিব্রাইল বের হয়ে বাইরে ফলকে স্বর্গোদ্যান লেখা দেখে বললো, না ঠিকই তো আছে প্রভু। সে কথা শুনে-

...ঈশ্বরের চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ!

তারপরও ঈশ্বর ভেতরে প্রবেশ করলেন দুর্গন্ধর খোঁজ করতে করতে, এবং-

খেজুরগাছ তলায় দেখতে পেলেন কুৎসিত এক ভূত
কাছাকাছি যেতে যেতে মনে হল ভূত নয়-
উপরের দিকে চেয়ে হাঁ-করে আছে একজন মানুষ
গায়ে তার পিঁপড়ে ও মৌমাছির বাসা;

তারপর লজ্জায় বিব্রত হয়ে, ‘মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর মতো’ চোখে সীমাহীন অন্ধকার নিয়ে বের হয়ে পড়েন স্বর্গ থেকে, আসেন নরকে-

‘নিজের চোখকেও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না...’
ছোট্ট একটা দীর্ঘম্বাস ছেড়ে বললেন ঈশ্বর!
নমনীয় চোখে তাকালেন জিব্রাইল;
ঈশ্বর নন, এ যেন নদী ভাঙ্গনে সর্বস্ব হারানো দঃখে
ভেঙে পড়া মানুষের কণ্ঠস্বর-
‘এখানে না আগুন জ্বলার কথা, মিষ্টি বাতাস এল কীভাবে?’
চারিদিকে তাকালেন জিব্রাইল, কী যেন ভাবলেন-
‘হ্যাঁ, কিছুই তো ভালো ঠেকছে না!’
করুণ হয়ে এলো জিব্রাইলের নিস্পাপ মুখখানা।

তারপর হচকিত ঈশ্বরকে অভিবাদন জানালেন সক্রেটিস, ঈশ্বর দেখতে পেলেন এখানে সেই সবকিছু যা তিনি স্বর্গের জন্য কল্পনা করেছিলেন; তিনি এখান থেকেও বিব্রত হয়ে, যেতে উদ্যত হলে, নরকবাসীরা তাকে উপর্যুপুরি অনুরোধ করে একদিনের জন্য থেকে যেতে, ঈশ্বর খুশি হয়ে থেকে যান এবং ওইদিন আতিথেয়তা গ্রহণকালে সন্ধায় দেখেন যে, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং গান পরিবেশন করছেন, পৃথিবীর অনিন্দ্য নৃত্যগীতবিদূষীরা গান ও নাচ পরিবেশন করছেন, এবং অতঃপর :

প্রাণের আবেশে শিউরে উঠলেন ঈশ্বর, ভিজে এল চোখ;
জিব্রাইল ঘাবড়ে গেলেন, অপরাধীর মতো নিচু গলায় বললেন-
‘হুজুর, আপনি কি এখন যাবেন?’
ভুল করা লোকের মত চোখ তুলে তাকালেন ঈশ্বর-

তারপর শেষে জিব্রাইলকে আদেশ করলেন স্বর্গের ফলকটি নরকে এনে লাগাতে এবং নরকের ফলকটি তুলে নিয়ে স্বর্গে লাগিয়ে দিতে!

এই যে আমরা ঈশ্বরের স্বর্গবাস কবিতাটি দেখলাম, তাতে যে পরিশোধিত ঈশ্বরকে দেখতে পাই, তা সৃষ্টি করতে হানিফ রাশেদীনকে যথেষ্ট মমতা দিয়ে ঈশ্বরকে চিত্রিত করতে হয়েছে, যাতে আমরা নরকে থাকা সক্রেটিস ও রবীন্দ্রনাথের মতো কবি হানিফকেও একই মহত্ত্বে উৎভাসিত হতে দেখি। ঈশ্বর যে করুণাময় তা তো আমরা কোনো প্রমাণ না পেলেও শুনে আসছি, কিন্তু কোনো কোনো লেখকও যে করুণায় ঈশ্বরকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন তা এই কবিতা পড়ে আমাদের মনে হয়।
হানিফ রাশেদীনের ঈশ্বর সম্পর্কিত কবিতাগুলো প্রতিটিই যথেষ্ট চিন্তাসমৃদ্ধ যা ঈশ্বর ও স্বর্গসম্পর্কিত ধারণাগুলোর অন্তসারশূন্যতাকে উন্মোচিত করে এবং পাশাপাশি স্থাপন করে এমন মূল্যবোধ যা কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ, চিন্তাশীল মানুষ, অনুসন্ধিৎসু মানুষের উপলব্ধির কথা। ‘ক্ষতচিহ্ন’ কবিতায় তেমনি একটি বিষয় উঠে এসেছে যেখানে হানিফ দেখচ্ছেন, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক পুরুষ স্বর্গে গিয়ে ভোগ করছে হুর-পরী, তার কোনো ‘এইডসের ভয় নেই, সিফিলিসের ভয় নেই’, কিন্তু তার স্ত্রী স্বর্গে গিয়ে কেবল নিজের স্বামী পাওয়ার কথা থাকলেও তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না তার প্রিয় স্বামী, আর স্বামীকেও যদি সে না পায় তাহলে ঈশ্বর কি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলো নারীর জন্য?

শ্রদ্ধেয় ঈশ্বর, কোথায় সেই অবতার! বলেছিল-
এ-জনমে কোথাও হাহাকার থাকবে না।

এর উত্তর কে দেবে আসলে? এরকমই আরো একটি প্রশ্ন উঠে আসে ঈশ্বর সম্পর্কিত অন্য একটি কবিতায়, যার নাম ‘ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি’ :

প্রার্থনার জন্য মা আমাকে বকতেন, আমি বুঝতাম না-
সামান্য এক মানুষ আমি, কী আসে যায় আমার প্রার্থনায়!
আমাকে দেখে যেমন কোনো বানর ভেংচি কাটলেই-বা কী!
আমার পরম আনুগত্যের সাথে সালাম দিলেই-বা কী!
তাতে কি পাটক্ষেতে ধান হয়, নাকি মরুভূমিতে ফুল ফোটে!

সত্যিই মরুভূমিতে ফুল ফোটে না ঈশ্বরকে প্রার্থনা করলে, পাটক্ষেতও ধানক্ষেত হয় না; কিন্তু তা সত্ত্বেও এগুলো ফলাতে দিয়ে শুধু শুধু তাকে টেনে আনা যে কতটা অবৈজ্ঞানিক, তাই ব্যক্ত করেছেন কবি হানিফ রাশেদীন এখানে। আমরা প্রায় দেড়শ বছর আগের, অক্ষয়কুমার দত্তর সেই বিখ্যাত সমীকরণটির কথা জানি : কাজ + প্রার্থনা = শষ্য; যদি কাজ = শষ্য হয়, তাহলে প্রার্থনা = ০; সুতরাং এটা স্পষ্ট যে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য বা তার প্রশংসা জাগতিক কোনো কাজেই ফল বয়ে আনতে পারে না, আনতে পারেনি কখনো যা মানুষের মঙ্গলে আসে; পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থ কোনো রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারে নি এ পর্যন্ত, সামান্য পাতলাপায়খানা যা কেবল জল ও সামান্য লবণেই সেরে ওঠে-তাও কোনো ধর্মগ্রন্থ বলে দিতে পারলো না লেবরেটরিতে তার উদ্ভাবন হওয়ার আগে! বরং ঈশ্বরের ব্যাখ্যাকারীরা ঈশ্বরকে নানা রকমের স্ববিরোধী ব্যাখ্যায় এমন লোভী, স্বার্থপর, নীচ, হটকারী, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী- এক কথায় এমন একটি নোংরা ভাবমূর্তিতে পর্যবসিত করেছে, যার প্রতি শেষ পর্যন্ত কোনো বিবেকবান, চিন্তাশীল মানুষ শ্রদ্ধা ধরে রাখতে পারেন না! এখানে বরং বলা যায় কবি হানিফ রাশেদীন ঈশ্বরকে যেমনটা সংশোধিত করে নিয়েছেন সমবেদনায় তাতে তার ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বলই হয়ে উঠেছে।

ঈশ্বর প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আসা যাক ‘নিকাশের দায় রেখে’তে স্থান পাওয়া বাক্তিপরিত্রাণের চেষ্টাবিষয়ক কবিতার আলোচনায়। এখানে মোট চারটি কবিতা : হানিফ রাশেদীন; হাঁটতে থাকা; রোদ এবং আত্মার গান।

এই কবিতাগুলোতে হানিফ ব্যক্ত করেছেন কেবল নিজেকে নিয়ে লেখা অনুভূতি ও চিন্তারাজি; এখানে কখনো বহু পথের মধ্যে কোন পথকে বেছে নিবেন বলে ভাবছেন তার বর্ণনা রয়েছে, কখনো অন্যের প্রভাবে নিজেকে কীভাবে আবিষ্কার করছেন, আবার নিজেকেই-বা ভালোবাসছেন কেমন তারও বর্ণনা। নিজের নাম হানিফ রাশেদীন দিয়েই লেখা কবিতাটি দেখা যাক :

তুমি, তোমার চোখ, চোখের বিস্তৃতি!
আহা, কী সুন্দর গান তুমি গাও
হলদে রঙ মুছে রাঙাও সবুজ রঙ।
* * *
কে এমন হৃদয়-সমান হতে পারে-
অনুভব করতে পারে ফাগুনের দিন?

অথবা ‘হাঁটতে থাকা’ কবিতা :

ক-ত পথ! কোন পথে-চিহ্ন-আমার পথের-
কি কি কুড়িয়ে তোলার আর কি কি ফেলে দেবার?

এখানে খুব স্পষ্ট বোঝা যায় কবি হিসেবে কতটুকু সচেতনভাবে নিজের পথকে বেছে নিয়েছেন হানিফ, কবিতার জগতে তাঁর বিচরণ কতটুকু স্থির।

এমনকি তিনি যখন প্রেমের কবিতা লেখেন তখনও তিনি কামনায়, আবেগে স্থির! তবে হানিফের কবিতা অবশ্য কামমুক্ত, শরীর এখানে একবারেই নেই, শরীরের যে অংশের প্রমাণ এখানে আছে সেটা হলো কেবল হৃৎপিন্ড। এটি যে কারণে হয়ে থাকতে পারে বলে মনে হয়, তা হলো প্রণয়অভিজ্ঞতার অভাবই হানিফের কবিতায় কবি হানিফকে স্থির রাখতে পেরেছে; পরিমিতিবোধ কিংবা প্রেমের দার্শনিক বোধ যা প্রেমে কাম আসতে বাঁধা দেয়, যাকে অন্যকথায় আমরা প্লেটনিক বলে জানি তার প্রভাব এখানে পড়েনি। যে বৈষ্ণবপদালীর প্রভাব হানিফের কবিতায় দেখা যায়, যেখানে জীবাত্মা ও পরামাত্মার মিলনের কোনো কোনো অংশে তাঁর কবিতায় উঠে আসে, এমনকি কৃষ্ণের বাঁশিও; তবুও অভিজ্ঞতার অভাব হানিফের কবিতায় প্রেমের পূর্বরাগের অতিক্রম করতে দেয়নি। পূর্বরাগ-সম্বলিত কবিতার জন্য কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ে না, পুরুষ মাত্রই সে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, কারণ তার জন্য প্রেমাষ্পদকে কাছে পেতে হয় না, দূরে দূরে থেকে নিবিড় মনযোগে ভালোবেসে যাওয়া যায়, এমনকি যাকে ভালোবাসলাম তার জানারও দরকার পড়ে না সেটি! কিন্তু পূর্বরাগের অতিক্রম করেই যখন অনুরাগে উভয়ে অগ্রসর হয়, শরীরে তখন শরীর স্পর্শ করেই, তা যতো প্রাগৈতিহাসিক শরীরই হোক না কেন, হোক না কেন মহাভারতের প্রচন্ড বিশ্বমিত্র। আর শরীর যখন কাছে আসে প্রেমের উপকরণগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া যতটাই হয়, কবিতাতে তার প্রবেশ ততটা ঘটে। এই আলোকে তৃতীয় শ্রেণির কবিও প্রথম শ্রেণির অনুরাগপর্বের কবিতা লিখতে পারেন; কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব প্রথম শ্রেণির কবিকেও কেবলই হৃদয় বা হৃৎপিন্ড পর্যন্ত ঘুরাফেরা করায়, যেমনটা হানিফ রাশেদীনের ক্ষেত্রে ঘটেছে! তবে প্রশংসার কথা এই যে, যা অভিজ্ঞতায় নেই তা নিয়ে তিনি কবিতা লিখতে সাহসী হন নি, বরং পূর্বরাগে যতটুকু প্রেম দানা বাঁধে তা সম্বল করে একাধিক প্রেমের কবিতা হানিফ লিখে গেছেন। এমন কবিতা রয়েছে আটটি : পরম্পরা; সখ্যতা; অনুভব; মানুষকে ছুঁতে পারা; প্রাণের স্পন্দন; ছাড়াছাড়ির পরে; তুমি আমি এবং বিয়োগব্যাথা। যার মধ্যে মানুষকে ছুঁতে পারা ও বিয়োগব্যাথা কবিতা দুটি মানবপ্রেমের আধারে লেখা।
এখন উপরের বক্তব্যটি প্রমাণের জন্য প্রথমেই দেখা যাক ‘প্রাণের স্পন্দন’ কবিতাটি, যেখানে প্রেমিক কবি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে (এটা কবি বলছেন), হয়ত প্রেমিকার বাসার সামনে দিয়ে যেতে যেতে (আমি যা ধারণা করছি) অনুভব করছেন :

তোমাকে দেখার পর থেকে
সুস্মিতা, টের পাচ্ছি প্রাণের স্পন্দন।

পাঠক নিশ্চই এতক্ষণে খেয়াল করেছেন কবি প্রেমের কোন পর্যায়ে থেকে এই কবিতা লিখার অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করেছেন!

আরেকটি কবিতা ‘তুমি আমি’ দেখা যাক :

এখানে আলো নেই
এখানে অন্ধকার নেই
এখানে আশা নেই
এখানে জ্ঞান নেই

এখানে এমন অনেক কিছু নেই বলে কবি শেষে বলছেন যে,

এখানে
শুধু তুমি আর আমি

বোঝা যাচ্ছে নিশ্চই কবির প্রেমের অবস্থা! অবশ্য অনেকেই মনে করেন যে, প্রেমের সকল স্তরের মধ্যে পূর্বরাগই সবেচেয়ে মধুর ও অনুভব্য লাগে আমাদের কাছে, কিন্তু তাই বলে কোন মানবীয় প্রেমিক-প্রেমিকা সেখানেই টিকে থাকতে চায় আজীবন?
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে হানিফের কবিতা পড়ে যেখানে আমরা বুঝতে পারলাম তাঁর প্রেম কেবল পূর্বরাগেই সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে যখন হানিফকে ছাড়াছাড়ির পরে কবিতাটি লিখত দেখা যায়, মনে ধন্দ জাগে যে, সেটি তাহলে কীভাবে সম্ভব হলো! প্রেম না হতেই ছাড়াছাড়ি? হানিফ এখানে প্রেমবর্হিভূত এমন কোনো সম্পর্কের ইঙ্গিত দিচ্ছেন কিনা ঠিক জানি না, যার সাথে সম্পর্ক হয়েছিল কবির, কিন্তু প্রেম না হতেই ছাড়াছাড়ি হয়ে পড়লো!
আসলে আরো একটু গভীরের অভিজ্ঞতা থাকলে আমরা হানিফের কাছ থেকে অনুরাগপর্বে কিছু অনবদ্য কবিতা শুনতে পারতাম যে অনবদ্যতার ছাপ তাঁর অন্য অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা কবিতায় শুনেছি, সেই জন্য এত কথা বলা, এত আপত্তি।
এ প্রসঙ্গে অভিজ্ঞতা থাকলে একটি কবিতা কত চমৎকার হয়ে উঠতে পারে তার আলোচনাটি করে নিতে চাই; কবিতার নাম ‘বিয়োগব্যাথা’; মায়ের সাথে একটি পরিবারের সম্পর্ক উঠে এসেছে এ কবিতায় এবং সেই মায়েরই মৃত্যুর পর তার অভাবটি কতটুকু অনুভূত হচ্ছে তা নিয়ে। মায়ের অনুপস্থিতিতে সন্তানের মায়ের সাথে কাটানো মুহূর্ত কীভাবে মনে পড়ছে সেই অবস্থাটা এখানে তুলে ধরছি, এবং মনে রাখছি যে হানিফ রাশেদীনের মা আছেন, কাজেই মায়ের সাথে প্রেমপূর্ণ সম্পর্কের অভিজ্ঞতাটিও তার রয়েছে:

প্রতিদিন অফিসে যেতে আমি থমকে দাঁড়াই-
আমি বলতাম ‘যাই’, তুমি বলতে ‘যাই’ না, ‘আসি’;
‘আসি’ বললে বলতে ‘এসো’, আমি ফিরে আসতাম,
মৃদু হেসে বলতে ‘আসলে যে’; আমি বুজতাম না।

এই যে কেবল চারটি পঙ্ক্তি, তাতে মায়ের যত্নের এবং সব কিছুতে সন্তানকে শেখানোর এমন একটি প্রবণতা ধরা পড়েছে যে, হুবুহু এই ঘটনাটির অভিজ্ঞতা কারো যদি নাও থাকে, এর কাছাকাছি অভিজ্ঞতা অবশ্যই থাকবে- যার মা আছে তারই- যদি তার কাছে সে কিছুদিনের জন্যও প্রতিপালিত হয়ে থাকে তাহলেই। তাই এখানে হানিফ, তার মা বেঁচে থাকলেও, মায়ের মৃত্যু কল্পনা করে একজন মা-হারা সন্তানের অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছেন অসামান্যভাবে।
কিন্তু ঠিক এই একই কবিতায়, যে-স্থলটিতে হানিফের অভিজ্ঞতা নেই, সেটির বর্ণনা হানিফ যখন দিয়েছেন সেটি কেমন হয়েছে দেখা যাক : এটি সেই মা-হারা সন্তানের পিতার, যিনি সদ্য স্ত্রী হারিয়েছেন :

বাবা ইদানীং প্রতিদিনকার নাওয়া-খাওয়া ভুলে যান
কেমন করে যেন অনেক দূরে তাকিয়ে থাকেন-

এখানে সন্তানের পিতার অভিব্যক্তিটি খেয়াল করবার মতো- অনেকটা টাইপধর্মী, অনেকটা নাটকের মতো, বা সিনেমার মতো;- বেদনায় দূরে তাকিয়ে থাকা-নাটক-সিনেমায় বা টাইপধর্মী লেখার বেদনাসঞ্চারী দৃশ্য হিসেবে এটি বহুল ব্যবহৃত এবং বহুল প্রথাগত ও বহুল সফল একটি উদাহরণ;- কিন্তু সবক্ষেত্রে বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি বাস্তব নয়, যেমন বাস্তব নয় সকল ক্ষেত্রে আনন্দের চিহ্নায়ক হিসেবে হাসিকে নিদর্শন হিসেবে দাঁড় করা। লেখক যদি আনন্দ বা বেদনার বা ভাব-অভিব্যক্তির টাইপধর্মী বৈশিষ্ট্যগুলোতেই বারবার ঘোরপার খান, বা ধরতে না পারেন এগুলো ছাড়া আবেগ-বেদনা-আনন্দের আরো বৈচিত্র্যধর্মী প্রকাশ, যা মানুষ অজান্তেই প্রকাশ করে থাকে, বা স্বতস্ফূর্তভাবে করে থাকে, তাহলে সেই লেখক তিনি সাহিত্যের যেই আঙ্গিকেই লেখুন না কেন নিজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারবেন না, এবং উন্নত মাত্রার শিল্পও সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হবেন। অবশ্য এই কবিতায় হানিফ অনেকটা সফল হয়েছেন এই কারণে যে, তিনি আমাদের সম্পর্কগুলোর মাঝের এমন একজন মানুষের বিয়োগব্যাথা টেনেছেন, যা কেবল অস্তিত্বগত কারণেই আমাদের পরম আপন। সুতরাং কাব্যগত ত্রুটি থাকলেও, কেবল আবেগের তাড়নায়, কবিতার বক্তব্যের বেদনায় আমরা মুছড়ে পড়তে প্রস্তুত। কিন্তু মৃত্যুটি যদি মায়ের না হয়ে, অন্য কোনো সম্পর্কের হত, যদি বিমাতার হতো, তাহলে এই ত্রুটি শুধু নয়, ত্রুটিমুক্ত পঙ্ক্তিকেও তার ধারেকাছের এমন আবেগ সৃষ্টি করতে বেগ পেতে হতো! সুতরাং সাহিত্যে অভিজ্ঞতা একটি অমূল্য ব্যাপার।
আর তিনটি কবিতা আলোচনা করেই আমরা এই আলোচনা শেষ করতে চাই; দুইটি কবিতা বিদ্রুপাত্মক : গোলটেবিল বৈঠক ও বুদ্ধিজীবী এবং একটি প্রসস্তিমূলক : হুমায়ুন আজাদ, তাহলেই হানিফ রাশেদীনের এ কাব্যগ্রন্থের সাতটি কবিতা বলয় আলোচনা আমাদের সম্পন্ন হবে।
‘গোলটেবিল বৈঠক’ ও ‘বুদ্ধিজীবী’ কবিতা দুটোর নামেই বোঝা যায় কবিতাগুলো কোন ধরনের হবে, কারণ এই দুইটি অভিধান সাধারণত আমরা তখনই ব্যবহার করি যখন যথাক্রমে আমরা মনে করি কোনো বৈঠক শেষে শেষ পর্যন্ত কিছুই ফলপ্রসূ হবে না, এবং সমাজের তথাকথিত হর্তাকর্তা, তিনি কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেন, তিনি কোনো এনজিওর পরিচালক হতে পারেন, তিনি লেখক হতে পারেন, তিনি আইনবিশারদ হতে পারেন, বয়স্ক সাংবাদিকও হতে পারেন, তবে তিনি যাই হোন না কেন, মূল কথা হলো তিনি সমাজের সুবিধাভোগী, কখনো সরকার বা কখনো সরকারবিরোধী দলগুলোর অর্থায়নে বা প্রদত্ত সুবিধা ভোগ করেন, বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং তার বুদ্ধি সমাজের কোনো মঙ্গলে আসে না। হানিফ দুটি স্বতন্ত্র কবিতায় এ দুই বিষয়ের চিত্রটি তুলে ধরেছেন অত্যন্ত হাস্যরসাত্মকভাবে। যদিও বুদ্ধিজীবী ও গোলটেবিল বৈঠক একটা আরেকটার পরিপূরক, এদের একটি ছাড়া অন্যটির কার্য ঠিকভাবে সম্পাদন হয় না, এবং এদের যে কোনো একটির চরিত্র বুঝতে পারলে, অন্যটির চরিত্র আলাদা করে বুঝবার প্রয়োজন পড়ে না! বুদ্ধিজীবীরাই গোল টেবিল বৈঠক করে রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করেন এবং লুটপাটের আয়োজন করেন।
বার্গার খেতে খেতে, টেবিলে রাখা ফুলের পাপড়িতে সুগন্ধি ছড়াতে ছড়াতে যেখানে আহ্বায়কের সময় কাটে, এবং আলোচনায় এত জনের এত তুচ্ছ প্রসঙ্গে টেবিল ফাটিয়ে দিতে থাকেন, ভাবগাম্ভির্যের সাথে যদিও, কবিকে তাই মনে করিয়ে দেয় রূপকথার গল্পের সতিনদের ঝগড়ারকথা কথা :

...মনে পড়ে আগেকার দিনের সতিনদের মাঝে কী
ঝগড়া হত!...
[গোলটেবিল বৈঠক]

কার্যত বৈঠকগুলো এমনই হয় যাদের এরকম দু-একটা বৈঠক দেখার অভিজ্ঞতা আছে তারা ঠিকই জানেন এর চরিত্র। যেমন জানেন বুদ্ধিজীবীদের :

সূক্ষ্ম হাতে কয়েকটা বই
পাতায় পাতায় রাজ্যের পোকা,
ধূলো, শতচ্ছিন্ন ইতিবৃত্ত...
টেবিলে বসামাত্র পদশব্দ;
কপালে ভাঁজ!
এবার দরজা করে লক, প্রস্তুতি-
বিয়োগকে যোগে রূপান্তর বিষয়ে
বক্তৃতা দিতে হবে আগামীকাল।
[বুদ্ধিজীবী]

সম্পূর্ণ কবিতাই তুলে দেওয়া হলো এখানে। একটি বিশেষ বিষয় বোঝাতে যে, হানিফের কোনো কোনো কবিতায়, ছোট ছোট বর্ণনায় চিত্রকল্প কতো অনবদ্যভাবে ধরা পড়ে যা অনেক লেখার পরিধি কমিয়ে আসে স্বাভাবিকভাবে, অথচ বক্তব্য প্রকাশে কোথাও বাধা সৃষ্টি করে না। লক্ষ করা যাক উপরের কবিতাটির পঞ্চম পঙ্ক্তিটি ‘কপালে ভাঁজ’, কেবল দুটি শব্দে একটি পঙ্ক্তি সম্পন্ন এবং একটি চিত্রও ফুটে উঠলো বুদ্ধিজীবীর তথাকথিত শরীরী বিদদ্ধ-সাজের, আর চরিত্রটি ফুটে উঠলো আরো একটি ছোট্ট পঙক্তিতে ‘বিয়োগকে যোগে রূপান্তর বিষয়ে’ বক্তৃতা দিতে হবে তাকে!
এমনই ছোট ছোট বর্ণনায় প্রায় সবগুলো কবিতা হানিফ বর্ণনা করেছেন, এবং হানিফ এভাবেই তাঁর কবিতাগুলো বর্ণনা করে থাকেন; তাই তাঁর কবিতাগুলো হয় বেশ সংহত-বিশেষ করে চার পঙক্তির, আট পঙক্তির; আর যেগুলো এক পৃষ্ঠার হয়ে থাকে তার প্রস্থ পরিসর তিন থেকে চারটি শব্দের বেশি সাধারণত হয় না। এতেই বোঝা যায় অনেককে অল্পতে বাঁধার এক বিশেষ চেষ্টা থাকে হানিফের, যার জন্য হানিফ এক একটি কবিতা লিখতে পার করেন বহু সময়; কোনো কোনো শব্দ নিয়ে তিনি ভাবেন দিবা ও রাত্র।

এই বিশেষ গুণটির জন্য হানিফকে কবির সাথে সাথে কর্মীরও সম্মান দেওয়া দরকার। দুই পাশে সমান বা একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে মাঝখানে তার লেখাগুলো সাজিয়ে লিখেন বলে নয়, কিছু নির্দিষ্ট পঙক্তি পর পর তিনি মিলের বিন্যাসগুলোকে বদলে ভেঙে গড়েন বলে নয়; পয়ারের সীমাবদ্ধতাকে গুড়িয়ে তার মধ্য থেকে অস্পর্শের শরীর কাঠামোতে তিনি ভাস্করের শ্রমে পাথর খুদাই করার মতো শব্দগুলো শাণিত করেন, চিত্রিত করেন এবং এভাবে তাঁর চারপাশের বিচিত্র অনুভবকে কবিতার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেন, তাঁর বোধের সাথে সমান্তরাল করে নিয়ে, যেখানে কবিত্বের সাথে যোগ হয় এক সার্বক্ষণিক কর্মীর চেষ্টাও।

এখন ‘হুমায়ুন আজাদ’ কবিতার প্রসঙ্গে আসা যাক। কবিতাটি প্রশংসামূলক। আর প্রশংসাটি কবির বিশেষ এই কারণে যে কবি হিসেবে হানিফ বিশেষভাবে ঋণী এই কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিকের কাছে। প্রাবন্ধিক হুমায়ুন আজাদের কাছে হানিফের ঋণ- তাঁর প্রবন্ধ হানিফকে চিন্তা করতে সাহায্য করেছে সংস্কারমুক্তভাবে। যা কিছু অন্ধকার মনে করেছেন হানিফ তাঁর কবিতায়, তা হুমায়ুন আজাদও অন্ধকার মনে করেছেন তাঁর কবিতাতে। হুমায়ুন আজাদের সৌন্দর্যের আকাক্সক্ষা ধরা পড়ে তাঁর চারপাশের সমালোচনার দিকগুলোর দিকে খেয়াল করলে, যা কিছু অসুন্দর, আপত্তিকর বা যেখানে সৌন্দর্য তিনি কামনা করেন, হুমায়ুন আজাদ তাই তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন, করেছেন উপন্যাসেরও। হানিফও তেমনি তাঁর সৌন্দর্যের সংজ্ঞাগুলো স্থির করেছেন অসুন্দরকে চিহ্নিত করেই, তবে হানিফ তাঁর নিজস্ব প্রবণতা এখানে যোগ করে হুমায়ুন আজাদীয় বৈশিষ্ট্য থেকে নিজের চিন্তাকে অগ্রসর করে নিয়েছেন; হানিফ তাই মুক্তির আকাক্সক্ষায় ব্যক্ত করেছেন প্রচন্ড আশাবাদ; বলেছেন ‘কমরেড, সঙ্গে আছি’, বলেছেন ‘আমরা সুন্দরের স্বপ্ন দেখি, সবুজের স্বপ্ন দেখি,/ স্বপ্ন দেখি মানুষের বাসযোগ্য নতুন সভ্যতার কুঁড়ি’। শুধু এখানেই শেষ নয়, হানিফ আরো বলে গেছেন, ‘কুৎসিত অন্ধকার জ্বালিয়ে দেব আলোর মশালে;/ আমরা জানি হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না/ জগতে আপনা আপনি কিছু হয় না’। এই আশাবাদ ও কর্মস্পৃহার ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদের সাথে হানিফের স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ করা যায়। আজাদকে কখনো কোনো কবিতায় এরকম আশাবাদ ব্যক্ত করতে দেখা যায় না, কিন্তু হানিফকে দেখা যায় কবি হিসেবে তাঁর অতীতের কর্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এখানে হানিফের রয়েছে কিছু স্বাতন্ত্র্য। কিন্তু হানিফকে নিজের নাম নিয়েই কবিতা লিখতে যখন দেখা যায় হুমায়ুন আজদের অলৌকিক ইস্টিমর কাব্যগ্রন্থের হুমায়ুন আজাদ শীর্ষক কবিতার মতো, এবং যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল কাব্যগ্রন্থের সৌন্দর্যের সৌন্দর্য কবিতাটা যদি খেয়াল করি, অথবা আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে কাব্যগ্রন্থের নামকবিতাটি যদি খেয়াল করি তাহলে হানিফের তুমি আমি কবিতার ২৩ পঙক্তির ১৯ পঙক্তিতেই ‘এখানে’ শব্দটির পুনঃপুনঃ ব্যবহার আজাদের যথাক্রমে উল্লেখিত কবিতাগুলোর পঙক্তির শুরুতে ৩২বার ‘সৌন্দর্য’ শব্দটির ব্যবহার ও ৪০ বার ‘আমি’ শব্দটির ব্যবহারের সাথে মিল খেতে দেখা যায়। এছাড়া হানিফের ঈশ্বর সম্পর্কিত কবিতাগুলোর ও গোলটেবিল বৈঠক নিয়ে লেখা কবিতাগুলোর পরিহাসের ধরন হুমায়ুন আজাদীয় বলে মনে হয় আমার।

তবে এই মিলগুলো রক্ষা করা লেখক মাত্রেরই একটি সহজাত বৈশিষ্ট্যর মধ্যে পড়ে; যে কবিতাগুলো আমরা ভালোবাসি, কথা বলার যে রীতি আমরা পছন্দ করি, প্রতিবাদের যে ধরন আমাদের আকর্ষণ করে সাধারণত আমরা তাই অনুসরণ করতে সচেষ্ট হই, বা না হলেও অবচেতনভাবে তা আমাদের মধ্যে কাজ করে; হানিফের কবিতার ক্ষেত্রেও তাই হয়ে থাকতে পারে। এমন কোনো কবি পাওয়া যাবে না যে, একটি-দুটি কবিতায় পূর্বজ লেখকের সাথে মিল নেই!

হানিফ বোধ হয় সেই মিলের প্রভাব লক্ষ করেই, তাঁর সময়ে তার আগের অন্য কোনো কবিদের নিয়ে কবিতা না লিখলেও, হুমায়ুন আজাদের প্রতি, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ, একটি কবিতা না লিখে পারেন নি :

সৌন্দর্য ও মনুষ্যত্বের কথা বলেন তিনি
শিহরিত হয়ে ওঠে আমাদের হৃৎপিন্ড;
মনে হয় একদিন চোখেও দেখব;
আমাদের দৃষ্টি কাড়ে তাঁর চোখের পরিধি
তিনি আমাদের ভাবতে শেখান।
* * *
একজন হুমায়ুন আজাদ নয়, জানি-
যুগে যুগে গর্দভেরাই বিলীন হয় অন্ধকারে।
[হুমায়ুন আজাদ]

যুগে যুগে আসলে গর্দভেরাই বিলীন হয়, একজন হুমায়ুন আজাদ বিলীন হবে না নিশ্চিত, তবে কবি হিসেবে হানিফ বিলীন হবেন কিনা সেই আশঙ্কায় হয়ত তিনি কেঁপে উঠেছিলেন, না হলে তাঁর দশ বছরের প্রসববেদনায় যে কাব্যগ্রন্থটির জন্ম তার নামটি তিনি রাখতে সাহস করলেন না কেন?
‘নিকাশের দায় রেখে’ এই নামটি, এই কাব্যগ্রন্থের সাথে কোন অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ, আমার কাছে তা ধরা পড়ে না। ‘নিকাশ’-এর মানে হচ্ছে চূড়ান্ত হিসাব; সেই আলোকে ‘চূড়ান্ত হিসেবের দায় রেখে’ নামটির মানে কী দাঁড়ায়? এই দাঁড়ায় যে, কবি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলছেন যে, ‘আমার কবিতা কী হয়েছে আমি জানি না, আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম, আপানারা বিবেচনা করে যা বুঝেন, যা মনে করেন, যা ভালো মনে করেন, আমি এর কিছুই জানি না, আমার লেখা কাল-ই বিচার করবে, কাল-ই বুঝিয়ে দেবে টিকবে কি টিকবে না!’-এগুলো সবই বস্তাপঁচা কথা। অন্ত্যতপক্ষে নতুন প্রজন্মের লেখক হিসেবে এই কথাগুলোর ইঙ্গিত পরিহার করা উচিৎ ছিল; যা খুব সচেতনভাবে চল্লিশটি কবিতায় হানিফ রাশেদীন করেছেন, কিন্তু এগুলো সব মিলিয়ে যখন একটি বক্তব্যে সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থের নামকরণের প্রশ্ন আসলো, হানিফ এর নাম স্থির করলেন তাঁর সব চেতনার বিরোধী হয়ে! কী পরিহাস! কবি খুব পরিশ্রম করে কবিতাগুলো লিখেছেন দীর্ঘদিনের সাধনায়, কোন নামটি তাঁর এই সাধনার সঙ্গে ও এই কবিতাগুলোর সঙ্গে যায়; তা তিনি স্থির করতে পারলেন না; তিনি যদি নিজের কবিতাগুলো থেকেও নামটি গ্রহণ করতেন তাহলেও এটা আংশিক প্রতিনিধিত্ব করতো তাঁর কবিতার; যদি তিনি কেবল সুন্দরের জন্য শোকগাথা এই শীর্ষক কবিতাটি দিয়ে নামকরণ করতেন, অন্তত সত্তরভাগ কবিতার প্রতিনিধিত্ব করত এটি! আসলেই সুন্দরের জন্য এই দশকে কোন তরুণ কবি এত হাহাকার করেছেন কবিতায়, আমাদের তা চোখে পড়ে না! যদি থাকেও তাহলেও এই নামটি দিয়েই তিনি বুঝাতে পারতেন এই সময়ে কবি হিসেবে তাঁর স্বাতন্ত্র্য কোথায়! কিন্তু এগুলোর কিছু না করেই এমন একটি নাম দিলেন যা তিনি আজীবন তার সকল গ্রন্থের শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন; শুধু তিনি নন, সকল কবিরাই এই নামটি ব্যবহার করতে পারে, কারণ সবকিছুই তো শেষ পর্যন্ত বিচারের দ্বারেই উত্তীর্ণ হয়!

একজন তরুণ কবির, বিশেষ করে হানিফ রাশেদীনের মতো পরিশ্রমী কবির, কাব্যগ্রন্থের নাম হওয়া দরকার তাঁর পরিচয়জ্ঞাপক; যে পরিচয়টি তাঁর কবিতাগুলো ধারণ করছে, এবং যে পরিচয়ে তিনি নিজে তাঁর স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরতে পারেন!

খুব কম কবিই তাঁদের প্রথম কাব্যগ্রন্থেই কোনো স্বতন্ত্র পরিচয় ধারণ করতে পারেন, সৌভাগ্য যে হানিফ সেই স্বল্পসংখ্যক কবিদের একজন; এবং দুর্ভাগ্য যে সেই স্বল্পসংখ্যকদের মধ্যে হানিফ এমন হতভাগ্য ব্যক্তি সেই স্বাতন্ত্র্যই যাঁর কাব্যের শিরোনাম ধারণ করতে পারলে না! হানিফ একটি কবিতায় লিখেছেন :

স্বপ্ন মাথা নোয়াতে জানে না, স্বপ্ন তো আলো;
অন্ধকার দেয়াল তার পথ রুখতে পারে না।

দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটির নামকরণে সময়, আশা করি, এই পঙক্তি দুটি, হানিফ অবশ্যই মনে রাখবেন!

বই : নিকাশের দায় রেথে / লেখক : হানিফ রাশেদীন
প্রচ্ছদ : শিবু কুমার শিল / প্রকাশক : সূচিপত্র
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১২ / মূল্য : ৮০ টাকা

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test