E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইটভাঙা নারীদের  ভাগ্য বদলের কথা

২০১৭ মার্চ ০৭ ১৫:০৫:৪০
ইটভাঙা নারীদের  ভাগ্য বদলের কথা

গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : টুশটাস হাতুড়ির শব্দ। কঠিন ইটের গায়ে আঘাত হেনে চলছে কোমল হাতে ধরে থাকা হাতুড়ি। ইট ভাংগার শব্দ। ইট ভাঙা হচ্ছে রাস্তার পাশে, বাড়ির আঙ্গিনায় বসে। কোথাও আবার ঘরের বারান্দা কিংবা রান্নাঘরের ভেতরেই চলছে ইট ভাঙ্গার কাজ। বিভিন্ন বয়সী নারী ইট ভাঙ্গার কাজ করছে। কোনো স্থানে একা একা, কোনো স্থানে আবার দলবদ্ধভাবে। এটি ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌরশহরের বালুয়াপাড়া গ্রামের প্রতিদিনের দৃশ্য। সংসারের সব কাজ করার পাশাপাশি ইট ভেঙে পরিবারের অভাব দূর করেছেন এই গ্রামের দেড় শতাধিক নারী। নিজেরা উপার্জনক্ষম হয়ে বদলে দিয়েছেন নিজেদের জীবন যাত্রা।

সরজমিনে গিয়ে ইট ভাঙার কাজ করা নারীদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের জীবন-সংগ্রামের গল্প। এক সময় আর্থ-সমাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই এলাকার দারিদ্রপীড়িত নারীরা কিভাবে কোমল হাতে কঠিন ইট ভেঙ্গে আত্মনিভর্রশীল হয়ে উঠেছে, এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে বেরিয়ে আসে দিন বদলের নানা কথা। তাদেরই দুইজন হলেন বালুয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুছ সোবহানের মেয়ে রাবেয়া খাতুন (৩৬) ও তার বোন আম্বিয়া খাতুনের (৩৪)। তাদের হাত ধরেই এখানে শুরু হয়েছিলো এই দিন বদলের গল্প।

তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আনুমানিক ২৫ বছর আগের কথা। তখন তারা কিশোরি। বাবা রিকশা চালাতেন। সারা দিন খেটে যা রোজগার করতেন তা দিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের ভরণ পোষণ হতো না। কিছু একটা করে সংসারের অভাব দূর করার তাড়নায় একদিন ঘর থেকে বের হয়। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ছিলো উপজেলার রামগোপালপুর জমিদারদের পরিত্যক্ত বাড়ি। সেই বাড়ির খসে পড়া ইট কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। বেশ কিছু ইট ভেঙে সুড়কি করে ময়মনসিংহে শম্ভুগঞ্জ এলাকার এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। হাতে কিছু টাকা আসে। এভাবে রামগোপালপুর জমিদার বাড়ি থেকে কিছু দিন ইট কুড়িয়ে এনে জমিয়ে মাঝে মাঝে বিক্রি করে ফেরিওয়ালার কাছে। সাথে বিক্রি করার মত আরও যা কিছু পায় তাই কুড়িয়ে আনে। রাবেয়া আর আম্বিয়ার দেখাদেখি অভাবি আরও কিছু কিশোরি জুটে যায় দলে। মাঝে মাঝে মায়েরাও যায় মেয়েদের সাথে। এভাবে চলে ৫ বছর। এরমধ্যে বাড়ির আশে পাশে ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জ সড়কের পাশে গড়ে উঠে কয়েকটি ইটভাটা। বালুয়া পাড়ার নারীরা ইটভাটার কাজে জড়িয়ে পড়ে। ইটভাটার ভাঙার অভিজ্ঞাতার কথা মাথায় রেখে একদিন জমানো কিছু টাকা দিয়ে বাড়িতে ইট কিনে আনেন আম্বিয়া ও রাবেয়া। সেই ইট বাড়িতে বসে সুড়কি করে বিক্রি করে। ইট বেচে চার টাকা লাভ হয়। এরপর শুরু হয় নতুন গল্পের। দুই বোন আর মা ইটভাটা থেকে ইট কিনে এনে সুড়কি করে বিক্রি করে। হাতে টাকা আসতে থাকে। দেখাদেখি বালুয়াপাড়ার অভাবি অন্য পরিবারগুলোও ইট ভেঙে সুড়কি করার কাজ শুরু করে। ২৫ বছর পর এখন ওই এলাকার প্রায় দেড় শতাধিক নারী দিনে ছয় থেকে আট ঘন্টা ইটা ভাঙার কাজ করেন। এভাবে বদলে গেছে অভাবী মানুষদের জীবন। বর্তমানে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা ও আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপনা নির্মাণের জন্য বেশির ভাগ সুড়কির চাহিদা এখান থেকে মিটানো হয়। সরেজমিনে দেখা যায় ইট ভাঙার কাজ করা নারীদের অনেকরই এখন আধা-পাকা বাড়ি রয়েছে। অনেকের ঘরে ঘরে আছে খাট, খাবার টেবিল ও রঙিন টেলিভিশসহ নানা আসবাবপত্র।

আম্বিয়া খাতুন বলেন, এই ব্যবসা শুরু করার পর অভাবের সংসারে উন্নতি হয়েছে। স্বামী-সন্তান সহ ৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে আমরা এখন সুখি। আমার কারখানায় ১৫/১৬ নারী ইট ভাঙ্গার কাজ করে। নারীদের সাথে আমি নিজেও এখনো ইট ভাঙ্গি। পাশাপাশি ব্যবসার আয়ের টাকা দিয়ে অন্যান্য ব্যবসা শুরু করেছি। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বালুয়াপাড়ার ২০টির বেশি পরিবার সরাসারি ইট কিনে সুড়কি করে ব্যবসার কাজে যুক্ত। ইট কিনে আনা ও সুড়কি করে বিক্রির জন্য অনেকেই কিনে নিয়েছেন ট্রলি। যে পরিবারগুলো এখনো নিজেরা ব্যবসার সাথে যুক্ত হতে পারছে তাঁরা অন্যের অধীনে ইট ভাঙার কাজ করছে। ইট ভাঙার কাজের জন্য তাঁদের ধরাবাঁধা কোন সময় মানতে হয় না। সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনে-রাতে যখন ইচ্ছা তখন ইট ভাঙে। ইট ভেঙে এক টিন (সোয়াবিন তেলের টিন) সুড়কি করলে পায় পাঁচ টাকা। বালুয়াপাড়া গ্রামের নারী পুরুষদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পুরুষেরা ইজিবাইক চালনো, মুদি দোকান করাসহ নানা পেশায় আছেন। সাথে পুরুষদের রোজগারের পাশাপাশি নারীদের ইট ভাঙা কাজের রোজগার এখন জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করছে। ছেলে মেয়েরা এখন স্কুলে যায়। গ্রামের বাসিন্দা বিধবা হাজেরা বেগম (৪৫) বলেন, আমার পরিবারের লোকজন বাইরে থাকে। অবসরে আমি এখানে এসে ৮/১০ টিন ইট ভাঙি। এতে আমার ৫০ টাকার মতো আয় হয়।

তাজ্জতুনন্নেছা বলেন, ২০ বছর ইট ভাইঙা সংসারের খাওন যোগাইছি। এখনও সময় পেলে ভাঙি। ইট ভাঙনের কাজ আমাদের অভাব দূর করছে। যেই এলাকার মানুষ তিন বেলা খাইতে পারতো না, হেরা অহন অনেক সুখে দিন কাডায়।

(এসআইএম/এএস/মার্চ ০৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test