E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস এবং প্রতিবন্ধী নারী

২০১৪ ডিসেম্বর ০৯ ১৬:১২:০০
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস এবং প্রতিবন্ধী নারী

এ্যাডভোকেট নুরজাহান : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস বিশ্বের সব দেশে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর পালিত হয়। জাতিসংঘের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকে এ দিবসটি উদযাপন করে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি পালন করবে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় : মানবাধিকার ৩৬৫ দিন।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪২তম বছর পার করে ফেলেছ, দেশ অনেক দূর এগিয়ে চলেছে। কিন্তু থামানো যায়নি নারী নির্যাতন ও নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি এখনো।

বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজ কাঠামো, বিকশিত হচ্ছে সভ্যতা। পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে মানুষের জীবনযাত্রায়। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, বন্ধ হয়নি নারী নির্যাতন। নারী’ এই শব্দটি প্রাচীন কাল থেকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ নানাভাবে নির্যাতিত ও শোষিত হচ্ছে, হচ্ছে অধিকার হারা। সবই পরিবর্তিত হচ্ছে কিন্তু নারীর কপালে দূর্ভোগ কমছে না। আর এই দুর্ভোগ বা বঞ্চনা শুরু হয় তার পরিবার হতে। আর এই বঞ্চনার শুরু হয় তার জন্মের পর হতেই। যেন সে এক নিষিদ্ধ জাতি, অর্স্পৃশ্য কেউ। আইয়্যামে জাহেলিয়াত যুগে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করা ছিলো লজ্জার বিষয়। ফলে লজ্জা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কন্যা সন্তানকে জীবিত কবর দিতে লজ্জাবোধ করতো না।হিন্দু ধর্মে যত তাড়াতাড়ি বিয়ে অর্থাৎ ১৬ বছরের পূর্বে বিয়ে দেওয়াকে বলা হতো ‘গৌরী দান’, এই গৌরী দানের নামে বাল্যবিবাহ উৎসাহিত করা হয়েছে। অপরদিকে, পৈত্রিক সম্পত্তিতে তাদের কোন অধিকার নেই। মুসলিম সমাজে পায় ছেলেদের অর্ধেক।

দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী এবং সমাজের উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তারপরও সাধারণভাবে তারা শান্তি, নিরাপত্তা ও অধিকারের দিক দিয়ে এখনো পুরুষের সমকক্ষতো নয়ই কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ এই নারীর কারণেই একটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পায়, একটি সুন্দর জীবনের শুভ সুচনা হয়।

সাধারণ নারী যেখানে আজো অধিকার আদায় করতে পারেনি সেখানে নারী যদি প্রতিবন্ধী হয় তবে তার অবস্থান কোথায় তা সহজেই অনুমেয়। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী আজ মূলস্রোতধারা হতে অনেক পিছিয়ে। এর পিছনে অনেকগুলো কারন দায়ী। যেমন- সামাজিক অজ্ঞনতা, অবহেলা, আইনের বাস্তবায়নের অভাব, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, সামাজিক প্রতিবন্ধীতা প্রভৃতি। আর প্রতিবন্ধী নারী সে তো জন্মই নেয় অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হওয়ার জন্য। আমাদের সমাজে নারী প্রতিবন্ধীরা প্রতিটি স্তরে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদের ধারা-১২ এর ১ এ বলা হয়েছে :

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ জীবনের সকল ক্ষেত্রে অন্যান্যদের মতো সমান আইনী কর্তৃত্ব ভোগ করেবন।

কিন্তু সত্যিই কি আমাদের দেশে এই অবস্থা বিদ্যমান? একিট উদাহরণ দিলে বিষয়টি বাস্তব অবস্থা বোঝা যাবে।

গত ১ ডিসেম্বর রাতে নারী যোগাযোগ কেন্দ্রের সহযোগিতায় জালালাবাদ হাউজিং এর কাঠাল বাগান এলাকার একটি বাসা হতে ধর্ষিত এক বাক ও শারিরীক প্রতিবন্ধী মেয়েকে উদ্ধার করে পুলিশ। তারপর শুরু হয় আসল নাটক। থানা পুলিশের অবহেলা, আইনী জটিলতা, সমাজের দায়িত্বশীলদের নিস্ক্রিয়তা প্রভৃতি এমন আকার ধারণ করে যে প্রতিবন্ধী হওয়া এক অভিশাপ। যে অভিশাপের কারণে সবাই এ অসহায় মেয়েটিকে এড়িয়ে গেছে। তার জন্য এখন আইনী লড়াইয়ের পাশাপাশি চালিয়ে যেতে হচ্ছে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনের মতো সামাজিক আন্দোলন। আর চালাতে হচ্ছ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই লেখাটা লেখা পযর্ন্ত কোন আসামী গ্রেফতার হয়নি।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে এই স্বাধীন দেশে? কেন প্রশাসন নীরব প্রতিটি ঘটনায়? কেন আজও আমাদের রাস্তায় দাড়িযে অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে?

দেশের সর্বত্রই আজ প্রতিবন্ধীদের একই অবস্থা । প্রতিবন্ধীদের মৌলিক অধিকার আদায় করতে সর্বদা সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এই অবস্থা আজ আমাদের প্রতিবন্ধী নারীদের সকল অধিকারের ক্ষেত্রেই চলছে। প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার সর্বত্র হরণ করা হচ্ছে এবং এর কোন প্রতিকার নেই।

বঞ্চনার শুরু হয় প্রতিবন্ধী নারীর জন্মের পরই।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর ৩৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে গণস্থাপনার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশ নিশ্চিত করার জন্য বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট-১৯৫২ এ প্রণীত বিধি বিধান অনুসরণ করতে হবে। এখানে গণস্থাপনা বলতে সর্ব সাধারণ চলাচল করে এমন সব সরকারি-বেসরকারি ভবন, পার্ক, স্টেশন, বন্দর, টার্মিনাল ও সড়ক বুঝানো হয়েছে।

মূলত প্রতিবন্ধীদের অবকাঠামোগত সুযোগ সংবলিত ভবন বলতে বোঝানো হয় যেখানে র্যাবম্প ( যার ওপর দিয়ে হুইল চেয়ার যাতায়াত করবে), ব্রেইল (যার মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা লেখা বুঝতে ও পড়তে পারে) উপযোগী ফ্লোর থাকবে। ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটি অর্থাৎ এই অবকাঠামোগত সুবিধাটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেতো নেই অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানেও নেই।

কথা ছিল প্রায় দশ হাজার প্রাইমারি ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য স্থাপন করা হবে র্যাম্প সুবিধা কিন্তু এটা এখনো পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ বাস্তবায়ন কবে হবে তার কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই।

দেশে অনেক বালিকা বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজ আছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য সারা দেশেও আলাদা কোন বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয় নেই। কেন নেই তার জবাব কে দেবে তার জন্য কোন জবাবদিহিতা নেই। প্রতিবন্ধী নারীর জন্য প্রয়োজন সহজ প্রাপ্য ও সহজ পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা, সহজ লভ্য হওয়া উচিত বিভিন্ন উপকরণ। তার বদলে এই জনগোষ্ঠীকেই সংগ্রাম করতে হয় সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে। প্রতীবন্ধী বান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা বা পাওয়া প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার। অথচ আজো আমরা আমাদের এই মৌলিক অধিকারটাই ঠিক মতো পাচ্ছি না। অন্যান্য দাবী বা অধিকার চাওয়া বা পাওয়ার আশা করা বাতুলতা মাত্র।

দেশে আছে প্রতিবন্ধী আইন, আছে ইউএনসিআরপিডি (United Nation Convention on Rights of Person With Disability) । কিন্তু এই আইনের কোন বাস্তবায়ন নেই। তাই চাই আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, চাই নারী প্রতিবন্ধীদের মৌলিক অধিকারের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন।

লেখক : দেশের প্রথম নারী দৃষ্টি প্রতীবন্ধী আইনজীবী ও সাধারণ সম্পাদক
রাইট এ্যাকশন ফর ডিজএ্যাবিলিটি র‌্যাড।
e-mail : [email protected]

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test