E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উপমহাদেশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নবাব ফয়জুন্নেসা

২০১৫ অক্টোবর ২০ ১৫:১৪:১০
উপমহাদেশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নবাব ফয়জুন্নেসা

মো. আলী আশরাফ খান : পরম করুণাময় আল্লাহ তা’য়ালা সময়ের প্রয়োজনে এমন কিছু মানুষ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন, যারা সমাজ, দেশ সর্বোপরি বিশ্বের যাবতীয় অন্ধকার ও কলুষতাকে দূর করার ক্ষেত্রে পাহাড়সম অবদান রাখেন। প্রচার-প্রচারণা নয়, দায়িত্ব ও কর্তব্যের খাতিরেই ওইসব আলোকিত মানুষগণ সমাজ, দেশ তথা জাতির জন্য নিরলস কাজ করে যান। এমনি একজন ব্যতিক্রমী ও উজ্জ্বলতার অধিকারী নারী নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। যার আলোয় আলোকিত হয়েছিল সমাজ, দেশ তথা এই উপমহাদেশ।

যদিও আমরা অনেকে ইতিহাসে নারীর শিক্ষা ও জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াতকেই জানি। কিন্তু বেগম রোকেয়া শাখাওয়াতের জন্মের প্রায় ৫০ বছর পূর্বে এদেশের অজপাড়াগায় এই মহীয়সী নারী নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী জন্ম লাভ করেন। সাবেক ত্রিপুরা রাজ্যের কুমিল্লা জেলার পশ্চিমগাঁও গ্রামে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে এই মানবতাবাদী মহান মানুষটি জানান দিয়েছিলেন যে, নারীরাও পারে সমাজে এমন কিছু অবদান রাখতে যা সচরাচর অন্যরা পারে না; চেষ্টাও তেমন একটা করে না।

কিন্তু এই ব্যতিক্রমধর্মী মহীয়সী ঐশ্বর্যশালী নারীর অসামান্য অবদানের ইতিহাস আমরা অনেকেই জানিনা। জানার তেমন একটা চেষ্টাও করি না। যা আমাদের পশ্চাৎপদতারই বহিঃপ্রকাশ। অথচ তিনি নারীদের মন-মানসিকতা, স্বাধীনতা, প্রগতি, ক্ষমতায়ন ও কল্যাণ সাধনে অনন্য এক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। যা আমরা আজ গর্ব ভরে স্মরণ করতে পারি-বাঙালি জাতি হিসেবে। এটা আমাদের জন্য অতি গর্বের ও অহংকারের বিষয়ও বটে।

এই খ্যাতিমান নারীর পূর্ব পুরুষদের নিবাস ছিল ভারতের দিল্লিতে। আগল খাঁ নামের এক অভিজাত পরিবার ছিল তার পূর্ব পুরুষদের। দিল্লির সম্রাট শাহ্ আলম, ত্রিপুরা জেলার হোমনাবাদে রাজকার্য পরিচালনার জন্য স্বপরিবারে বহু সৈন্য-সামান্তসহ আগল খাঁকে এই অঞ্চলে প্রেরণ করেন। আগল খাঁ’র রাজকার্য পরিচালনা ও দক্ষতায় খুশি হয়ে এ এলাকার প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন প্রশাসন এবং এই পুরো জায়গাটি দান করেন তাকে। কিন্তু আগল খাঁ তার পুত্র ভুরু খাঁকে এখানে উত্তারাধিকার হিসেবে রেখে এক সময় দিল্লিতে ফিরে যান।
আর এই বংশেই হোসেন আলী খাঁ নামে একজন আলোকিত মানুষের জন্ম হয়। যার এক সন্তানের নাম রাখা হয় আহমদ আলী। যিনি পরে একজন স্বনামধন্য মৌলভী হিসেবে এই এলাকায় বেশ সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হন। এই সুনামধন্য মৌলভী আহমদ আলীর সুযোগ্য কন্যাই হচ্ছেন আমাদের গর্ব ফয়জুন্নেসা। যিনি পরে মহারানী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক ‘নবাব’ উপাধিপ্রাপ্ত হয়ে উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম বাঙালি মহিলা হিসেবে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন।

শৈশব থেকেই এই প্রতিভাধর নারী নিজেকে মুসলিম ঐতিহ্যবাহী পরিবারে সু-শৃঙ্খল জীবনযাপন ও জ্ঞানচর্চার মধ্যে নিমগ্ন রাখেন। তার প্রাথমিক পাঠ শুরু হয় মাওলানা তাজউদ্দিন আহমেদ নামের এক মহান শিক্ষকের নিকট। যদিও পারিবারিক ও পারিপার্শি¦ক উর্দুভাষার প্রচলন ছিল তখন কিন্তু তিনি আরবি, ফারসি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষাতেও সমানভাবে দক্ষতা অর্জন করেন এবং তার জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করতে সক্ষম হন।
নবাব ফয়জুন্নেসার জীবনের পরতে পরতে ছিল দুঃখগাঁথা ও এক বৈচিত্রময়তায় ঘেরা। তারপরেও যতরকম সমস্যা ও কন্টকাকীর্ণ পথ তার সামনে এসেছে তিনি তা অতি বুদ্ধিমত্ত্বার সঙ্গে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছেন সবসময়। বিদ্যাবুদ্ধি, বিচক্ষণতা, কর্মদক্ষতায় তিনি ছিলেন সব ভাই-বোনদের মধ্যে ব্যতিক্রম। ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর আগেই সব ভাই বোনদের সম্মতিক্রমে পিতার রেখে যাওয়া বিরাট জমিদারী দেখাশোনা করার দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়। জমিদারীর কঠোর দায়িত্বভার তিনি আজীবন সুদক্ষতার সঙ্গে পর্দার আড়ালে থেকে অত্যন্ত সফল শাসকরূপে ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

ফয়জুন্নেসার আমলে কুমিল্লা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট কুমিল্লার লোকদের উপকারার্থে একটি জনহিতকর কাজে হাত দিয়ে সমস্যায় পড়েন। এসময় মানবতাবাদী নবাব ফয়জুন্নেসা চাহিদা অনুযায়ী টাকার একটি তোড়া ইংরেজ ডগলাসকে দান হিসেবে প্রদান করেন। তার এই দানশীলতার কথা মহারানী ভিক্টোরিয়া জেনে মহারানী ডগলাসকে হুকুম করেন তাকে ‘বেগম’ উপাধি দেয়ার জন্য। ফয়জুন্নেসা ডগলাসের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, জমিদার কন্যা ও স্ত্রী হিসেবে অনেক আগেই এই পদবিতে তিনি ভূষিত। পরে মহারানী ঠিক করেন, এই মহৎ মহীয়সী নারীর একমাত্র সার্থক সম্মান ‘নবাব’ উপাধি-ই হতে পারে। রানীর নির্দেশ অনুযায়ী ১৮৮৯ সালে কুমিল্লার নবাব বাড়ির অট্টালিকায় ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এই উপাধি দেয়ার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। হিরক খচিত মহামূল্যবান পদক দিয়ে তাকে ‘নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী পর্দার অন্তরাল থেকে এই উপাধিটি গ্রহণ করেন।

সব সময় শিক্ষার প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব দিতেন তিনি। এই চিন্তার ফলশ্রুতিতে ১৮৭৩ সালে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করেন বেগম ফয়জুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। তার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ার দুই বছর পর ১৮৭৫ সালে সর্বপ্রথম আলীগড়ে মুসলমানদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

১৮৯৩ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পর তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহিলাদের জন্য হাসপাতাল। নাম দিয়েছিলেন, জানানা হাসপাতাল। তার প্রতিষ্ঠিত বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখনও দেশে-বিদেশে। বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রথম সারির একজন মহিলা কবি হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। তার বিখ্যাত আত্মজৈবনিক কাব্যগ্রন্থ রুপজালাল রচিত হয় ১৮৭৬ সালে। এই লেখায় তিনি কোন রকম কল্পনার আশ্রয় নেননি। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অন্তর্জ্বালা অতি সুনিপুনভাবে প্রকাশ করেছেন বাংলা, সংস্কৃত, ফারসি শব্দের মিশ্রণে।

১৮৯৪ সালে তিনি পবিত্র হজ পালনের জন্য মক্কা গমন করেন। সেখানে গিয়েও তিনি অনেক দান করেন এবং মক্কা শরীফে একটি মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যা এখনো বিদ্যমান। মক্কাশরীফ থেকে এসে পরিবার-পরিজনদের জন্য সামান্য কিছু সম্পত্তি রেখে বাকি সমস্ত সম্পত্তি আল্লাহর নামে ওয়াকফ করে দেন। সম্পত্তি ওয়াকফ করার পর তিনি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মক্তব ও হাসপাতাল নির্মাণে অনেক টাকা দান করেন। তার ব্যক্তিগত দৈনন্দিন দিনযাপনের তালিকাতেও অনেককিছুু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে গেছেন আমাদের জন্য।
যদিও তার স্বামী মোহাম্মদ গাজী নবাব ফয়জুন্নেসার সঙ্গে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছিলেন কিন্তু তিনি একজন উচ্চবংশীয় জমিদার ও সুরুচির অধিকারী মানুষ ছিলেন। বেগম ফয়জুন্নেসা দুই কন্যা সন্তানের জননী ছিলেন। তার দু’কন্যার নাম আসাবুন্নেসা ও বদরুন্নেসা। এই মহীয়সী নারী ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দ ইহলোক ত্যাগ করেন।

পরিশেষে বলতে হয়, আাল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের আলোকে যে মানবতাবাদী নারী বিরল গুণাবলী ও দক্ষতার সঙ্গে সমাজ, দেশ-জাতিকে আলোকিত করেছিলেন; সমাজকে করেছিলেন কুসংস্কার মুক্ত; নারীদের শিখিয়েছিলেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার; সাহস ও সুযোগ করে দিয়েছিলেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার; সেই খ্যাতিমান নারীর জীবনী আমাদের মধ্যে অনুশীলন হবে না-তা কি করে হয়?

আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই নারীর বিশাল জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম খুব কমই জানে। প্রচার-প্রচারণাও তেমন একটা নেই বললেই চলে আমাদের দেশে। যদিও কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ যেমন লাকসামের আমাদের প্রিয় ব্যক্তি শাহেদ আহমদ চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন সংগঠক ১ যুগ আগে নবাব ফয়জুন্নেসার জীবনকর্ম নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু কিছু দিন পর শাহেদ আহমদ চৌধুরী পরলোক গমন করায় সাংগঠনিক কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পরে। ওইসময় আবারও মহীয়সী নারীর ফয়জুন্নেসার আদর্শকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ। যা চলছে বছরের পর বছর। কিন্তু সরকার ও বিত্তশালীদের কাছ থেকে কোন রকম সাহায্য-সহযোগিতা না

পাওয়ায় এই সাংগঠনিক কার্যক্রমকে তেমন একটা বেগবান করতে পারছেন না তারা। বিশেষ করে আমাদের সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব আজাদ সরকার লিটন ১ যুগ ধরে এই মহীয়সী নারীর কর্মকা- নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি দেশের বিভিন্ন সাংগঠনিক ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও ফয়জুন্নেসার জীবনী নিয়ে সকলকে কাজ করার উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদান করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আমরা মনে করি, আজাদ সরকার লিটনের মত অন্যান্য সৃষ্টিশীলদেরও এই মহতী কাজে এগিয়ে আসা জরুরি। আর তবেই আমরা নবাব ফয়জুন্নেসার আলোয় আলোকিত হতে পারবো; সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি নিজেরাও ধন্য হবো।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সংগঠক

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test