E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইচ্ছেঘুরিতে সায়মার স্বপ্ন পূরণ 

২০২১ নভেম্বর ০৬ ১৫:০১:০৬
ইচ্ছেঘুরিতে সায়মার স্বপ্ন পূরণ 

আয়শা সিদ্দিকা আকাশী, মাদারীপুর : নুসরাত জাহান সায়মা। বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার নয় নম্বর ব্রীজ এলাকায়। বাবা মাদারীপুর চরমুগরিয়া গার্লস স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. নুরুল হক হাওলাদার। মা তাসলিমা খানম। অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা পর ফয়সাল আহমেদের সাথে বিয়ে হয়। কোভিড-১৯ মহামারি জন্য অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরিক্ষা স্থগিত হয়। তবে পরিবারের ইচ্ছে সায়মা অনার্স শেষ করে চাকরি করবে।  কিন্তু ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন ছিলো স্বাবলম্বী হবার। স্বপ্ন দেখেন নিজে কিছু করার। নিজে কাজ করে আয় করবেন। কিন্তু কি করবেন, কোথা থেকে শুরু করবেন, কিছুই বুঝতে পারেন না। পরে অনেকটা খেয়ালবশেই আচার বানানো শুরু করেন। ভাবেন বর্তমানে সংসারের কাজ, পাশাপাশি চাকুরী, সন্তান লালন পালন করে অনেকেই পরিবারের সদস্যদের জন্য মজাদার খাবার বানাতে পারেন না। বাজার থেকে কিনে আনেন। সেই খাবারগুলো অনেক সময় স্বাস্থ্য সম্মত হয় না। তাই তিনি চিন্তা করেন ঘরে বসে স্বাস্থ্য সম্মত ও মজাদার খাবার তৈরি করে তা ই-কমার্সের মাধ্যমে বিক্রি করার। 

২০২০ বছরের ১৩ আগস্ট শুরু করেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওয়েবসাইডভিত্তিক ব্যবসা। ফেসবুকে শুরু করেন প্রচারের কাজ। অনলাইনে ব্যবসার নাম দেন ইচ্ছেঘুড়ি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথমদিকে শুধু নানা ধরণের আচার বিক্রি হতো অনলাইনের মাধ্যমে। করোনা পরিস্থিতি মধ্যেও মোটামুটি ভালোই চলছিলো ব্যবসায়। দুমাসে আচার বিক্রি ভালো হলোও কিছু সমস্যার কারণে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয়।

পরবর্তীতে তিন মাস পর আবার নতুন উদ্যোগে নতুন চিন্তা আর নতুন কৌশলে অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে বসেই আবার ব্যবসাটা শুরু করেন। এবার শুধু আচার নয়, নানা ধরণের হাতে তৈরি খাবার বিক্রি শুরু করেন। হোমমেইড বাটার, মোজেরালা চিজ, হোম মেইড বেসন, হোম মেইড ট্যাং, হোম মেইড নারিকেল তেল, হোম মেইড ঘি, খেজুর, চা, হোম মেইড চিপস, বাটার, চিজ, শাহি হালিম মিক্স, ঝাড়মুড়ি মশলা, পেয়াজু, ফুসকা, কাসুন্দি, নুডুস, পাস্তা, খিচুরী মিক্সসহ নানা ধরণের মসলা ও খাবারের আইটেম আছে।

এ ব্যাপারে নুসরাত জাহান সায়মা বলেন, ব্যবসাটা শুরু করি মাত্র ৩৩০ টাকা দিয়ে। গত প্রায় ১০ মাসে বিক্রি করেছি প্রায় ৫ লাখ টাকা বেশি। এভাবে ভালো বিক্রি হবে ভাবিনি। এপর্যন্ত রিপিট কাস্টমার পেয়েছি ৬’শ এর বেশি।
তবে বিজনেসটা শুরু করেছিলাম একটা স্বপ্ন থেকে শখের বসেই। প্রথম যেদিন আমি আমার নিজ হাতে বানানো প্রোডাক্ট কাস্টমারের হাতে পৌছে দেই, সেই অনূভুতিটা ছিলো অসাধারণ। কাস্টমারের কাছ থেকে পাওয়া ফিডব্যাক ছিলো আমার কাজের প্রতি অনেক বড় অনুপ্রেরণা। নিজ হাতে রান্না করে প্রথম উর্পাজন ছিলো সামান্য। তবে সেই সামান্য উর্পাজন আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। আমার অনলাইনের মাধ্যমে এই কাজের পিছনে যাদের সবচেয়ে বেশি সার্পোট পেয়েছি তারা হচ্ছে আমার বাবা-মা, হাজবেন্ড, ছোটো বোন, ছোটো খালামনি-খালু, শ্বশুর-শাশুড়ি। তবে প্রথমে তাদের সার্পোট না পেলেও এখন সবসময়েই তারা আমাকে সার্পোট করছেন। প্রতিনিয়ত খবর নিচ্ছেন। ই-কর্মাসের মাধ্যমে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এই ডিজিটাল বাংলাদেশে আমার মতো অনেক নারীর স্বপ্ন পুরণ হচ্ছে ই-কর্মাসের মাধ্যমে।

সায়মা আরো বলেন, ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল উই গ্রুপে জয়েন করি। জয়েন হবার পর থেকে সকলের উদ্যোগ, আগ্রহ,কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস দেখে নিজেও হোমমেড ফুড নিয়ে কাজ শুরু করার সাহস অর্জন করি। আমি এবং ছোটোবোন মিলে ইচ্ছেঘুড়ি নামে পেইজ খুলে ফেলি। সর্বপ্রথম আচার, আরো কিছু খাবার এবং মায়ের হাতের তৈরী খাটি গাওয়া ঘি, শ্রীমঙ্গলের চা দিয়ে শুরু করেছিলাম উদ্যোক্তা জীবন। সকলের অনেক প্রশংসা পেয়ে এবং প্রায় প্রত্যেকেই রিপিট কাস্টমার হয়, যা আমার কাজের বিস্তৃতের জন্য অনেক বেশি অনুপ্রেরণার।

নুসরাত জাহান সায়মা আরো বলেন, মাদারীপুরে জেলায় সর্বপ্রথম ৪ রকম বালাচাও, হোমমেড বাটার, চীজ, অষ্ট্রাগ্রামের পনির, হোমমেড মসলাগুড়ো নিয়ে কাজ শুরু করি। খাবারগুলো নতুনত্ব এবং স্বাদের দিক থেকে সকলের রেসপন্স ছিলো অকল্পনীয়। তবে অন্যান্য খাবারের সাথে সবাই খুব বেশি পরিচিত থাকলেও মাদারীপুরে সবার কাছে অপরিচিত খাবারের মধ্যে বালাচাও ছিলো অন্যতম। বালাচাও হচ্ছে শুটকি দিয়ে তৈরী রেডি টু ইট খাবার। অনেকেই এই খাবারের নাম শুনেছে আবার কেউ নামও শুনেনি কখনো। বালাচাও তৈরির জন্য শুটকি ধুয়ে শুকানো থেকে শুরু করে প্রস্তুত করার ভিডিও কাস্টমারকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছে। সেই সাথে অন্যান্য খাবারে পাশাপাশি আরো কিছু খাবার নিয়েও কাজ করছি। যেমন খেজুড়ের গুড়, প্রাকৃতিক চাকের মধু, নারিকেল তেল, ড্রাই ফ্রুুটস, ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল। এইসব খাবারের পাশাপাশি রুট লেভেল থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার গ্রাহকের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করছি। যেমন মাদারীপুরের ঐতিহ্যবাহি খেজুড় গুড়, পুরান ঢাকার বাকরখানি, খুলার ঐতিহ্যবাহী চুইঝাল, কুমড়োর বড়ি, রাজমা, নাটরের কাচাগোল্লা নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। আমার হোমমেড পণ্য এই পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় কুরিয়ার মাধ্যমে গ্রাহকের হাতে পৌছাতে পেরেছি।

সায়মা নিজের উদ্যোক্তার গল্প করতে করতে বলেন, আমার এই কাজের পিছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা হচ্ছেন আমার বাবা, মা, হাজবেন্ড ও ছোটো বোন ইবরাত জাহান প্রভা ভাই এহসানুল হক তাফসির। তারা সাহায্য না করলে কখনোই সম্ভব হতো না এতো দূর আসার। আমি পড়াশুনা বা কাজের জন্য জেলার বাহিরে থাকলে খাবার তৈরী থেকে শুরু করে কাস্টমারের কাছে ডেলিভারি, কুরিয়ার করা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ তারা করেন। আমি দেখেছি আমার মতো অনেকেই কাজ শুরু করেন কিন্তু পারিবারিকভাবে সাপোর্ট কিংবা পরিচিতজনের কটুক্তিতে হিনমন্যতায় ভুগে উদ্যোক্তা থেকে পিছিয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে আমি মনে করি নিজের কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে কখনই পিছিয়ে যাওয়া উচিত না এবং অভিভাবকদের উচিত তাদের অনুপ্রেরণা দেয়া এবং সহযোগিতা করা।

এ ব্যাপারে উদ্যোক্তা সায়মার স্বামী ফয়সাল আহমেদ বলেন, নারী-পুরুষ সবারই উদ্ভাবনী শক্তি সমান বলে আমি মনে করি। তাই শুধু দরকার সেগুলো বিকশিত করার সুষ্ঠু পরিবেশ। সেই সাথে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা। যাতে কাজের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং প্রয়োজনে তাদের লোন এর ব্যবস্থা করা। যেনো অর্থের অভাবে কোনো উদ্যোক্তাদের পিছিয়ে পরতে না হয়।

এ ব্যাপারে নারী উন্নয়ন সংস্থা নকশি কাথার সভাপতি নুরুন্নাহার জুই বলেন, বর্তমানে নারীরা ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্থ উর্পাজন করছেন। এটা খুবই ভালো দিক। এভাবেই মেয়েরা আরো এগিয়ে আসুক।

মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মাহমুদা আক্তার কণা বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন শুধু শহরের নয় গ্রামে গ্রামে পৌছে যাক ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা। সায়মার মতো মেয়েরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে ব্যবসা করছেন, সেটাই আমাদের বাস্তবিক উদাহরণ।

(এ/এসপি/নভেম্বর ০৬, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test