E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দুই যুগেও পরিবর্তন আসেনি নিউ ইয়র্কের বইমেলায়

২০১৬ মে ২১ ১৮:৫৩:৪৭
দুই যুগেও পরিবর্তন আসেনি নিউ ইয়র্কের বইমেলায়

সাবিত্রী রায়, নিউ ইয়র্ক : গত চব্বিশ বছরেও নিউ ইয়র্কে বইমেলায় কোন পরিবর্তন আসেনি। প্রবাসের একটি সংঘবদ্ধ স্বার্থানেস্বী মহলের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে প্রবাসীদের প্রাণের এ বই মেলা। নিজেদের নানারকম ব্যবসাকে চাঙ্গা করতেই মূলত এ মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। এবারের তিন দিনের আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলাতেও কোন পরিবর্তন আসেনি। যাহা পূর্বং তাহাই পরং। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা বাংলা প্রেস।

প্রতি বছরের মত এবারো এ আয়োজনে স্থান কাল ও আয়োজক পাত্র-পাত্রী একই থাকলেও শুধু পরিবর্তন হয়েছে অতিথির তালিকা। গত বছরের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি। স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকেলে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ বইমেলার উদ্বোধন করবেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

শুক্রবার বিকেলে এ উপলক্ষ্যে এক বর্ণাঢ্য প্যারেডের মাধ্যমে মেলার কার্যক্রম শুরু হবে। বইমেলায় আমন্ত্রিত কবি, সাহিত্যক ও সাহিত্যানুরাগী এবং শিল্পী-কুশলীরা ইতিমধ্যে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছেন। এ মেলার এ বছর ২৫তম বার্ষিকী।

এবারের মেলায় বাংলাদেশ থেকে আগত অংশগ্রহণকারীরা হলেন বাংলা একাডেমির মহা পরিচালক শামসুজ্জামান খান, অনুবাদক অধ্যাপক আবদুস সেলিম, নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজমদার, অভিনেতা ও লেখক আফজাল হোসেন, ইত্তেফাক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, প্রবন্ধকার আহমেদ মাজহার, কবি ও ছড়াকার আমীরুল ইসলাম, কবি সৈয়দ আল ফারুক, শব্দঘর পত্রিকার সম্পাদক ও লেখক মোহিত কামাল, কবি গুলতেকিন খান। এছাড়া ঢাকার চ্যানেল আই এর প্রধান নির্বাহী, বিশিষ্ট লেখক ফরিদুর রেজা সাগর উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও মায়ের অসুস্থতার কারনে তিনি আসছেন না। শিল্পীদের মধ্যে বাংলাদেশ আসছেন বিশিষ্ট শিল্পী ফেরদৌস আরা, নজরুল গীতি শিল্পী সুজিত মোস্তফা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী কমলিনী মুখোপাধ্যায় এবং লন্ডন থেকে আসছেন শিল্পী নাহিদ নাজিয়া।

কোলকাতার লেখকদের মধ্যে কথা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার, টেকনো ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী ও লেখক সত্যম রায় চৌধুরী এবং প্রকাশক ও লেখক ত্রিদিব কুমার চ্যাটার্জী বইমেলায় অতিথি হিসেবে যোগ দিচ্ছেন। জার্মান থেকে আসছেন নাজমুন নেসা পিয়ারী। কানাডা থেকে যোগ দিচ্ছেন বিশিষ্ট লেখক লুৎফুর রহমান রিটন, ইকবাল হাসান, মুস্তফা চৌধুরী, মাহফুজুল বারী, জসিম মল্লিক, শিল্পী শিখা আহমাদ, ফারহানা শান্তা ও শেখর গোমেস।
উত্তর আমেরিকার কবি ও সাহিত্যিকদের অনেকেই মেলায় আসছেন। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি একুশে পদকপ্রাপ্ত শহীদ কাদরী এবারের মেলায় তাঁর নির্বাচিত কবিতা নিয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন।

মেলা উপলক্ষ্যে প্রথমবারের মত বাংলাভাষা ও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য একটি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষনা করা হবে বলে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা ২০১৬ এর আহবায়ক হাসান ফেরদৌস উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের চ্যানেল আই-এর অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত এই পুরস্কারের নাম মুক্তধারা/চ্যানেল আই সাহিত্য পুরস্কার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সার্বিক অবদানের জন্য একজন লেখক এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হবেন। পৃথিবীর যেকোন স্থান থেকেই তেমন একজন লেখক যৌথভাবে নির্বাচন করবেন চ্যানেল আই ও নিউ ইয়র্ক বইমেলার প্রস্তুতি কমিটি। মেলার শেষ দিন ২৩ মে এই পুরস্কার ঘোষিত হবে। এই পুরস্কারের মূল্যমান দুই লক্ষ টাকা।

বইমেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হবে, মেলায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে সেরা বইয়ের স্টলের জন্য একটি পুরস্কার। মেলায় উপস্থিত দুই বাংলার সেরা লেখকদের একটি কমিটি তাঁদের বিবেচনায় সেরা স্টলটি নির্বাচন করবেন। বাংলাদেশের প্রকাশকদের মধ্যে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে মাওলা ব্রাদার্সের আহমেদ মাহমুদুল হক, সময় প্রকাশন-এর ফরিদ আহমেদ, অনন্যার মোঃ মনিরুল হক, স্টুডেন্ট ওয়েজে-এর মাশফিক উল্লাহ তন্ময়, নালন্দার রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল, কথা প্রকাশের মোহাম্মদ জসিমউদ্দীন, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের জহীরুল আবেদীন জুয়েল, সম্রাজ্ঞী প্রকাশনার সুলতানা রিজিয়া, প্রীতম প্রকাশের পপি চৌধুরী, ধ্রুপদ-এর আবুল বাশার ফিরোজ শেখ।

গত বছরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলায় চরম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠে। উৎসবের মিলনায়তনে প্রচন্ড গরমে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে আসা অতিথি লেখক, শিল্পী ও প্রবাসী দর্শকদের নাজেহাল হতে হয়। তিনদিনেই বারবার এ অভিযোগ করেও কোন কাজ হয়নি। মঞ্চে দাঁড়িয়েই শিল্পী ও কলাকুশলীরা আয়োজকদের এ অব্যস্থাপনার ধিক্কার ও নিন্দা জানিয়েছেন।

নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের ৬৯ নম্বর পাবলিক স্কুলে অনুষ্ঠিত এ উৎসবের উদ্বোধনের করেছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনিও মিলনায়তনে দীর্ঘক্ষন বসে থাকতে পারেননি।

তাই বারবার তিনি বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। নিউ ইয়র্কের মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বই মেলার অনিয়ম নিয়ে ঢাকার জাতীয় পত্রিকাসহ নিউ ইয়র্কের বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের লেখকদের চেয়ে ভারতীয় লেখকদের প্রাধান্য, বই মেলা উপলক্ষ্যে দুই বাংলা থেকে আদম আমদানী, বিভিন্ন অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গরাজ্য থেকে নানা শ্রেনী পেশার মানুষের কাছ থেকে স্পন্সরের নামে অর্থ আদায় ইত্যাদি। তবে সবকিছুর পর নিউ ইয়র্কের প্রবাসীদের প্রত্যাশা ছিল এবারের বই মেলা হবে একটি ব্যতিক্রম। কিন্তু এবারের পরিকল্পনাও যাহা পূর্বং তাহা পরং।

গত বছরের মেলায় প্রচুর দর্শক সমাগম হয়। কিন্তু বই বিক্রি তেমন হয়নি। ঢাকা ও কলকাতা থেকে এসে বিভিন্ন প্রকাশক ও লেখকরা আশানুরুপ বই বিক্রি করতে পারেনি। বেশ কয়েকটি প্রকাশনীর সাথে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা গত তিন দিনে গড়ে ৩০/৪০টি করে বই বিক্রি করেছেন। ঢাকা বা কলকাতা থেকে আসার বিমান ভাড়াও উঠেনি তাঁদের। কিন্তু তবুও তাঁরা অসন্তোষ্ট নন, কারন অনেকের পাসপোর্টে পাঁচ বছরের আমেরিকান ভিসা লেগেছে। ভবিষ্যতে আবারও আসা যাবে। ঢাকা থেকে এ বই মেলায় এসেছিলেন কবি শিহাব শাহরিয়ার। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে তিনি আলাপ প্রসঙ্গে বাংলা প্রেস'কে বলেন, তাঁকে কবিতা পড়ার জন্য মাত্র ২ মিনিট সময় নির্ধারন করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছেন, মাত্র ২ মিনিটের জন্য এক লাখ টাকা খরচ করে বাংলাদেশ থেকে নিউ ইয়র্কে আসেননি। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে তিনি কবিতা পড়ার জন্য এখানে এসেছেন। তাই ঐদিন তিনি একটি দীর্ঘ একটা কবিতা আবৃত্তি করেন।

দ্বিতীয় দিনেও মিলনায়তনের ভেতরে ও মূলমঞ্চে কোন এয়ার কন্ডিশন বা ফ্যান চালানোর ব্যবস্থা না করায় প্রবাসের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী দুলাল ভৌমিক, তাজুল ইমাম এবং দেশের প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী ও যন্ত্রশিল্পীরা প্রচন্ড গরমে নাজাহাল হয়ে পড়েছিলেন। অধিকাংশ দর্শক সংবাদপত্রের পাতা কিংবা ম্যাগাজিনের পাতা ছিঁড়ে নিজ নিজ বাতাস করতে দেখা গেছে।

প্রথম দিনে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান দেখা গেলেও, পরদিন একটি মাত্র খাবারের দোকান দেখা গেছে। সে দোকানটিকেও পাঠানো হয়েছিল একেবারের বাইরে ফুটপাতে। তারা বাধ্য হয়ে ধুলোবালি মেশানো খাবার পরিবেশন করেছেন অতিথিদের মাঝে। তৃতীয় দিন বা উৎসবের শেষদিনেও একই অবস্থা বিরাজ করে। বাংলাদেশ থেকে আসা জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী তাঁর গানের এক পর্যায়ে আয়োজকদের তাচ্ছিল্য করে বলেই ফেলেন, একটা ফ্যানের ব্যবস্থা থাকলে ভাল হতো। এ সময় তিনি ভীষন অস্বস্তিবোধ করছিলেন। প্রায় প্রতিটি দর্শকের একই অভিযোগ ভেতরে ভীষণ গরম। গান বা আলোচনা না শুনে অনেক দর্শক বাইরে বেরিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন।

অভিযোগ উঠেছে, জ্যাকসন হাইটসের ৬৯ নম্বর পাবলিক স্কুলটিতে এয়ার কন্ডিশনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিনের জন্য ২০০ ডলার করে ভাড়া দাবি করায় মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা উক্ত পরিমাণের ভাড়া প্রদানে অনীহা প্রকাশ করেন। ফলে প্রচন্ড গরমের যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন শত শত শ্রোতা-দর্শক।

এ ব্যাপারে বিশ্বজিৎ সাহা কালের কন্ঠকে বলেন, এ স্কুলে সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনের কোন ব্যবস্থা নেই, তাই মিলনায়তনের জানালা খুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। অথচ মূলমঞ্চের দু’পাশে দুটি করে চারটি ফ্যান দাঁড় করানো ছিল। শুধু বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়া হয়নি। কারন ফ্যান সংযোগ দেওয়াও নিষেধ ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এ উৎসবের যুক্তরাষ্ট্রস্থ একমাত্র পৃষ্ঠপোষক বিশিষ্ট ও সাংস্কৃতিসেবী ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন।

তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে অনুষ্ঠানে এসে বসার স্থান খুঁজে পাচ্ছিলেন না। গরমে মিলনায়তনের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি তাঁর দৃষ্টিগোচর করা হলে তিনি কালের কন্ঠকে বলেন, তিনি নিজেও প্রচন্ড গরমে অস্বস্তিবোধ করেছেন। তবে আগামীতে কোথাও বা কোন অনুষ্ঠানে স্পন্সর দেয়ার আগে এ বিষয়গুলো তিনি আয়োজকদের কাছে তুলে ধরবেন। কানাডার মন্ট্রিয়ল ও অটোয়া থেকে আসা দু’জন লেখক/লেখিকার সঙ্গে কথা হয়। কথা প্রসঙ্গে তাঁরাও বাংলা প্রেস'কে বলেন, কোন আন্তর্জাতিক মানের অনুষ্ঠানে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা কখনো বা কোথাও তাঁরা দেখেননি।

তবে নিউ ইয়র্কের লেখক ও সাহিত্যপ্রেমীরা এ বই মেলা প্রসঙ্গে বলেছেন, যাই হোক প্রবাসে বই নিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার জন্য এর আগে কেউ এগিয়ে আসেননি। সামান্য ভুল ক্রুটি হতেই পারে। এদের মধ্যে অনেকেই একবাক্যে এ কথাও স্বীকার করেছেন যে,সবকিছুর নেপথ্যে রয়েছে একটা বিশাল বানিজ্য। বইমেলা বা বাংলা উৎসবের মূল বানিজ্য হলো বাংলাদেশ ও ভারত থেকে জনশক্তি বা আদম আমদানী করণ।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বই মেলার জন্য বাংলাদেশ থেকে মোটা অংকের সরকারি অনুদান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও বীমা কোম্পানী এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে নানা শ্রেনী পেশার মানুষের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রচুর পরিমান অর্থ আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও এ ধরনের উৎসব ও বইমেলার অজুহাতে প্রতি বছর বাংলাদেশ ও ভারত থেকে শিল্পীদের সহযোগী হিসেবে আদম আমদানী করা হয়ে থাকে এ ঘটনা নিউ ইয়র্ক তথা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের কারো অজানা নয়।

(এএস/এএস/মে ২১, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test